ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের শিক্ষাঙ্গনে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রীর প্রতি ছাত্রদের গড়পড়তা দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? ছেলেরা কি মেয়েদের বোন কিংবা বন্ধু হিসেবে দ্যাখে? নাকি কুৎসিত মন্তব্য, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি বা অন্য কোন ধরনের নিপীড়নমূলক আচরণের শিকার হতে হয় মেয়েদের? কোন বৈষম্য

সমাজ ভাবনা ॥ বিষয় ॥ সহপাঠিনীর প্রতি...

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ৩ মে ২০১৮

সমাজ ভাবনা ॥ বিষয় ॥ সহপাঠিনীর প্রতি...

যৌন হয়রানি! জাহিদুর রহমান ॥ বর্তমান বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আলোকিত মানুষ চাই। আলোকিত মানুষ হওয়ার প্রত্যাশায় আমরা বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে বিচরণ করি। একই শ্রেণীতে অধ্যয়নকারী শিক্ষার্থীকে সহপাঠী বলা হয়। সহপাঠী বন্ধুর মতো, পরিবারের বাইরে আরেক নতুন পরিবার। মা, বাবা, ভাই, বোনদের নিয়ে আমাদের পরিবার, অনুরূপভাবে সকল শিক্ষার্থী শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ে আমাদের শিক্ষা পরিবার। সেখানে সকলের সঙ্গে সুসম্পর্কের ফলে গড়ে ওঠে এক ভিন্ন জগৎ। এই জগতে বেশিরভাগ জায়গাজুড়ে থাকে সহপাঠী-সহপাঠিনী। বর্তমান শিক্ষাঙ্গনে মেলামেশার ক্ষেত্র খুব বেশি একটা পার্থক্য ও ছেলেমেয়েদের বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় না। সহপাঠী ও সহপাঠিনীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব বিরাজমান। তারা যথেষ্ট আন্তরিক তাদের সহপাঠিনীর ব্যাপারে। একসঙ্গে লেখাপড়া ও প্রযুক্তি আড্ডা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। একজন অন্য জনের পাশে থাকে ভাই বোনের মত। বিপদে আপদে পাশে থাকে ছায়ার মতো। সম্প্রতি একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি ও লাঞ্ছিতকরণের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনা জানাজানি হলে ওই সহপাঠিনীর পক্ষে সকল শিক্ষার্থী অবস্থান নেয়। রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেন। তীব্র আন্দোলনের ফলে পুলিশ তৎপর হয়ে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় স্টুডেন্ট পাওয়ার ও সহপাঠিনীর প্রতি তাদের সহমর্মিতা। হাজার হাজার ভালো মানুষের ভিড়ে কিছু দুষ্কৃতকারী থাকবেই। যারা ছাত্রত্বের দোহাই দিয়ে অছাত্রের মতো কাজ করে। সহপাঠিনীর প্রতি তাদের আচরণ ঘৃণিত। সহপাঠিনীকে বন্ধু বা বোন হিসেবে মানতে পারে না যার ফলে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। যা সত্যিই দুঃখজনক। কিছু লোকের বিকৃত মানসিকতার দায় সচেতন ছাত্রসমাজ নিবে না। দু’একজন ছাত্র বিকৃত মানসিকতার থাকতে পারে, তাকে অপমানের সুরে কথা না বলে বুঝাতে হবে, অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করতে হবে যাতে করে কোন অপ্রীতিকর ঘটনার উস্কানি যেন না হয়। নারী সবসময় সম্মানের। সেক্ষেত্রে সব সময় ভাবতে হবে আমার সহপাঠী আমার বন্ধু, আমার সহপাঠিনী আমার বোন। তবেই আমার দ্বারা আমার সহপাঠী ও সহপাঠিনী আমার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, লাঞ্ছিত হবে না। যা সমাজে এক ভারসাম্য সৃষ্টি করবে। এই মনোভাব পোষণ করতে হবে যে, আমার সহপাঠী-সহপাঠিনী একটি বৃহত্তর পরিবার। কাপাসিয়া, গাজীপুর থেকে . ছেলেবন্ধু বনাম মেয়েবন্ধু! লুফাইয়্যা শাম্মী ॥ বিশ্ববিদ্যালয় একটা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এখানে যারা আসে তারা নিজেদের মেধার শাণিত শ্রম দিয়ে আদায় করে নিজেদের অবস্থান। কিন্তু গড়পড়তা সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি মেয়েদের প্রতি তা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইসব সর্বোচ্চ মেধাবীদের মধ্যে বিরাজমান নয়? আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ের অসমতা খুব কাছ থেকে দেখে চলেছি প্রতিনিয়ত। এখানে একজন ছেলে তার মেয়েবন্ধুকে কখনও তার ছেলে বন্ধুর মতো করে দেখে না। ছেলেবন্ধুর সঙ্গে তার যে আচরণ তা অন্যরূপে প্রকাশ পায় মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে। এমনকি অনেক সময় একজন মেয়ে তার ছেলেবন্ধুর কাছে প্রতারিত হয় জায়গায় জায়গায়, যৌন হয়রানির শিকার হয়। এমনকি ক্লাসেও এরকম অসঙ্গতি দেখা যায়। মেয়েদের পোশাকের প্রতিও ছেলেদের কুরুচিসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। তারা মেয়েদের দিকে বিচ্ছিরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে শরীর মেপে নিয়ে নিজেদের মধ্যে কুৎসিত রসিকতা করে। এমনকি খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এমন মেয়ে বন্ধুকে নিয়েও ছেলেরা নিজেদের মধ্যে কুৎসিত ইঙ্গিতবহ মন্তব্য করে, হাসাহাসি করতে ছাড়ে না। আবার সুযোগ মতো কোন মেয়েবন্ধুকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে মেয়েটি অসম্মত হলে সেই মেয়ে সম্পর্কে ছেলেমহলে ছড়িয়ে যায় নানারকম অশ্লীল গালগল্প। যা কখনও মেয়েটির জন্যে ভাল হয় না। অদ্ভুত বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি ছেলেরা কোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও মেয়েদের মতামত নিতে চায় না। সমাজের মোড়ল যেমন নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চায় সমাজের ওপর, তেমনি নিজেদের সিদ্ধান্ত জোর করে চাপানোর চেষ্টা করে থাকে ছেলেরা। এমন কি কোন মেয়ে যদি এতে প্রতিবাদসূচক কোন মত দেয় তবে সকল ছেলেরা তার বিপক্ষে চলে যায়, এমনকি অনেক সময় ভয়ও দেখানো হয়। এসব দেখলে মনে হয় ছেলেমেয়ের এই বৈষম্য যেন শিকড় গজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমাজে, যার থেকে মুক্তি পায়নি সর্বোচ্চ শিক্ষাপীঠও। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে কিছুক্ষেত্রে। অনেক ছেলেবন্ধুই মেয়েদের প্রতি বন্ধুসুলভ এবং সাহায্যপরায়ণ। তারা মেয়েদের সঙ্গে শুধু মেয়েসুলভ আচরণই করে না, বন্ধুসুলভ, কখনও ভাইসুলভ আচরণও করে। কিন্তু সংখ্যা এত কম যে নিজের ক্যাম্পাসে যে কোন মেয়ে একা হাঁটতে গিয়েও অশ্লীল আচরণের শিকার হয়, ভয় পায় রাতে একা হলে ফিরে আসতে, কিংবা কোনো গন্তব্যে যেতে। সমাজ পরিবর্তনের দায়িত্ব বর্তায় ছাত্রসমাজের ওপর। ছাত্র বলতে এখানে শুধু ছেলে শিক্ষার্থীকেই বুঝায় না। ছেলে-মেয়ে সকলকে নিয়েই গোটা ছাত্রসমাজ। ছেলেরা যদি মেয়েদের শুধু নারীর চোখে না দেখে বন্ধু কিংবা বোনের চোখে দেখতে শুরু করে তবেই পরিবর্তিত হতে পারে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে নারীরা পদে পদে লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়ে থাকবে না। যেখানে চলন্ত বাসে কোন নারী ধর্ষণের শিকার হবে না, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায়, কিংবা ঘরে কোন নারী অপমানিত হবে না। চাই মানসিকতার পরিবর্তন আমার বন্ধুদের। চাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আমার বন্ধু, বড়ভাইদের থেকেই আসুক পরিবর্তনের সূচনা। তাদের দৃষ্টিতে আমি শুধু একজন মেয়ে না হয়ে যেন বন্ধু কিংবা বোন হই, চাই তাদের প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে . দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কার অমিত দাস ॥ বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুপ্রিয় সহপাঠী ও সহপাঠিনীদের সম্পর্কটি খুব একটা সংযত স্বস্তিকর নয়। তাদের পরস্পরের প্রতি অনেকের ব্যবহার কেবলমাত্র অশ্লীল ও অপ্রীতিকর নয়, অনেকাংশে অস্বস্তিকর এবং বিপজ্জনক। মেয়ের মর্যাদাহানিতে ছাত্রীদের মা-বাবাদের যে কত মানসিক টেনশন তা কে না জানে? স্কুল-কলেজে ছাত্রীদের প্রতি ছাত্রদের আচরণ আনন্দদান কওে না। জীবনে ষোলোটি বছর বিভিন্ন বিদ্যালয়ে, এখন কলেজে ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে কাটালাম। আদরের মেয়েটিকে স্কুল কলেজে পাঠিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত ভালয় ভালয় মেয়েটি বাড়ি ফিরে না আসে মা-বাবা বেশ দুশ্চিন্তা করেন। মাঝে মাঝে দেখি স্কুলে যাওয়া মেয়েটির সঙ্গে একজন মুরব্বি গোছের লোক যায়। সমাজের এ হেন দুরবস্থায় মা-বাবারা বেশ বিরক্ত ও বিব্রত। দেখতে পাই বিকালে বিদ্যালয় ছুটির পর ছাত্রীরা বাড়ি যাওয়ার পথে সহপাঠীরুপী ছাত্ররা শিস দেয়; কোন ছাত্রী কার কাল্পনিক বউ কার ভাবী বলাবলিসহ বিভিন্ন বাজে মন্তব্য করে, হাতে গোলাপফুল গুজে দিতে আসে। যে ছাত্র বীজগাণিতিক রাশির প্লাস মাইনাস বুঝে না সেও তার ক্লাসের তার পছন্দের সহপাঠিনীর নাম প্লাস চিহ্ন দিয়ে লাল ইটের সুড়কির টুকরা দিয়ে কিংবা কচুপাতা, কয়লা দিয়ে চুনকাম করা সাদা দেওয়ালে লিখে রাখে কিংবা চক দিয়ে অনেক সময় ব্ল্যাকবোর্ডে বেঞ্চিতে পেন্সিল দিয়ে কলমের কালিতে লিখে রাখে। যে ছেলে টেন্স বুঝে না সেও ‘আই লাভ ইউ’ বলে ক্লাসরুম বা কলেজের টয়লেট বাথরুমে নিজের মোবাইল নম্বরসহ দেওয়ালে লিখে রাখে ‘আমাকে প্লিজ কল করো’। এই হলো সহপাঠীরুপী বেয়াদব ছাত্রদের তাদের সহপাঠিনীর প্রতি ভালোবাসা নামক বদ-বুদ্ধির বিজ্ঞাপন। এই যে আমি শিক্ষক হয়ে আমার ছাত্রদের চরিত্রে সুনীতি সুগুণাবলীর সুসভ্য জীবনসংস্কৃতির সংযোজন ঘটাতে পারিনি এই দায় আমার আর আমার মতো আরও অনেকের। এই দায় গোটা সমাজের। আমাদের সন্তানদের সুস্থ সামাজিক মূল্যবোধে গড়ে তুলতে পারছি না। আমাদের সমাজ তাদের আচরণশিক্ষার কাজটি সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে আজ ব্যর্থ। তবে সব ছাত্রদের ঢালাওভাবে এই দুশ্চরিত্রের সনদপত্র দেওয়া অবশ্যই সমীচীন হবে না। সবাই তো আর নষ্ট ছেলে নয়, ভাল ছেলের নজিরও নিহায়েত কম নয় এদেশে। আমরাও সহপাঠিনী হিসেবে পেয়েছি যাদের, তাদের সঙ্গে একসঙ্গে পাহাড়ী ক্যাম্পাসে ঘুরেছি, লেডিস হলের সবুজ ঘাসের ওপর কিংবা জারুলতলায় বসেছি। কই কোনদিন তো তাদের দিকে নারী হিসেবে আলাদা কুনজর দিইনি। তাদেরকে অনেক সময় মেয়েও মনে হয়নি, কেবল মনে হয়েছে একজন মানুষ। এই মানসিকতাই আমাদের বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রদের মাঝে বেশ অভাব। তাই মানসিকতার সংস্কার সাধনই হবে এই মারাত্মক সমস্যা সমাধানের মোক্ষম ওষুধ। চন্দ্রনাথ ডিগ্রী কলেজ, নেত্রকোনা থেকে . চাই পারিবারিক সুশিক্ষা এমএইচ উল্লাহ ॥ ইংরেজীতে একটি কথা আছে ‘চ্যারিটি বিগিন্স এট হোম’ যার বাংলা অর্থ আপন ঘর থেকেই শুভ কাজের সূচনা হয়। শৈশব, বাল্য ও কৈশরে যে শিক্ষা লাভ করা হয় সেই শিক্ষাই বাকি জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে। ঘরে সুশিক্ষা না পেলে বাইরে গিয়ে সুশিক্ষা লাভ করা বড়ই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় ঘরের কুশিক্ষাই বাকি জীবনের সম্বল হয়ে থাকে। শিক্ষাঙ্গনে অর্থাৎ স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রীর প্রতি আরেকজন ছাত্রের আচার আচরণ কি হওয়া উচিত সেটা বাল্য শিক্ষা-ই শিখিয়ে দেয়। ঘরে ভাই বোন যেভাবে মেলামেশা করে শিক্ষাঙ্গনেও আচার-আচরণে তা পরিস্ফুট হওয়া উচিত। কিন্তু ব্যাতিক্রমধর্মী কার্যক্রম শিক্ষাঙ্গনে লক্ষ্য করা যায় না এমন কথা দিব্যি দিয়ে বলা যাবে না। তাই তো সমালোচনা হয় শিক্ষাঙ্গনে সতীর্থদের কার্যক্রম নিয়ে। একজন সহপাঠিনীর প্রতি অপর একজন সতীর্থের আচার ব্যবহার কি হওয়া উচিত তার উত্তরে বলা যায় নিঃসন্দেহে