ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের ॥ দেওয়ান গাজীর কিস্সায় নির্দেশক আসাদুজ্জামান নূর অথবা গ্যালিলীও নাটকের নির্দেশক আতাউর রহমান আমাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। নুরলদীনের সারা জীবন নাটকে তো আমি নিজেই নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলাম। অতএব আমি নিশ্চিত এই লেখাটির ধারাবাহিকতায় এই নাটক তিনটি

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ১৮ মে ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) পর্ব- ১০ নাটক করেছি অভিনয়ের প্রতি সহজাত ভালবাসা থেকে। ভেবেছি কম, করেছি বেশি। যে কোন সংলাপ উচ্চারণ করলেই তা এক ধরনের তরঙ্গ সৃষ্টি করে আমাদের হৃদয়ে। অতএব আমরা খুব বেশি ভাবনা-চিন্তা না করে প্রায় তোতা পাখির মতোই কথাগুলোকে উচ্চারণ করে যাই। সুউচ্চারণে এবং কণ্ঠের দোলায় তা অনেক সময় হৃদয়গ্রাহীও হয়ে ওঠে। আমার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্ন আমার মনে দেখা দেয় যে একটি নাটক নিয়ে, নাটকের চরিত্রগুলো নিয়ে, সংলাপ নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা-ভাবনা করার বিষয় আছে। তাহলেই কেবল নাটকের, চরিত্রের এবং সংলাপের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা সম্ভব। তখন অভিনয় অনেক বেশি সত্য হয়ে ওঠে, গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এই সময় থেকে নাটক নিয়ে নানা রকম বিচিত্র চিন্তা-ভাবনা আমার মনে খেলা করতে শুরু করে। মাঝে মাঝে ভাবি যে পেশা হিসেবে অভিনয়কে গ্রহণ করতে হলে হয়ত চিন্তা-ভাবনা এবং বিশ্লেষেেণর বিষয়টি মার খায়। কেননা কোন কিছু ভাববার আগেই আমাকে প্রস্তুত হতে হয় নতুন কোন নাটকের চরিত্র কিংবা সংলাপ নিয়ে। আমার বোধগম্য হয় না যে, সপ্তাহে একেক দিন ভিন্ন ভিন্ননাটকে, ভিন্নভিন্ন চরিত্রে, সংলাপ থেকে সংলাপে কি করে অভিনয়ের সত্যকে স্পর্শ করা সম্ভব! আমি অনেক শক্তিশালী অভিনেতাকে দেখেছি এই ধরনের কাজটি করতে গিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হতে। হয়ত চমকপ্রদ অভিনয়ের দ্বারা দর্শকের মন জয় করা যেতে পারে কিন্তু আখেরে দর্শক চরিত্রকে নয় অভিনেতাকেই বার বার ঘুরেফিরে পান। এই বিষয়টি আমার কাছে বড় মর্মপীড়ার। আমি আমার নিজস্ব অভিনয় জীবনে এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। বহুব্রীহির মামাকে মনে পড়ে? অথবা আজ রবিবারের বড় চাচা কে?? চোখ বুঁজে চিন্তা করুন পাঠক তাহলে অনুধাবন করবেন যে এ দুটো চরিত্রেই সব কিছুকে ছাপিয়ে অভিনেতাটি প্রধান হয়ে ওঠে। মামা কিংবা বড় চাচা’য় আমার কাজ ছিল খুব সহজ। এক ধরনের পাগলামির দ্বারা দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তাকে হাসানো। আমার বিশ্বাস যে এই কাজটি বোধহয় আমি বেশ ভালই করতে পেরেছিলাম। আমার নাট্যকার এবং অনুজপ্রতিম বন্ধু প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ সর্বদাই মিষ্টি হেসে আমার অভিনয় গ্রহণ করতেন। কিন্তু চরিত্র বিশ্লেষণ করে