ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাবি ভিসির বাসভবনে তা-ব ॥ পুলিশ ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেয়- জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য

অশুভ শক্তি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সেদিন লাশ চেয়েছিল

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৯ এপ্রিল ২০১৮

অশুভ শক্তি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সেদিন লাশ চেয়েছিল

শংকর কুমার দে ॥ কোটা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভিসির বাড়িতে তাণ্ডব চালানোর সময়ে হামলাকারীদের ওপর গুলি চালালে লাশ পড়ে যেত বলে জিজ্ঞাসাবাদে তদন্তকারীদের কাছে দাবি করেছেন ঘটনার সময়ে কর্তব্যরত পুলিশ। ভিসির বাসভবনে সেই রাতে কর্তব্যরত পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ঢাবির দারোয়ান ও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এমন লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। জিজ্ঞাসাবাদে ও অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ভিসির বাসভবনে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নজিরবিহীন সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানোর নেপথ্যে অনুযায়ী রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে কৌশলে কাজ করেছে তৃতীয় পক্ষ, যা আঁচ করতে পারেননি আন্দোলনকারীরাও। কোটা আন্দোলনকারীদের অজান্তে সরকার বিরোধী অশুভ শক্তি রাতের আঁধারে আন্দোলনের ভেতরে ঢুকে পড়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য চেয়েছিল লাশ, সেই লাশ দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী সরকার বিরোধী মিছিল করার পরিকল্পনা ছিল তৃতীয় পক্ষের। কিন্তু ঢাবির ভিসির বাসভবনের সামনে কর্তব্যরত পুলিশ কোন ধরনের উস্কানিমূলক দমননীতির কর্মকা-ে বিরত থেকে চরম ধৈর্য, সহ্যের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে লাশের রাজনীতির মোকাবেলা করেছে বলে সেই রাতে কর্তব্যরত পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দারোয়ান, আশপাশের লোকজন যারা ছিলেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ও অনুসন্ধানে এই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে বলে তদন্তকারী, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে, সিসিটিভি ও কলরেকর্ড পরীক্ষা করে তদন্তকারীরা ভিসির বাসায় হামলাকারীদের শনাক্ত করছে। তাদের মধ্যে কারা ক্যাম্পাসের ছাত্র আর কারা বহিরাগত তা বের করা হচ্ছে। ক্যাম্পাসের সব প্রবেশপথ এলাকার সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। ঘটনার গভীর রাতে নিউমার্কেট মোড়সহ কয়েকটি এলাকা দিয়ে কয়েকশ’ লোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকেছিল। রাত সোয়া ১টায় পূর্বদিক থেকে একদল মিছিল নিয়ে এসে হামলা করে। ভিসির বাসভবনের দেয়াল টপকে হামলাকারীরা ওপরে উঠে সিসি ক্যামেরা ভেঙ্গে তারপর সন্ত্রাসের তা-ব চালায়। হামলার আগে মেয়েদের একটি মিছিল ভিসির বাসার সামনে যায়। হামলাকারীদের মধ্যে অর্ধ শতাধিক জনের হাতে লাঠিসোটা নিয়ে ভেতরে ঢুকেই আলোবাতি ভেঙ্গে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে। ভিসির বাসায় হামলাকারীদের মধ্যে কারও কারও গায়ে লেখা টি-শার্ট ছিল। এ ছাড়া কেউ কেউ ভেতরে ঢুকে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করেছে। তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে। ঘটনাস্থল ও এর আশপাশের এলাকায় কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দারোয়ানসহ নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্তে হামলাকারীদের অনেকেই শনাক্ত। মুখোশ পরে যারা হামলা করেছে তাদের মধ্যে মহিলাও রয়েছে। হামলার ধরন ও অন্যান্য আলামত বিশ্লেষণ করে তদন্তকারী পুলিশের ধারণা, ভিসির বাসায় সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানোর ঘটনার সঙ্গে যারা হামলার আগে-পরে গুজব ছড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছে, তাদের শনাক্ত করছে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ বিভাগ। কৌশলগত কারণে হামলাকারীদের নাম পরিচয় প্রকাশ ও তাদের আপাতত গ্রেফতার করা হচ্ছে না। ডিবি সূত্র জানায়, ভিসির বাসভবনের সামনের সিসিটিভির ফুটেজ ভেঙ্গে ফেলা হলেও ক্যাম্পাসের ভেতরের ও প্রবেশপথের সিসিটিভির ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, নীলক্ষেত মোড়সহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে ঢাবিতে ঢুকেছে হামলাকারীরা। এরই মধ্যে ক্যাম্পাসের ভেতরে ও প্রবেশপথের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করছে পুলিশ। এদিকে ভিসির বাসায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ছাড়া পুলিশের বিশেষ বিভাগের (এসবি) এক সদস্যের গাড়ি পোড়ানো ও সরকারী কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে আরও তিনটি পৃথক মামলাসহ মোট পাঁচটি মামলা দায়ের করার পর তা তদন্ত এখন তদন্তনাধীন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেছেন, ঢাবি ভিসির ভবনে হামলার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ আমরা সংগ্রহ করেছি। সেই ছবি বা ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্তের জন্য কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী তিন নেতাকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্যের বাসভবনে হামলার ঘটনায় সহযোগিতা চাইতে আনা হয়েছিল, পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আন্দোলনকারী যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূর, ফারুক হাসান, মুহম্মদ রাশেদ খানকে ডিবি পুলিশ ছেড়ে দেয়ার পর তারা ঢাবি ক্যাম্পাসে গিয়ে সংবাদ সম্মলনে বক্তব্য রাখেন। এ সময় পুলিশ তাদের চোখ বেঁধে হয়রানি করেছে, এমন অভিযোগও করেছিলেন। তবে তাদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। তবে তারা কেন অভিযোগ করছে সেটা তারা ভাল বলতে পারবে। