ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রমিকরা অধিকার নিয়ে বাঁচতে চান

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ১ মে ২০১৮

শ্রমিকরা অধিকার নিয়ে বাঁচতে চান

আজ ক্যালেন্ডারের পাতায় পহেলা মে। এই দিনে আমরা পালন করছি বিশ্ব শ্রমিক দিবস বা মে দিবস। শ্রমিক দিবস শ্রমিকের জীবনের কথা বলে। শ্রমিকেরা যুগে যুগে মানবেতর জীবন করে আসছে এবং সংগ্রাম করে আসছে। উপনিবেশিকতার যুগে শ্রমিকরা দাসত্ব প্রথার কারণে বেচাকেনা হতো, মালিক নিজের ইচ্ছে মতো তার শ্রমিককে ব্যবহার করতে পারত, ইচ্ছে হলে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রিও করতে পারত। সেই যুগে শ্রমিকেরা ছিল অবহেলিত, নিগৃহীত, নির্যাতিত। তাদের ছিল না কোন মর্যাদা ও অধিকার। কথা বলার মতো কিংবা প্রতিবাদ করার মতো কণ্ঠও ছিল না তাদের। তাই তারা নীরবে সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছিল। অবুঝ পশুর মতো মালিকের আদেশ-নির্দেশ পালন করে চলছিল। একটু ভুল হলেই তাদের ওপর চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন। সে জন্য তারা মুখ খুলে কিছু বলতে পারত না, মুখ তুলেও চাইতে পারত না। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের আগে ইউরোপ ও আমেরিকায় শিল্পকারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মানুষ বলে গণ্য করত না। তাদেরকে বেশি পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হতো। শ্রমিকেরা ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করত। এত ঘণ্টা কাজ করেও তারা ন্যায্য মজুরি পেত না। শুধু তাই নয়, তারা সরকারী ছুটি বা সাপ্তাহিক ছুটি পেত না। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় অবস্থিত জুতা শিল্প শ্রমিকদের দিনে ১৬ থেকে বিশ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হতো। কোন ওভারটাইম মজুরি দেয়া হতো না। বরং তাদের আদেশ অমান্য করলে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। ঠিক তখনই এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। তারা কয়েকটি দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে থাকে। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল- ১। বেঁচে থাকার মতো মজুরি ২। অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা ৩। সাপ্তাহিক ছুটি ৪। দৈনিক কাজের সময় সীমা হবে ৮ ঘণ্টা। সেই আন্দোলন পূর্ণতা পায় ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। ঐ বছরের ১ মে লাখ লাখ শ্রমিক আন্দোলনের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে আসে। দাবি নিয়ে শ্রমিকেরা ৩ মে ও ৪ মে ধর্মঘট ও আন্দোলনের ডাক দেয়। এই দুই দিনে পুলিশ তাদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই ১০ জন নিহত হয় আরও আহত হয় কয়েকশ’ শ্রমিক এবং গ্রেফতারকৃত শ্রমিকদের অনেককেই ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলানো হয়। কিন্তু তাতে আন্দোলন থেমে থাকেনি। অবশেষে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় তারা। সেই স্মরণীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। সারা বিশ্বের মতো আমরাও প্রতি বছর বিশ্ব শ্রমিক দিবস পালন করে আসছি। তথাপি, শ্রমিক দিবসের যে তাৎপর্য ও গভীর অর্থ রয়েছে তা আমাদের জাতীয় জীবনে ততটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাই দেখতে পাই, এখনও শ্রমিকেরা আগের মতো মালিকের হাতে বন্দী। যদিও সেই সময়ের মতো শ্রমিকেরা দাসত্ব করে না। হাটে-বাজারে বিক্রি হয় না। তবু দাসত্বের নানা রূপ দেখতে পাই। সেই রূপ দেখতে পাই, গার্মেন্টস্-ফেক্টরিতে, মেশিনারিজ কাজে, বাসা-বাড়িতে, ইটভাটায় প্রভৃতি