ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাওয়াই মিঠাই

ঘুণ্টির টুংটাং শব্দ- ফেরি ওয়ালার লম্বা হাঁক, মুখে পুরতেই হাওয়া...

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১২ মে ২০১৮

ঘুণ্টির টুংটাং শব্দ- ফেরি ওয়ালার লম্বা হাঁক, মুখে পুরতেই হাওয়া...

সমুদ্র হক ॥ মেঘের মতো মিঠাই। মুখে ভরতেই হাওয়া। টেরই পাওয়া যায় না। মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। এর নাম হাওয়াই মিঠাই। দেখতে অনেকটা টিস্যু পেপারের মতো। খাওয়ার চেয়ে দেখার আনন্দই বেশি। বাঙালীর গ্রামীণ ঐতিহ্যের এমন মিঠাই হালে কম দেখা যায়। শহর-নগরে দেখা মেলে কালেভদ্রে। দেখা মেলে উৎসব, পার্বণে, কোনও দিবসে, কোনও মেলায়। এরপর মিঠাইওয়ালারাই হাওয়া। তারপর- কখনও কোনও গ্রামে হাওয়াই মিঠাইওয়ালারা টুং টাং, টুং টাং শব্দে ঘুণ্টি বাজিয়ে ফেরি করে লম্বা হাঁক দেয় হা-ও-য়া-ই...মি—-ঠা—-ই। অমনি শিশু-কিশোররা ভোঁ দৌড়ে পৌঁছে যায় মিঠাইওয়ালার কাছে। কোনও মিঠাই সাদা, কোনওটি গোলাপি। এই মিঠাই শিশু-কিশোরদের প্রিয়। তবে তরুণ ও বয়স্করাও কম যান না। সুযোগে পেল তারাও মুখে পুরে মিঠাইয়ের হাওয়াই স্বাদ নেয়। একটা সময় এই হাওয়াই মিঠাইওয়ালাদের দেখা যেত দেশের প্রতিটি এলাকায়। কাঁচে ঘেরা কাঠের বাক্সের ভেতরে ফাঁপানো গোলাকৃতির মিঠাই ভরানো থাকত। বর্তমানে কাঁচের বাক্সের পাশাপাশি খড় দিয়ে বাঁশ মুড়িয়ে তার ওপর কাঠির সঙ্গে খ- খ- মেঘের মতো মিঠাই সাজানো থাকে পলিথিনে মুড়িয়ে। হাওয়াই মিঠাইওয়ালারা এখন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা হয়ে ঘুরে বেড়ায় গ্রাম ও নগরীর পথে। তবে সব সময় নয়। উৎসব, পার্বণে, মেলায় এবং বিভিন্ন দিবসে এরা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়। ক্রেতা আকর্ষণের জন্য এরা ঘুণ্টি বাজায়। কাঁসার তৈরি এই ঘুণ্টির শব্দেই বোঝে নেয়া যায় হাওয়াই মিঠাইওয়ালা আশপাশেই আছে। সাধারণত তেঁতুল, আমড়া, জলপাই আচার ও টক জাতীয় খাবার দেখে জিহ্বায় জল আসে। হাওয়াই মিঠাই দেখার সঙ্গে সঙ্গেও যে এমন হয় তা মিঠাইওয়ালাদের না দেখলে বোঝা যাবে না। মিঠাইওয়ালারাও তা-ই বলে থাকেন। হাওয়াই মিঠাই একটি মিষ্টি জাতীয় খাবার। এর বড় পরিচিতি; এটি বেশ প্রাচীন। উপমহাদেশে প্রথম এমন খাবারের সন্ধান মেলে মুঘলদের আমলে। মুঘলরা খাবারের বিষয়ে ছিল খুবই সৌখিন। তারা নানা পদের খাবারের মধ্যে নতুন আরও কী কী বানানো যায় তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত। এর মধ্যে চলে আসে হাওয়াই মিঠাই। মিষ্টির আরেক ইতিহাস থেকে জানা যায়, আর্য, মৌর্য, পাল যুগেও এমন মিষ্টির উদ্ভব হয়। খাওয়াদাওয়ায় তারাও ছিল সৌখিন। মিষ্টিও তাদের প্রিয় ছিল। এই মিঠাইয়ের বড় বৈশিষ্ট্যÑ এটি বানানো হয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় চিনিকে গুলিয়ে তাপ দিয়ে ডিঅক্সিডাইজ করার পর যে ঘন হাওয়া বের হয় তাই কমপ্রেস করে ধরে রাখা হয় কোন পাত্রে। মনে হবে যেন খ- খ- মেঘ। তাকেই সাজানো হয় গোলাকৃতি করে। দেখতে অনেকটা টিস্যু পেপারের মতো। হাওয়াই মিঠাই এতটাই দৃষ্টিনন্দন যে দেখলে ঘরের ড্রইং রুমে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করবে। এমনই এক হাওয়াই মিঠাইওয়ালার সন্ধান পাওয়া গেল বগুড়ায়। তার নাম হোসেন মিয়া। বয়স ৫৮ পেরিয়েছে। তারুণ্যের বেলায় বাবার হাত ধরে হাওয়াই মিঠাইয়ের পথে এসেছেন। তার বাড়ি শাজাহানপুর উপজেলার পালাল গ্রামে। ওই গ্রামে কয়েকটি পরিবার আছে যারা হাওয়াই মিঠাই বানায়। হোসেন মিয়া প্রায় ২৫ বছর আগে ৪শ’ টাকার একটি হাতে চালিত মেশিন কেনেন। এই মেশিনে হাতে ঘূর্ণনের চাকায় মিঠাই তৈরি করতেন। ১শ’ ৩০ টাকায় তাকে একটি ঘুণ্টিও কিনতে হয়। বললেন, হাওয়াই মিঠাইওয়ালার বড় পরিচিতি এই ঘুণ্টি। ঘুণ্টির শব্দই যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের শব্দ। সেদিনের চার শ’ টাকার মেশিনের দাম বর্তমানে চার হাজার টাকা। ব্যাটারি ও বিদ্যুতে চালানো যায়। ঘুণ্টির দামও বেড়ে হয়েছে ৭শ’ টাকা। ঘুণ্টি বাজিয়ে হাওয়াই মিঠাই জানান দেয় ফাস্টফুডের আগ্রাসনে তারা টিকে আছে কোনরকমে।
×