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, রাতে উপাচার্যের বাসভাবনে হামলার সঙ্গে আন্দোলনকারীদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। তারা এও বলেছেন, ‘বাইরের সন্ত্রাসীরা’ এই হামলা চালিয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ভিসির বাসভবনে হামলার পর ঢাবি উপাচার্য মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন, দুর্বৃত্তরা চেয়েছিল একটি লাশের রাজনীতি করতে। রক্তের রাজনীতি করতে। হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে রক্তপাত ঘটিয়ে একটি বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করা, সরকারকে অচল করা, অস্থিতিশীল একটা পরিবেশ সৃষ্টি করার টার্গেট ছিল তাদের। আলামত দেখে এটাই মনে হয়েছে। এর সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কোন সম্পর্ক নেই। ভিসির অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ২০১৫ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনকে চাঙ্গা করার জন্য নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে নিউইয়র্কে অবস্থারত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার ফোনালাপের সময় বলেছিলেন, প্রয়োজনে ২/৩টি লাশ ফেলতে হবে। টেলিফোনে মান্নাকে বলতে শোনা যায়, ‘ঢাকার বাইরে আমাদের অবস্থান দুর্বল। ঢাবিতে দুই তিনটি হল দখল করে অবস্থান শক্ত করতে হবে। সরকারকে ফেলতে হলে পেট্রোলবোমার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ-গোল পাকিয়ে ২/৩টি লাশ ফেলে দিতে হবে।’একটি গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি কথোপকথনটি রেকর্ড করার দুই দিন পর ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর ধানম-ির স্টার কাবারের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয় মান্নাকে। ওই রাতেই গুলশান থানার অপারেশন অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শেখ সোহেল রানা বাদী হয়ে মান্না ও অজ্ঞাতনামা একজনকে আসামি করে মামলা করেন। দ-বিধির ১৩১ ধারায় মামলা নম্বর ৩২। মামলার এজাহারে মান্নার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে উস্কানি দেয়াসহ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। এর দিন দশেক পর ৫ মার্চ একই থানায় আরেকটি মামলা করা হয় মান্নার বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় মামলায় মান্নার পাশাপাশি সাদেক হোসেন খোকাকেও আসামি করা হয়। এ মামলায় দ-বিধির ১২০-বি/১২১-এ/১২৪-এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। বিএনপি ও নাগরিক ঐক্যের এই দুই নেতার মধ্যে লাশ ফেলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার যে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল সেই একই কায়দায় কোটার দাবিতে আন্দোলনকারীদের ভেতরে ঢুকে লাশ ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখছে তদন্তকারীরা। কারণ লন্ডনে বসবাসকারী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ঢাবির অধ্যাপক ও বিএনপি নেতা মামুনের সঙ্গে ফোনালাপে আন্দোলন অর্গানাইজড করার প্রসঙ্গটি আসায় লাশ ফেলার বিষয়টিও তদন্তের সামনে আনা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, লন্ডনে বসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মামুনকে টেলিফোনে কোটা আন্দোলন সংঘটিত করতে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই টেলিফোন কলের অডিও পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। ঢাবির অধ্যাপক মামুন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের সভাপতিও। কোটা আন্দোলনের সঙ্গে অধ্যাপক মামুন ও লন্ডনে অবস্থানকারী তারেক রহমানের সম্পর্ক কি ? তারেক রহমানের অধ্যাপক মামুনকে কোটা আন্দোলনকে অর্গানাইজড করার উদেশ্য কি ? কোটা আন্দোলনের দাবির সময়ে ফেসবুকে এক ছাত্রের মৃত্যুর ও এক ছাত্রীর রগকাটা হয়েছে বলে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে কার স্বার্থে ? কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের ওয়াকিটকি ছিনতাইসহ সন্ত্রাসের ঘটনার জন্য যারাই দায়ী হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষ সময়মতো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোটা আন্দোলনকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যাবহার করার আগেই প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত বলিষ্ট হস্তক্ষেপে তা মাঠে মারা যায় বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা বলেন, ভিসির বাসভবনে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই এই ব্যাপারে আর কিছু বলতে চাই না। সময়মতো আপনাদের সব তথ্য জানানো হবে। প্রসঙ্গত কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সময়ে গত ১০ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভিসির বাড়িতে হামলার ঘটনায় ঢাবির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। অন্য তিনটি মামলা পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সদস্য ও শাহবাগ থানা পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করেন। অপর একটি মামলা দায়ের করা হয় ফেসবুকে মৃত্যু ও রগকাটা হয়েছে বলে যে গুজব ছড়ানো হয়েছে সেই বিষয়ে রমনা থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে মামলাগুলোয় নির্দিষ্ট করে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ফেসবুকে মিথ্যা, গুজব ও উস্কানিমূলক তথ্য প্রচারকারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভিসির বাসভবনে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে করা ৫টি মামলার তদন্ত চলছে।
×