মামাকে বড় চাচা থেকে অথবা বড় চাচাকে মামা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতা নিয়ে আমি কি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি? এটিই আমার প্রশ্ন। এ কথা সত্য যে এই দুই চরিত্রকে জনপ্রিয় এবং প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হুমায়ূন নানাবিধ অনুষঙ্গের আয়োজন রাখত। যেমন মামার তোতাপাখি কিংবা বড় চাচার কফিন? কিন্তু আখেরে অভিনয়ের বিষয়টা সেই একই থেকে যেত। প্রসঙ্গত আমি আমার বহুল আলোচিত মঞ্চ নাটকের তিনটি চরিত্র নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। চরিত্র তিনটি হলোÑ দেওয়ান গাজীর কিস্সার দেওয়ান গাজী, নুরলদীনের সারা জীবন এর নুরলদীন এবং গ্যালিলীও নাটকে গ্যালিলীও। এই তিনটি চরিত্র ছাড়াও আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মঞ্চ নাটকের একাধিক প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার, যেমন- ম্যাকবেথ নাটকে ম্যাকবেথ কিংবা টেম্পেস্ট নাটকে প্রসপেরো। কিন্তু এই চরিত্রগুলো আলোচনা করা থেকে আমি বিরত থাকলাম এই কারণে যে ওগুলোর নির্দেশনায় ছিলেন বহিরাগত পরিচালকরা। অতএব, একেবারে নিজস্ব ব্যাখ্যা করার সুযোগ খুব একটা ছিল না। দেওয়ান গাজীর কিস্সায় নির্দেশক আসাদুজ্জামান নূর অথবা গ্যালিলীও নাটকের নির্দেশক আতাউর রহমান আমাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। নুরলদীনের সারা জীবন নাটকে তো আমি নিজেই নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলাম। অতএব আমি নিশ্চিত এই লেখাটির ধারাবাহিকতায় এই নাটক তিনটি নিয়ে আমি হয়ত অন্যত্র আলোচনা করেছি অথবা বারান্তরে আবারও করব। তবুও এখনই এ বিষয়ে কিছু কথা আমার পাঠকদের সঙ্গে আমি ভাগ করে নিতে চাই। এই তিনটি নাটকের মধ্যে আমি সর্বপ্রথম অভিনয় করেছিলাম দেওয়ান গাজীর কিস্সায়। নূর আমাকে তখন বলেছিল যে ব্রেশটের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং হৃদয়গ্রাহী নাটকের এক বিশেষ চরিত্রের জন্য আমাকে সে নির্বাচিত করেছে। এমন একটি চরিত্র যেখানে আমি অভিনয় করে সত্যিকার আনন্দ পাব। নিঃসন্দেহে এক বিশাল চরিত্র ছিল সেটি। নূর এর ভাষায় এই চরিত্রটি, দেওয়ান গাজী, ছিল এক ঞরঃধহ-এর। নূর যখন এমত বলেছিল তখন আমি নিশ্চিত যে এই চরিত্রের মহাপ্রতাপ সম্বন্ধে ভেবে নিয়েই ও ঞরঃধহ শব্দটিব্যবহার করেছিল কিন্তু আমার মতো এক অপরিপক্ক তরুণ অভিনেতার জন্য সেটাই কাল হয়েছিল। আমি সংলাপ কিংবা পরিস্থিতির পর্যলোচনা না করেই অভিনয় শুরু করে দিয়েছিলাম। অথচ নূর এমনভাবে সংলাপগুলো লিখেছিল যাতে সেগুলো যথাযথভাবে বুঝেশুনে বললেই ওই পরম পরাক্রমশালী গাজীর চরিত্রটি সত্যিকার অর্থে সুন্দর হয়ে উঠত, সত্য হয়ে উঠত। আজকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাজীর অভিনয় করলে আমি নিজেই বুঝতে পারি যে আমার অপঃরহম উবংরমহ কত অপরিণত ছিল। আজকে চেষ্টা করেও সেই আদিকালের অভিনয়ের নকশা-কে বদলাতে পারি না আমি। এই একটি সীমাবদ্ধতা আমার আছে। হয়ত অনেক অভিনেতারই