ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যে কারণে রক্ত ঝরছে পাহাড়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৫ মে ২০১৮

যে কারণে রক্ত ঝরছে পাহাড়ে

মোয়াজ্জেমুল হক/জীতেন বড়ুয়া/মোহাম্মদ আলী ॥ চারভাগে বিভক্ত পাহাড়ের দুই সংগঠন জনসংহতি সমিতি ( জেএসএস) ও ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। বর্তমানে রাঙ্গামাটির গহন অরণ্যে নানিয়ারচরে সশস্ত্র সহিংসতায় গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার রক্তের হোলিখেলার জন্ম দিয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে সংগঠন দুটির তিন গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, অস্ত্র ভা-ারের ভাগবাটোয়ারা ও চাঁদাবাজির একক নিয়ন্ত্রণ বিস্তারের চেষ্টা। মূলত এ তিন কারণেই পাহাড় আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে। ঝরছে রক্ত, ঘটছে প্রাণহানি। গত বৃহস্পতিবার নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস (এমএন লারমা-গণতান্ত্রিক) নেতা শক্তিমান চাকমা ও শুক্রবার ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপের আহ্বায়ক তপন জ্যোতি ওরফে বর্মন চাকমাসহ ৫ জন ব্রাশফায়ারে প্রাণ হারিয়েছে। দুদিনে আহত হয়েছে ১০। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, পাহাড়ের বিভিন্নস্থানে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি রয়েছে। জেএসএস (এমএন-লারমা), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও ইউপিডিএফের (প্রসিত গ্রুপ) ত্রিমুখী সংঘর্ষে গত একমাসে ১৫ নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছে। এদের অস্ত্রের ঝনঝনানি, আধিপত্য বিস্তারের লড়াই ও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ সাধারণ পাহাড়বাসী ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থেকে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু খাগড়াছড়িতে পরস্পরবিরোধী এসব সংগঠনের রোষানালে ২৫ গ্রামে ৪৫ পরিবারের তিন শতাধিক লোক ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে এখন উদ্বাস্তু। অনেকে নিজ বাড়ি থেকে পালিয়েছেন এক কাপড়ে। বহু শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন অনিশ্চয়তার কবলে পড়েছে। এদের পাল্টাপাল্টি হামলা, বাড়িঘর ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকা-ে নিখোঁজ রয়েছে অনেকে। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকলেও সহিংসতা কমছে না। সূত্র মতে, ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর লুপ্ত শান্তি বাহিনীর কাছে থাকা শতভাগ অস্ত্র সমর্পিত না হওয়া এবং পার্বত্য সংলগ্ন অরক্ষিত সীমান্তজুড়ে অবৈধ অস্ত্রের আদান-প্রদান সহিংসতার মূল উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর জনসংহতি সমিতি থেকে বেরিয়ে যায় প্রসিত খিসার নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ। যারা অস্ত্র জমা দেয়নি। এছাড়া সরকারের সঙ্গে জেএসএসের শান্তি চুক্তিকে তারা মানে না। পরবর্তীতে প্রসিত খিসার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট। তারা নিজেদের জেএসএসের কর্মকা-ের বিরোধী এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল হিসেবেও প্রতিষ্ঠার তৎপরতায় লিপ্ত। শান্তি চুক্তির দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এই দু’গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারে ফাটল ধরে। জনসংহতি সমিতি দুভাগে বিভক্ত হয়। এরপর ইউপিডিএফও দ্বিখ-িত হয়ে যায়। মূল জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে এখনও আছেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। আর ইউপিডিএফের মূল নেতৃত্বে রয়েছেন এক সময়ের তারই সহযোগী প্রসিত খিসা। পরবর্তীতে বিভক্ত গ্রুপগুলোর কর্মকা- হয়ে যায় আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিতে। বর্তমানে ইউপিডিএফের দু’গ্রুপের মধ্যে যে প্রাণঘাতী সংঘাত শুরু হয়েছে তারমধ্যে নিহিত রয়েছে অস্ত্রভা-ারের ভাগ বাঁটোয়ারা। ফলে প্রতিদিন বাড়ছে প্রাণঘাতী সংঘাত। নবসৃষ্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সংগঠনটির পক্ষে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়া হয়েছে। দলটির সদস্য সচিব জালিআ চাকমা (তরু) প্রসিত খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের কাছে সহ¯্রাধিক অবৈধ ভারি অস্ত্রের মজুদ রয়েছে বলে দাবি করেছেন। তবে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের পক্ষে বিষয়টিকে মিথ্যাচার বলে দাবি করেছেন নেতা মাইকেল চাকমা। শান্তি চুক্তির দুই দশক পরও পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি ভ্রাতৃঘাতী লড়াই, প্রাণহানির ঘটনা কোনভাবেই থামছে না। ২০১৭ সালে এক বছরে শুধু খাগড়াছড়িতে অস্ত্র উদ্ধারের মামলা হয়েছে ২৪টি। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিন দফায় অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। নিজেদের মধ্যে আদিপত্য বিস্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পাহাড়ী সংগঠনগুলো এখন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপে পরিণত হয়ে আছে। ফলে পরস্পরবিরোধী হিংসা, হানাহানি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য সৃষ্টির পাশাপাশি চাঁদাবাজিও অব্যাহত রেখেছে। তবে জেএসএসের (শন্তু লারমা) তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজিব চাকমা দাবি করেছেন, পার্বত্য চুক্তি অদ্যাবধি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ ধরনের হানাহানির বিস্তৃতি ঘটছে। অপরদিকে, ইউপিডিএফ নেতা নিরঞ্জন চাকমা জানিয়েছেন, পাহাড়ে এ সমস্যা রাজনৈতিক। আর ভ্রাতৃঘাতী ঘটনার জন্য দায়ী শন্তু লারমা। তারা শন্তু লারমাকে সরকারের এজেন্ট মনে করে থাকে। তাদের মতে, সরকার পক্ষ শন্তু লারমাকে হাতে নিয়ে এসব কর্মকা- করাচ্ছে। অপরদিকে, খাগড়াছড়ি পুলিশের মতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অরক্ষিত সীমান্ত পথ দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে অবৈধ অস্ত্রের চালান আসছে। ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকার সীমান্ত অরক্ষিত। ফলে উভয় অংশের সন্ত্রাসীদের মধ্যে অর্থের বিনিময়ে অস্ত্রের আদান-প্রদান ঘটে থাকে। সূত্র মতে, গত বছরের ১৬ নবেম্বর খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের একটি সম্মেলনে প্রসিত গ্রুপের সঙ্গে তপন জ্যোতি চাকমার মতবিরোধ হয়। ঐদিনই তপন জ্যোতি চাকমা ইউপিডিএফ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নাম দিয়ে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটিতে তপন চাকমাকে আহ্বায়ক ও জালিআ চাকমাকে সদস্য সচিব করা হয়। এ ঘটনার পর থেকেই দু’গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হানাহানির সূত্রপাত হয়। ইউপিডিএফের দু’গ্রুপ সৃষ্টির একমাসের মধ্যে নানিয়ারচর আঠারমাইল এলাকায় এ দলের সন্ত্রাসীদের হাতে প্রথম হত্যার শিকার হন নানিয়ারচরের ইউপি সদস্য অনাদিরঞ্জন চাকমা। গত ক’মাসে ইউপিডিএফের দু’গ্রুপের হানাহানিতে পাঁচ জনের প্রাণহানির রেকর্ড রয়েছে। এছাড়া নানিয়ারচর উপজেলায়ও সন্ত্রাসী গ্রুপের ভয়ে কয়েক শ’ পরিবার এখন ঘরছাড়া। এ গ্রুপের আওতায় খাগড়াছড়ির প্রাণছড়ি, দীঘিনালা, মহালছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি ও নানিয়ারচর উপজেলা রীতিমতো জিম্মি হয়ে আছে। এ পাঁচ উপজেলায় সাম্প্রতিক ১২ জন প্রাণ হারিয়েছে। অপহৃত হয়েছে ১২ জনেরও বেশি। সর্বশেষ সহিংসতার বলি হলেন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমা। শক্তিমান চাকমাকে হত্যার জন্য ইউপিডিএফকে (প্রসিত গ্রুপ) দায়ী করা হয়েছে। ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) মিডিয়া উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত লিটন চাকমা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শক্তিমান চাকমাকে হত্যার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তপন জ্যোতি চাকমাকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাহাড়ে তারা একক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর। ফলে তারা একের পর এক হত্যাকা- ঘটিয়ে চলেছে। পাহাড়ে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সহিংসতার দুই দশকে সাত শতাধিক নেতাকর্মীর প্রাণহানির রেকর্ড রয়েছে। এর আগে জেএসএস (এমএন-লারমা) গ্রুপের ছাত্রনেতা সুদীর্ঘ চাকমা, চলতি বছরের শুরুতে ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমাকে হত্যার পর গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার শীর্ষপর্যায়ের নেতাসহ আরও ৫ জনের প্রাণ ঝরে গেল। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, জেএসএস ও ইউপিডিএফের পৃথকভাবে চার গ্রুপ পাহাড়বাসীর দাবি আদায়ের নামে বিভিন্ন আন্দোলন চালানোর ব্যানারে মূলত আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবািজর পথেই নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। এক্ষেত্রে পাহাড়বাসীর দাবি আদায়ের চেয়ে খুন, গুম, অপহরণজাতীয় ঘটনা দিন দিন ব্যাপকতর হচ্ছে। শান্তি চুক্তির শর্তগুলো বাস্তবায়নে সরকার যতই উদ্যোগী হচ্ছে পাহাড়জুড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো ততই সহিংসতার পথে এগোচ্ছে। ফলে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালীদের পাশাপাশি পাহাড়ীরাও সমভাবে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নিপতিত।
×