কর্মক্ষেত্রে। যারা বাসা-বাড়িতে কাজ করে তাদেরকে বলা হয় কাজের মেয়ে, বুয়া, আয়া। তাদের নামটাই অবজ্ঞাসূচক। অনেক সময় দেখা যায়, ছোট শিশুও তার মায়ের বয়সী কোন কাজের লোককে বুয়া, আয়া বলে ডাকছে। বুয়া বা আয়াদের প্রতি তাদের কোন শ্রদ্ধাবোধ গড়ে উঠেনি। মা-বাবাও শিশুকে আদব-কায়দা শেখায় না। সামান্য ভুল হলেই শারীরিক নির্যাতন করা হয়। সব দোষ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। অনেক নারী-শিশু বাসা বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে নিজের মানসম্ভ্রম হারায়। পত্রিকার পাতায় প্রায়ই দেখা যায় যে, পালানোর ভয়ে কোন কোন কাজের মেয়েকে গৃহকর্তা শিকলে বন্দী করে রেখে বাইরে চলে যায়। কখনোবা নারী শ্রমিক গৃহকর্তা দ্বারা ধর্ষিত হয়। আমাদের দেশে যারা মুচি, গাড়িচালক, কুলি, দিনমজুর, মেথর তাদেরকে এবং তাদের কাজকে যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান দেওয়া হয় না। তাদেরকে এবং তাদের কাজকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ করা হয়। অনেকক্ষেত্রে তাদের শ্রমকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয় না। এদেশের গার্মেন্টস শিল্প অনেক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। পক্ষান্তরে শ্রমিকের মজুরি অন্যান্য দেশের তুলনায়ও অনেক সস্তা। তাই অনেক দেশই বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বা গার্মেন্টসশিল্পকে উৎসাহিত করছে। অনেকেই সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ে অধিক মুনাফা অর্জন করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে। তাই বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অনেক অপরিকল্পিত ও অনুমোদিত গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। মাঝে মাঝেই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো মারাত্মক দূর্ঘটনায় কবলিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে অনেক শ্রমিক মারা গেছে। এসব বেশিরভাগ গার্মেন্টসেই উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না, অগ্নিনির্বাপকের সুব্যবস্থা ছিল না, গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত রাস্তা ছিল না। তাই সাভারের তাজরিন গার্মেন্টস আগুনে পুড়ে যাওয়ার সময় আগুন নিয়ন্ত্রণে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব রয়েছে। সে জন্য আন্দোলন, বিদ্রোহ সারা বছর লেগেই থাকে। এই অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা দূর করতে না পারলে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি হবে না। রানা প্লাজা ধসে যে দুর্ঘটনার জন্ম দিল তাতে দেখা যায়, শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। মালিক জোর করে তাদেরকে কাজ করতে বাধ্য করেছে। রানা প্লাজা আগে থেকে ফাটল ধরেছিল। তাই শ্রমিকরা কাজ করতে চায়নি কিন্তু মালিকের কারণে বাধ্য হয়েছে। কারণ, কাজে যোগ না দিলে মালিক বেতন দেবে না বলে হুমকি দিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছিল। ইটভাটায় যারা কাজ করে তাদের জীবনযাত্রা বড় দুঃসহ। বাঁচার তাগিদে গ্রামের লোকেরা অগ্রিম টাকা নেয়। মালিকেরা কিংবা দালালেরা একসঙ্গে ত্রিশ হাজার টাকা কিংবা বিশ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে দেয়। এত টাকা গরিবেরা পরিশোধ করতে পারে না বিধায় কাজ করতে হয়। পরে আর চাইলেও কাজ না করে থাকতে পারে না। কাজ করতে অস্বীকার করলে টাকা ফেরত দিতে হয় কিংবা কাজ করতে গিয়ে সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে আসলেও টাকা ফেরত দিতে হয়। তাদের কাজ শুরু করতে