আছে। একবার মনে গেঁথে গেলে সেখান থেকে বের হয়ে আসা বড় দুষ্কর হয়ে ওঠে। এছাড়াও আরেকটি ব্যাপার আছে সেটি হলো দর্শকের করতালির ব্যাপারটি। তাঁদের সমর্থন পাই বলেই হয়ত অভিনয়ের ধারা বদলাবার অনুপ্রেরণা কাজ করে না। নুরলদীনের সারা জীবন একটি অসাধারণ নাটক। এমন নাটকীয় সংঘাতময় ভাষা এবং কাব্যগুন বাঙলা নাটকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই নাটকেও আমি অকিঞ্চিৎকর অভিনয় করেছি বলে আমার ধারণা এখন। এই জন্য আবারও আমার অপরিণত চিন্তা-চেতনাকে দায়ী করা যায়। তার ওপরে আমাদের বাংলাদেশের প্রধান নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক-কেও আমার সীমাবদ্ধতার জন্য দায়ী করব। হক ভাই যে কোন নাটক আমাদের দেওয়ার আগেই নাগরিকের সকল সভ্যের সামনে বসে পাঠ করে শোনাতেন। কী অসাধারণ যে ছিল সেই পাঠ তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমি ভাল অভিনেতা হলে স্বভাবতই সেই পাঠ থেকে বের হয়ে আসতে পারতাম। তাতে করে নুরলদীন চরিত্রের সূক্ষ্ম নাটকীয়তাগুলোর প্রতি অনেক বেশি সুবিচার করা যেত। আসলে মোটা দাগের অভিনয় একজন সত্যিকারের একনিষ্ঠ অভিনেতার জন্যে সর্বৈব পরিত্যাজ্য। যদিও এটা স্বীকার করতেই হয় যে আমরা সবাই সাধারণত দর্শককে চমৎকৃত করার জন্য এক ধরনের চটুলতার আশ্রয় নিই যাতে অভিনয়ে সূক্ষ্মতা প্রচ-ভাবে ব্যাহত হয়। এই কথাগুলো আজকাল অহরহ আমার মনে আসে। কিন্তু এখন বড় দেরি হয়ে গেছে। তবু আমি বলব যে আমার অভিনয় জীবনে সবচেয়ে বেশি যে চরিত্রটির প্রতি আমি সুবিচার করতে পেরেছি বলে আমার মনে হয় সেটি হলো গ্যালিলীও। অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে ওই চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ আসে আমার জীবনে। সে কারনে বেশ ভাবনা চিন্তা করার অবকাশ ছিল। এবং বলতে দ্বিধা নেই যে আমার মতে আমার অভিনয় জীবনে সবচেয়ে সফল অভিনয় গ্যালিলীও নাটকে। একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এই নাটকে একেবারে শেষ দৃশ্যে এসে গ্যালিলীও তার বিদায়ী ছাত্র আন্দ্রিয়া সার্তি’কে বলে, ‘আমি বিজ্ঞানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। বিজ্ঞানের জগতে তার ক্ষমা নেই।’ গ্যালিলীও’র কন্যা তখন সবার অলক্ষ্যে এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। সে বলে, ‘ঠিকই করেছ। ধর্মে তোমার জায়গা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি আর কি চাও।’ মুহূর্তে বদলে যায় পরিস্থিতি। গ্যালিলীও একবারে হালকা স্বরে বলে, ‘ঠিক বলেছিস। দেখি কেমন রাঁধলি হাঁস। বড্ড ক্ষিদে লেগেছে।’ তারপর আন্দ্রিয়া’কে বলে, ‘খাওয়ার লোভ কিন্তু এখনও আমার আগেরমতই আছে।’ বলেই হো হো করে হাসে। এই যে সামান্য সময়ের মধ্যে একাধিক অভিব্যক্তি এবং সংলাপের সমাবেশ, এ নিয়ে স্থূলতা করার কোন জায়গাই নেই গ্যালিলীও নাটকে। আখেরে কেবল একটি কথাই বলতে চাই সুযোগ যদি আবার আসে তাহলে যথাযথ চিন্তা-ভাবনা এবং বিশ্লেষণ করে চরিত্র নির্মাণ করার চেষ্টা করে দেখব আরেকবার। (চলবে)
×