ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৪:০২, ৫ মে ২০১৮

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

(গতকালের পর) অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ বায়ুদূষণের সঙ্গে আবহাওয়ার অস্থির আচরণের সম্পর্ক স্পষ্ট। বৈরি আবহাওয়া, বৃষ্টি-বন্যার অদ্ভুত আচরণে ফসলহানি, উন্নয়নের অর্জনগুলোর হুমকির মুখে পড়া আমাদের নিয়তির মতো সঙ্গী। দেশব্যাপী বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে সৃষ্ট ধুলা-বালি এবং তা সামলানোর কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় নাগরিক জীবন বিষময় হয়ে উঠেছে। বোস্টনভিত্তিক হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি ২০১৭ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার স্থান দ্বিতীয়; প্রথমে রয়েছে দিল্লী। বায়ুদূষণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যায় (দ্য ডেইলি স্টার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। প্রধানত ছোট ছোট কণা, যার বৈজ্ঞানিক সংকেত পিএম ২ দশমিক ৫ এবং মোটা ধূলিকণা, যার বৈজ্ঞানিক সংকেত পিএম ১০ বেশি থাকার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামের বিশুদ্ধ বাতাসের মান নেমে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ধূলিকণা মানবদেহের ভেতরে ঢুকে ফুসফুসে গেঁথে থাকে এবং একনাগাড়ে এসব উপাদানের ভেতর দিয়ে চলাচল করলে হৃদরোগ, হাঁপানি ও ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা। উদীয়মান অর্থনীতির এই দেশে সুস্থ জনবল তৈরি একটি অপরিহার্য কাজ। বায়ুদূষণের কারণে শুধু যে মানুষের কর্মক্ষমতা কমছে তা নয়, জীবনও হচ্ছে হুমকিগ্রস্ত। পরিবেশ রক্ষার প্রতি উদাসীনতা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। পরিবেশ তো বিমূর্ত কোন বিষয় নয়। আমাদের চারপাশই আমাদের পরিবেশ। তা আক্রান্ত হলে আমরাও আক্রান্ত হব। রাস্তার ধুলা তো শুধু রাস্তায় থাকছে না, তা আমাদের ফুসফুস, মস্তিষ্ককেও আক্রান্ত করছে। তবু কেন আমরা এ ব্যাপারে আরও সচেতন হচ্ছি না? ক্যাটালাইজিং ক্লিন এনার্জির আওতায় জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উন্নয়ন প্রসারের মাধ্যমে রান্নার চুলা সরবরাহ, যা কালো কার্বন কমায় এবং অভ্যন্তরীণ বায়ুুদূষণে জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব কমিয়ে আনে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে সম্ভাব্য বন্যা মোকাবেলায় নিচু জমির চারপাশে বাঁধ দিতে হবে যা বন্যা থেকে কৃষিজমি, বাড়িঘর ও অবকাঠামোকে রক্ষা করবে। তবে এর উপকারিতাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে বন্যার ধরনের ওপর নির্ভর করে। বন্যার পানি যদি ৩ মিটারের বেশি উচ্চতায় প্রবাহিত হয়, কিছু এলাকায় যা নিয়মিতভাবে ঘটে থাকে, তাহলে জমির বাঁধগুলোতে প্রায়ই ফাটল ধরে যায় এবং এটি কোন উপকারেই আসবে না। এসব বাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও এগুলো নির্মাণ করতে বাংলাদেশের খরচ হবে বিপুল পরিমান অর্থ। সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ নিশ্চিত করার জন্য এমন একটি সর্বজনীন সমাধান দরকার, যাতে এর অধিবাসীরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভালভাবে মোকাবেলা করতে পারে। ডেল্টা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি আবহাওয়ার ভিন্নতার কারণেই বিশ্বের দেশগুলোর ভৌগোলিক পরিবেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ ও প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন। ইউরোপের ছোট কিন্তু সমৃদ্ধশালী দেশ হল্যান্ডে একসময় সমুদ্রের লবণাক্ত পানির প্লাবনে দেশের বিশাল এলাকা তলিয়ে যেত। বছরের পর বছর কৃষি, শিল্প, অবকাঠামোসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গোটা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হতো। কিন্তু প্রকৃতির সৃষ্ট এই প্লাবণের কাছে আত্মসমর্পণ না করে কিংবা প্লাবনের ক্ষতি থেকে অর্থনীতি রক্ষার্থে কারও সাহায্য বা দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর না করে নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে ডেল্টা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি স্থানিক অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় নিয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বর্ষার প্লাবন থেকে রক্ষা এবং নিজেদের সৃষ্ট জলাধার থেকে শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। বর্ষা মৌসুমে প্লাবন, যা একসময় ছিল অভিশাপ। ডেল্টা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিনির্ভর প্রকল্প সেই প্লাবনের পানি আশীর্বাদে পরিণত করেছে। হল্যান্ডের এই ব্যতিক্রমধর্মী প্রযুক্তি শুধু দেশকে বর্ষার প্লাবন এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি স্বল্পতা থেকে মুক্তি দেয়নি, বিশ্বের অপরাপর দেশের জন্যও অনুরূপ সমস্যা সমাধানে পথ দেখিয়েছে। ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভের সংরক্ষণের পাশাপাশি পুনরায় বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে, যেটি পরিবেশকে কার্বনমুক্ত করার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে একটি প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করবে। ম্যানগ্রোভ ক্রমবর্ধমান জীববৈচিত্র্য, মাছের আবাসস্থল ও ইকোট্যুরিজম সুবিধাসহ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে। কিন্তু এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, কারণ এই ব্যবস্থায় প্রতিবছর প্রায় ৪০ কিলোমিটার উপকূলরেখায় ম্যানগ্রোভ সৃজন করতে হবে। সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণে পরবর্তী ৩০ বছরে প্রয়োজন হবে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। সব মিলিয়ে জলবায়ু সুরক্ষা ও পর্যটন উন্নয়নের পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের ফলে মানব সভ্যতা ও ক্রমবর্ধমান জীববৈচিত্র্যের কল্যাণ সাধন হবে। সামাজিক বনায়ন বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন উপশম ও অভিযোজন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও গ্রামীণ জনপদে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য-বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বন বিভাগ ১৯৬০ দশকের শুরুর দিকে বন সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বনায়ন কর্মসূচী বনাঞ্চলের বাইরে জনগণের কাছে নিয়ে যায়। বন বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়িত সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমের আওতায় ১৯৮১-১৯৮২ সাল হতে ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮৪,৩৭৮ হেক্টর এবং ৬৮,৮৩০ কিলোমিটার বাগান সৃজন করা হয়েছে। এছাড়া বিগত ৪ বছরে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের আওতাভুক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী, স্বল্পমেয়াদী ও নন-ম্যানগ্রোভ ২,৯৫৫ হেক্টর ব্লক বনায়ন এবং সড়ক, রেলপথ ও বাঁধ সংযোগ সড়কে ২,৬৪১ কি.মি. স্ট্রিপ বনায়ন করা হয়েছে। যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় সহায়ক হবে। পাহাড় নিধন সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ১৮ শতাংশ পাহাড়ী অঞ্চল যার সিংহভাগই বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থিত। উত্তর দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে বিস্তৃত প্রায় হাজার ফুট পর্যন্ত উচ্চতার এই সকল পাহাড়ী ভূমিরূপ চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য এক মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টির সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। অবাধ পাহাড় কাটার ফলে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র এবং ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমগ্র বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে যে কোন ধরনের পাহাড়-টিলা কাটা নিষিদ্ধ হলেও সারা বাংলাদেশে স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগসাজশে অবাধে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। ফলে চট্টগ্রাম গত তিন দশকের মধ্যে চরম পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এর অন্যতম কারণ নির্বিচারে পাহাড় কাটা। এই পাহাড় কাটা বন্ধ করা এবং পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধের সময় এসেছে। এ ছাড়া পাহাড় কাটার কারণে এবং পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনের কারণে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×