ভাল আচরণই আশা করা যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, সব সময় এ রকম হয় না। ‘ইভটিজিং’ এর কুফল সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি জানি। স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও এ সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। সময় এসেছে গভীরভাবে ভেবে দেখার কিভাবে ‘ইভটিজিং’ এর হাত থেকে রক্ষা করা যায়। যারা ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করছে প্রাথমিকভাবে তাদের সতর্ক করা যায়-তারপরেও যদি তারা এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত না হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। সব ছাত্রই যে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই- যখন দেখা যায় এই সহপাঠিরাই বাসে ছাত্রী নিগ্রহের জন্য মানববন্ধন করেছে। কূপম-ূকতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা আজ বিদ্যমান, যদিও ৫০ বছর কিংবা তার কিছু আগেই এদেশে সহশিক্ষার ব্যবস্থা তেমন ছিল না বললেই চলে। যখন দিন বদলিয়েছে আর বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে চলছে তখন সহশিক্ষার কোন বিকল্প নেই, তার মানে এই নয় যে, একত্রে পড়াশোনা করছে বলেই সহপাঠিনীদের সঙ্গে অশ্লীল আচার-আচরণ করতে হবে, আর সেটা কাম্যও নয়। কলাবাগান, ঢাকা থেকে . বন্ধুত্বসুলভ আচরণ সাগর কোড়াইয়া ॥ শিক্ষাঙ্গন একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত মানুষ করে গড়ে তোলে। এই শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তকের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়। তাই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার শিক্ষার অধিকার রয়েছে। শিক্ষাঙ্গন মনের মধ্যে রোপণ করে দেয় মানুষ হিসেবে কিভাবে সকল ভালোর উৎসধারা হওয়া যায় সেই বীজ। সন্মুখপানে উন্মোচিত করে দেয় জানার নব নব অধ্যায়। মানুষকে কোন শ্রেণীভেদে না ফেলে বরং মানুষ হিসেবে দেখার মন তৈরি করে দেয় শিক্ষালয়। আবার শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে মন থেকে নেতিবাচক চিন্তা-চেতনা দূর করে যা সত্য-সুন্দর তা আঁকড়ে ধরতে সাহায্য করা। ছাত্রছাত্রীবিহীন যেমন শিক্ষাঙ্গন গড়ে উঠতে পারে না তেমনি সুষ্ঠু শিক্ষার স্পর্শ ছাড়া ছাত্রছাত্রীর মনের দুয়ার বিস্তৃত হতে পারে না। শিক্ষাঙ্গন ছাত্রছাত্রীদের কলকাকলিতে ভরে উঠবে; একসঙ্গে তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে- এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষালাভের পাশাপাশি নানাবিধ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিদ্যা-বুদ্ধিকে শাণিত করে বিদ্যালয় তথা দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে সেটা সকলে প্রত্যাশা করে। কে ছেলে আর কে মেয়ে- এই বিভাজনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে সবাই শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে- এটাই শিক্ষালয়ের আসল শিক্ষা। কিন্তু বতর্মানে এই চিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। দেশের অনেক শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের দ্বারা ছাত্রীদের নিগৃহীত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে জানা যায়। যেখানে ছাত্রছাত্রীরা বন্ধু ও ভাইবোনের মতো পাশাপাশি অবস্থান করে শিক্ষার্জন করবে সেখানে অনেক সময় দেশের কোথাও শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রীদের প্রতি ছাত্রদের কুদৃষ্টি, নিপীড়নমূলক আচরণ, অশ্লীল মন্তব্য ও মানসিক অত্যাচার সহপাঠিনীকে শিক্ষাঙ্গন ত্যাগ করতে বাধ্য করে। অনেক সময় মেয়ে সন্তানকে এই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষার জন্য