হয়, শীতের খুব ভোরেই আর শেষ হয় রাতে। মাঝে সামান্যতম বিরতি থাকে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানার কয়েকটি গ্রামে ইটভাটায় কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় যে, তারা খুব কষ্টে কাজ করে। নিজের খরচে খেতে হয়। কেউ কেউ চিড়া মুড়ি খেয়ে কাজ করতে যায়। এসব হালকা খাবার খেয়ে মাটির কাজ করা খুবই কষ্টের। তাই কেউ পালিয়ে চলে আসে। পালিয়ে আসার পরিণাম আরও ভয়াবহ। টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য বাধ্য করা হয় তাদের। এমনও হয়েছে যে, টাকা ফেরত দিতে না পেরে কয়েকজন গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। আমাদের দেশে শিশু শ্রমিক বাড়ছে। সেই সঙ্গে শিশু নির্যাতনের মাত্রাও বাড়ছে। মেশিনারিজ কাজে, ইটভাটায়, দোকানো, হোটেলে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হয়। সামান্য কারণে তাদের নির্যাতনও করা হয়। যে বয়সে শিশুর স্কুলে যাওয়ার কথা, যে বয়সে শিশুর সাথীদের সঙ্গে খেলা করার কথা সে বয়সে শিশুরা কাজ করছে। অথচ শিশুশ্রম অনেক আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একবার সিলেট থেকে ঢাকাগামী ট্রেনে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। সে সব মাদকদ্রব্য বহনকারীরা সবাই শিশু। এক শ্রেণীর লোক শিশুদেরকে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত করছে। তাতে শিশুদের মৌলিক অধিকার বিঘ্নিত হচ্ছে। শ্রমিকের প্রতি মানুষের মানবমর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার বিষয়টি দিন দিন অবমূল্যায়ন হচ্ছে। শ্রমিকরা চান, সকলের মতো তারাও সম্মান নিয়ে বাঁচতে। শ্রমিকদের অধিকার অন্যান্য সকল অধিকারের মতই মানব ব্যক্তির মর্যাদার ওপর নির্ভরশীল। তাদের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে সমাজকল্যাণ ও সামাজিক বিজ্ঞান কয়েকটি অধিকারের কথা উল্লেখ করেছে। এগুলো হলো- ১) ন্যায্য মূল্য পাওয়ার অধিকার ২) ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন ও পারিবারিক জীবন যাপনের জন্য ছুটি পাওয়ার অধিকার। ৩) সমাবেশ-সংগঠন করার অধিকার। ৪) সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশে কাজ করার অধিকার। ৫) বিশ্রামের অধিকার। ৬) শ্রমিকদের দৈহিক স্বাস্থ্য বা নৈতিক বিশুদ্ধতা অধিকার ৭) কর্মস্থলে ব্যক্তিমর্যাদা নিরাপদ থাকার অধিকার। ৮) বিবেকবিরুদ্ধ কিছু করতে বাধ্য হওয়া বা ব্যক্তিগত মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় এমন কিছু করতে বাধ্য হওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকার অধিকার। ৯) বেকার শ্রমিক ও তাদের পরিবারবর্গের ভরণপোষণের জন্য উপযুক্ত সরকারী সাহায্য পাওয়ার অধিকার। ১০) বৃদ্ধ বয়স, অসুস্থতা এবং কর্মস্থলে দুর্ঘটনার জন্য বীমা ও ভাতার অধিকার। ১১) মাতৃকালীন সময়ে সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার শ্রমিকেরা আমাদের অক্লান্ত সেবা দিয়ে যাচ্ছে বিনিময়ে আমরা তাদেরকে কি দিচ্ছি? আমরা কি তাদের অধিকার ও মর্যাদাগুলো পূরণ করতে পারছি? আজ দিন এসেছে শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তাদের মজুরি দিয়ে দেওয়ার। আজ দিন এসেছে ঋণ ও দেনা পরিশোধ করার। তাই কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় আজ বলতে হয়- ‘আসিতেছে শুভদিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ! তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাইল ধূলি; তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাদের গান, তাদের ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!’ লেখক : ক্যাথলিক ধর্মযাজক [email protected]
×