ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতুর ৬শ’ মিটার দৃশ্যমান ॥ বসে গেছে চতুর্থ স্প্যান

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৪ মে ২০১৮

পদ্মা সেতুর ৬শ’ মিটার দৃশ্যমান ॥ বসে গেছে চতুর্থ স্প্যান

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, জাজিরা থেকে ফিরে ॥ পদ্মা সেতুর ৪র্থ স্প্যান (সুপার স্ট্রাকচার) ‘৭ই’ পিলারের ওপর বসানো হয়েছে। এটি বসানোর ফলে সেতুর ছয় শ’ মিটার কাঠামো এখন দৃশ্যমান হলো। ৪০ ও ৪১ নম্বর খুঁটির ওপর রবিবার ভোর থেকেই শুরু হয় স্প্যান বসানোর আনুষঙ্গিক কাজ। সকাল ৮টার দিকে পিলারের ওপর স্প্যান বসিয়ে দেয়া হয়। গ্রীষ্মের নির্মল সকালে এই স্প্যান বসে যাওয়ার ঐতিহাসিক ক্ষণটি ছিল অভূতপূর্ব। পিলারের স্প্যানটি বসে যাওয়ার পর এখন আনুষঙ্গিক কাজ চলমান রয়েছে। তবে ভাসমান ক্রেনবাহী জাহাজটি বিকেল ৩টায় মাওয়া প্রান্তে ফিরে এসেছে। বেলা ১২টার দিকে বৃষ্টি ও ঝড় দেখা দিলে কাজে কিছুটা বিঘœ ঘটে। তবে ঝড় থেমে যাওয়ার পর আবার কাজ চলমান হয়। এরই মধ্য দিয়ে সব প্রতিকূলতা সফলভাবে মোকাবেলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী উদ্যোগে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। প্রকৌশলী ও শ্রমিকেরা ক্রেনের সাহায্যে স্প্যানটি ৪০ ও ৪১ নম্বর খুঁটিতে স্থাপন করেন। খুঁটিতে বসানোর পর চলছে তৃতীয় স্প্যানের সঙ্গে নতুন স্প্যানটি জোড়া লাগানোর জন্য ওয়েল্ডিংয়ের কাজ। এর আগে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম এবং ৩৮ ও ৩৯ নম্বর খুঁটিতে দ্বিতীয়, ৩৯ ও ৪০ নম্বর খুঁটিতে তৃতীয় স্প্যান বসানো হয়েছিল। খুঁটির অবস্থান হচ্ছে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এলাকার পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীরসংলগ্ন এলাকায়। দেখা যায়, দুই খুঁটির মাঝে স্প্যানটি নোঙর করে রাখা হয়েছিল। ভোর থেকে স্প্যানটি বসানোর কাজ শুরু করেন প্রকৌশলী ও শ্রমিকেরা। স্প্যান বসানোর দৃশ্য দেখতে পদ্মা নদীর তীর জাজিরার নাওডোবায় বহু স্থানীয় মানুষ ভিড় করেন। তাদের মধ্যে অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস। সেখানে উপস্থিত চরের বাসিন্দা মনির মিয়া বলেন, ‘চোখের সামনে উইঠ্যা গেলে। দেখতে খুব আনন্দ পাইছি। শেখের বেটি অসাধ্যকে জয় কইরা এই সেতু বানাইয়া দিতাছে...। আর আশপাশেও চেহারাও সব বদলাইছে। আমাগো সুভাগ্য।’ জমিলা বেগম বলেন, ‘পদ্মায় ব্রিজতো হইতাছে, আবার এত্ত বড় যন্ত্র দিয়া কেমনে সব কিছু করতাছে হেইডা দেখার ভাগ্য কম কিসে।’ পদ্মা সেতু প্রকল্পের দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানান, স্প্যানটি বসানোর পর এক প্রান্তে অর্থাৎ ৩য় স্প্যানের সঙ্গে ওয়েল্ডিং হচ্ছে। আর অপর প্রান্ত আগলে রেখেছে বিশেষভাবে তৈরি লিফটিং ফ্রেম। প্রাথমিকভাবে স্প্যানটি সেট হওয়ার পর ভাসমান ক্রেনটি স্প্যান খুলে রেখে মাওয়া প্রান্তে ফিরে আসে। এর আগে শনিবার সন্ধ্যায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও তিন হাজার ১৪০ টন ওজনের স্প্যান বহনকারী তিন হাজার ৬শ’ টন ধারণ ক্ষমতার জাহাজ ‘তিয়ান ই’ ক্রেনে পাজা করে ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলার মাঝামাঝি অবস্থানে পৌঁছায়। পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, স্প্যানটি পিলারের সামনে পজিশন অনুযায়ী আনা হয়। এরপর লিফটিং শুরু হয় সকাল ৭টার পরে। ৮টার দিকে অস্থায়ী বেয়ারিংয়ের ওপর রাখা হয় স্প্যানটিকে। এছাড়া স্প্যান ওঠানোর আগে ওয়েট টেস্ট, ট্রায়াল লোড টেস্ট, বেজ প্লেট, পাইল পজিশন, মেজারমেন্টসহ আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়। সাময়িক সময়ের জন্য নৌরুটে নৌযানগুলোর গতি কমিয়ে চলাচল করতে বলা হয়েছে। এরই মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। ‘৭এফ’ নম্বর ৫ম স্প্যান বসবে ৪১ ও সর্বশেষ ৪২ নম্বর পিয়ারের ওপর। পরবর্তীতে ‘১বি’ নম্বর ৬ষ্ঠ স্প্যান বসবে মাওয়া প্রান্তে বসবে ২ ও ৩ নম্বর খুঁটিতে। মাওয়া প্রান্তে একের পর এক আরও স্প্যান বসতে থাকবে। সেভাবেই চলছে সব আয়োজন। স্টিল স্ট্রাকচারের দ্বিতল পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। সেতুর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন আর উপর হবে সড়কপথ। সেতুর নির্মাণ শেষ হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সরাসরি যুক্ত হবে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিয়ারের ওপর বসে প্রথম স্প্যানটি। এরপর ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পিয়ারে দ্বিতীয় স্প্যানটি বসে। ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিয়ারের ওপর ১১ মার্চ বসে তৃতীয় স্প্যানটি। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে ৪২ পিলারের ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। পদ্মা বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো। এদিকে মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর কাজ ব্যাপকভাবে এগিয়ে চলেছে। তীরে দাঁড়িয়ে নদীর জাজিরা প্রান্তের দিকে তাকালে শুধু চোখে পড়বে সারি সারি পিলারের কাজের দৃশ্য। প্রতিটি পিলারে ভারি ভারি সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে দাঁড়িয়ে সেতুর দৃশ্যমান লাইন এখন চোখে পড়ে। মাটির বৈচিত্র্যতার কারণে অনেকের মাঝে পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা থাকলেও এটি সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট একজন প্রকৌশলী। তিনি বলেন, বৈচিত্র্যময় এই নদীতে কাজ করতে নানা রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু সমস্যার সমাধান করে এখন মাওয়া প্রান্তে কাজের ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। দিনরাত এখন হরদম মাওয়া প্রান্তেও কাজ চলছে। ইতোমধ্যে মাওয়া প্রান্তের ২ নম্বর খুঁটির কাজ শেষ হয়েছে। এটি এখন দৃশ্যমান। ৪ ও ৫ নং পিয়ারের ক্যাপিং কাজ প্রায় শেষ। ২-১ দিনের মধ্যে এটি ঢালাই হলেই পিলার দুটি দৃশ্যমান হবে। তাছাড়া অন্যান্য পিলারের কাজও এগিয়ে চলছে। মাওয়া প্রান্তে ৬, ৭ ও ৮ এই তিন পিলারে, পদ্মার মাঝের চরের ১০ ও ১১ নং এবং জাজিরা প্রান্তের ২৬, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১ ও ৩২ নং পিলারসহ মোট ১১টি পিলারের ডিজাইনে নতুন নক্সা চূড়ান্ত এখনও হাতে আসেনি। পরিবর্তিত ডিজাইন চূড়ান্ত কাজ চলছে। এই ১১টি খুঁটিতেই ৭টি করে পাইল বসবে। আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ এ ১১টি পিলারের চূড়ান্ত ডিজাইনের অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর পাশাপাশি স্প্যানের উপরের স্লাভ তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। কুমারভোগের বিশেষায়িত ওয়ার্কশপের উত্তর প্রান্তে চলছে এই কাজ। রেলওয়ের স্লাব তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। এছাড়া এখনও ট্রায়ালে রয়েছে রোডওয়ে ডেক্স স্লাব, যার ওপর দিয়ে বাস চলবে। ট্রায়াল রিপোর্ট পাওয়ার পরই শীঘ্রই এই রোডওয়ে ডেক্স স্লাব তৈরির কাজও শুরু হবে বলে দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। বর্ষার জানান দিচ্ছে প্রতি জোয়ারেই পদ্মায় পানি বাড়ার মধ্য দিয়ে। বর্ষার ভরা যৌবন আসবে জুনে। তবে পদ্মা বেশি উত্তাল হওয়ার আগেই অনেক কাজ এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চলছে। নদী শাসন নিয়ে জাজিরা প্রান্তে কাজের ব্যবস্থা বেশি। তবে মাওয়া প্রান্তে এখন পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত রয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
×