পিতামাতা ও অভিভাবকগণ বয়স হওয়ার আগেই পড়াশোনা ছাড়িয়ে বিয়ে দেবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। যা কখনও কাম্য হতে পারে না। এতসব নিপীড়নের পর আবার সহপাঠিনীকেই যত কথা শুনতে হয়। কেন সহপাঠিনী নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারে না; কিই বা দরকার ছিল ছাত্রদের সঙ্গে মেশার, টিফিনে ক্লাসের বাইরে না গেলেই হয়; সহপাঠিনীর ইশারাতেই সব ঘটেছে- এরকম আরও বহু কথামালা। কিন্তু বাস্তবতা যে কি সেটা সহজে কেউ বুঝতে চায় না। এই সময়গুলোতে প্রতিনিয়ত পরিবার ও শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রীরা বৈষম্য বা বিভেদের সন্মুখীন হয়। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের জন্য যে সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে তা ছাত্রীদের জন্য অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ছাত্ররা অপরাধ করলেও নানাবিধ কারণে পাড় পেয়ে যায় কিন্তু সেক্ষেত্রে ছাত্রীদের হতে হয় হয়রানির শিকার। তাই অধিকার আদায়ে ছাত্রীদের মিছিল-মিটিং করতে দেখা যায়। একই অর্থ ব্যয় করে ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এই বৈষম্যমূলক আচরণ আশা করা যায় না। বরং এই চিত্র সমাজের অবক্ষয়কেই প্রকাশ করে। বনানী, ঢাকা থেকে . কতটা দায়িত্বশীল? রিফাত কান্তি সেন ॥ মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতেই পছন্দ করে। সমাজে নারী-পুরুষ সকলে মিলেই গড়ে ওঠে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ একটি সম্পর্ক। সেই ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কে মাঝে মাঝে থাকে বিস্তর ফারাক। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম শিক্ষা। শিক্ষার্জন করতে ছেলেমেয়েরা ছুটে যায় স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদি ২ যুগ পেছনে ফিরে যাই তবে দেখবো সমাজে নারী পুরুষের অবাধ চলাচল এত সহজতর না হলেও ছিল না কুদৃষ্টি। ইদানীংকালে রাজধানীসহ দেশের প্রত্যান্তঞ্চলগুলো থেকে পত্রিকায় খবর আসে যে অমুক স্কুলের ছেলের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক কিংবা অমুক স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলের দ্বারা সে প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর কারণ কী? কেন এমনটা ঘটছে? একজন মেয়ে সহপাঠীকে কেন বোনের চোখে দেখতে পারছে না ছেলে সহপাঠীরা? আবার এর উলটোও দেখতে পাই। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এখন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে লেখাপড়া করছে। অভিযোগেরও কমতি নেই এতে। ছেলে শিক্ষার্থীরা নারী সহপাঠীকে নিয়ে আজেবাজে অশীল মন্তব্যসহ বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমেও কটাক্ষ করে। অনেকে আবার সহপাঠীর সঙ্গে মিথ্যে প্রেমের অভিনয় করে সর্বস্ব লুটতেও দ্বিধা করে না। এছাড়া নারী সহপাঠীকে অনেকেই ভাবে সে তো নারী তাই তাকে যেন ভোগ করা তার মৌলিক অধিকার। এছাড়া আজেবাজে কথা তো বলেই। সুযোগ বুঝে নারী সহপাঠীর সম্ভ্রম লুণ্ঠন করতেও যেন নেই কোন ভ্রুক্ষেপ। দেশ এখন উন্নত হয়েছে। প্রযুক্তির বদৌলতে আমরা হচ্ছি উন্নত। এক সময়কার চিঠির প্রচলন উঠে গেলেও; এখন প্রযুক্তি আমাদের সে কাজটিকে সহজলভ্য করে দিয়েছে। এর ফাঁকে আমাদের তরুণ সমাজ জড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ এক নেশার দিকে। সেটা স্কুল বলেন, কলেজ বলেন, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, সব খানেই অশ্লীলতার চিত্র আমরা দেখতে পাই। সবাই যে খারাপ এমন নয়; আবার সবাই যে ভাল এমনও নয়। বিভিন্ন খারাপ দৃশ্য দেখে যেন সহপাঠীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি উঠে যেতে শুরু করেছে। চাঁদপুর থেকে . বিষয়টি অপ্রীতিকর আরিফ হোসাইন হিয়া ॥ শিক্ষা অর্জনের জন্য সবাইকে কোন না কোনভাবে শিক্ষাঙ্গনে যেতে হয়। যদিও শিক্ষা অর্জনের কোন নির্দিষ্ট স্থানকে দিয়ে বিচার করা যায় না। তবে বেশিরভাগ মানুষকে শিক্ষাঙ্গনই শিক্ষা অর্জন করতে বাধ্য করে। যার মধ্যে আছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় ও আরও ছোটখাটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারনত ছাত্রছাত্রীদের তেমন ভেদাভেদ থাকে না। সবাই শিক্ষা অর্জনের জন্য যেতে পারে। এখানে আমার প্রশ্ন হলো এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রীদের প্রতি ছাত্রদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? বন্ধুর দৃষ্টিতে দেখে? বোন হিসেবে দেখে? নাকি কুৎসিত মন্তব্য বা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দিয়ে, নাকি অন্য কোন ধরনের নিপীড়নমূলক আচরণের শিকার হতে হয় মেয়েদের? নাকি কোন বৈষম্য বা বিভেদের মুখোমুখি হতে হয় তাদের? এইসব প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন ছাত্রের কাছে বিভিন্ন রকমের পাওয়া যাবে। এখানে আমি যদি আমার শিক্ষাঙ্গন জীবন প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিঙ্গতা থেকে বলি তাহলে বলতে পারি যে, শিক্ষাঙ্গনে গড়পড়তা বা বেশিরভাগ ছাত্ররা ছাত্রীদের বন্ধুর দৃিষ্টভঙ্গি দিয়ে দেখে থাকে। আবার অনেকেই আছে যারা নিজ ক্লাসের বাইরের ছাত্রীদের খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখে থাকে, এমন কি বাজে মন্তব্য করে থাকে। এটি আদৌও ঠিক নয়। আমাদের সকলের উচিত হবে নিজ ক্লাসের বন্ধুদের মতো অন্য ক্লাসের বা বিভাগের ছাত্রীদের একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা বা বোনের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা। এটি যেমন ছাত্রদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলছি ঠিক একইভাবে ছাত্রীদের ক্ষেত্রেও হওয়া উচিত। ছাত্রছাত্রী উভয়ের শালীনতা থাকা দরকার। যে কোন বিপদ আপদে সবার আগে বন্ধু বা সহপাঠীরাই এগিয়ে আসে। যার বাস্তব উদাহরণ হলো সম্প্রতি ঢাকার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী বাসে যৌন হয়রানির শিকার হলে তার সহপাঠীরাই রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে। তারা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। হয়ত এইসব ঘটনা ছাড়া আরও ঘটনা পাওয়া যাবে যে বিপদের সময় শিক্ষাঙ্গনে সবার আগেই বন্ধু/সহপাঠীরা পাশে দাঁড়ায়। তবে একথা অস্বীকার করছি না যে সকল ছাত্রই ছাত্রীদের বন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা করে। কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা থাকে যেখানে তাদের আচরণ দেখলেই সহজে চিহ্নিত করা যায় যে, তারা খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখে এবং অনায়াসে বাজে মন্তব্য করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, হে নবী আপনি ইমানদার পুরুষদের কে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং গোপন অঙ্গকে হেফাযত করে এতে তাদের জন্য উত্তম পবিত্রতা রযেছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ এ ব্যাপারে জানেন। আমারা সকল নারী-পুরুষ যদি ধর্মীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সামাজিক মূল্যবোধ থেকে শিক্ষা নিয়ে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারি তাহলে অবশ্যই আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সকলের প্রতি ভাইবোনের মতই হবে। যৌন হয়রানির মতো অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো কমে যাবে। তাহলেই দেখা যাবে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
×