ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গরমের আরাম রসালো তরমুজে ভরপুর রাজধানীর অলিগলি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৮ এপ্রিল ২০১৮

গরমের আরাম রসালো তরমুজে ভরপুর রাজধানীর অলিগলি

ওয়াজেদ হীরা ॥ কাক ঢাকা ভোরে ঘুমন্ত গোটা শহর। রাজধানীবাসীর অনেকেই জেগে ওঠেনি। ততক্ষণে জমজমাট সদরঘাটের ওয়াইজঘাট ও বাদামতলি এলাকা। গরমের ‘আরাম’ খ্যাত তরমুজ নিয়ে হাঁকডাক পাইকারি আর খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে। নদী পথে দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার ছোট বড় বিভিন্ন আকারের তরমুজ নিয়ে ঘাটে ভিড়ছে জাহাজ বা ইঞ্জিনচালিত নৌকা। প্রচন্ড গরমে স্বস্তি দেয়া মৌসুমের এই রসাল ফল কিনতেই খুচরা বিক্রেতারা প্রতিভোরে ভিড় জমান। আড়ত হয়ে খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে এই তরমুজ চলে যাচ্ছে রাজধানীর অলিতে গলিতে। যদিও এ বছর তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে তবুও এখনও খুচরা বাজারে বেশ দাম তরমুজের। রাজধানীর একাধিক জায়গায় দেখা গেছে রসাল ফল তরমুজের বেচাকেনা। ফলের দোকানগুলোর পাশাপাশি পাড়া মহল্লায়, অলি-গলিতে, ভ্যানেও বিক্রি হচ্ছে গরমের এই প্রশান্তির ফল। ক্রেতারা বলছেন, বাজারে প্রচুর তরমুজের আমদানি তবুও দাম তুলনামূলক বেশি। তবে থেমে নেই বিক্রিও। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, দামটা প্রতিদিনই ওঠানামা করে। যেমন দামে কেনা হয় তার একটু লাভেই তা বিক্রি করেন বলে জানান বিক্রেতারা। শুধু নদী পথেই নয় সড়ক পথেও আসছে তরমুজ। ওয়াইজঘাট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বিক্রেতাদের দর কষাকষির চিত্র। বুড়িগঙ্গার বুক চিতিয়ে ছোট বড় নৌকা বোঝাই করে ঘাটে ভিড়ানো তরমুজ এক হাত দু হাত করে চলে যায় আড়তে। কখনও নৌকার ওপর থেকেই দাম করে পিকাপ বা ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যায় কেউ কেউ। জানা গেছে, রাজধানীর ছোট বড় ব্যবসায়ীরা মূলত এখান থেকেই তরমুজ বেশি কেনে। তারপর সেটি কয়েক হাত হয়ে যায় ক্রেতার কাছে। পাইকারি এই ফলের বাজারে দুই ধরনের তরমুজ বেশি দেখা গেছে। ব্যবসায়ী আরমান জানান, এখানে আসা তরমুজের দুই জাতেরই বেশ চাহিদা। তিনি বলেন, সাদা ঢোরা কাটা দেখতে তরমুজকে ‘বাংলালিঙ্ক’ বলা হয়। আর কালো তরমুজকে ‘গ্লোরি’ আবার কেউ ‘একটেল’ও বলেন ব্যবসায়ীরা। তবে সাধারণ ক্রেতারা একে সাদা আর কালো তরমুজ নামেই চেনে। এছাড়াও বাজারে অলক্লিন, চায়না-২, এশিয়ান-২, বালি ইত্যাদি নামে বিভিন্ন জাতের তরমুজ পাওয়া যায়। পাইকারি বাজারে বড় তরমুজ (প্রতিটি ১৫-২০ কেজি) এক শ’ পিসের দাম বিশ হাজার টাকা ধরে বিক্রি হচ্ছে। তাতে প্রতিটির দাম পরে দুই শ’ টাকা। রাজধানীর খুচরা বাজারে তা তিন শ’ থেকে সাড়ে তিন শ’ টাকা বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়াও যারা রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে তরমুজ কেটে বিক্রি করেন তারা এই ধরনের তরমুজে চার শ’ টাকারও বেশি বিক্রি করতে পারেন। ক্রেতারা এখওা বেশি দামে তরমুজ কিনছেন সে বিষয়ে ওয়াইজঘাটের পাইকারি বিক্রেতা শরিফুল মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, দেখুন আমাদের এখানে অনেকেই ব্যবসা করে। প্রতিযোগিতা চলে। ইচ্ছা করলেই আমরা বেশি দাম রাখতে পারি না। আর তরমুজের সাইজ ও মানভেদে দামটা হয়। তবে খুচরা বিক্রেতাদের বিক্রির ওপর তাদের কোন হাত নেই বলেও জানান তিনি। আরও কয়েকজন পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বললেও তারা একই ধরনের কথা বলেন। পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ছোট সাইজের তরমুজ ৫০-৭০ টাকা, মাজারি ১০০-১৫০ টাকা এবং বড় তরমুজ আকার ভেদে দাম রাখা হচ্ছে। মোহাম্মদিয়া ফার্ম, বিসমিল্লাহ ফার্ম, জিতু এন্টারপ্রাইজ কিংবা ঝিনাইদহ সিন্ডিকেটের আড়ত তরমুজে ভরপুর। রশিদ নামের এক শ্রমিক বলেন, সকালে কথা বলার সময় কম। ভোর থেকে সকাল ৮টার মধ্যে সব বিক্রি শেষ হয়। তার পর দিনভর খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করেন। পল্টন মোড়ে তরমুজ বিক্রেতা সেলিম বলেন, দিনে ১৫-২০টি তরমুজ কেটে বিক্রি করতে পারি। ১০ টাকা প্রতি প্লেট। যারা গোটা একটি তরমুজ না কেনেন বা চলতি পথে তরমুজ খাওয়ার ইচ্ছে হয় তারাই পথের মধ্যে বিরতি দিয়ে এই কেটে দেয়া তরমুজ খেয়ে নেন। প্রতিটিতে ৭০-১০০ টাকা পর্যন্ত লাভ থাকে বলে জানান ওই বিক্রেতা। কারওয়ান বাজার থেকে তরমুজ কেনেন নাজমা বেগম (৩৬)। অফিস থেকে বেরিয়ে বাসা যাওয়ার আগে সন্তানের আবদার রক্ষায় কিনেছেন রসাল ফল। মাঝারি আকারের তরমুজে দাম নিয়েছে ২২০ টাকা। তবে অখুশি নন তিনি। সন্তানের চাওয়া রক্ষা করতে পারছেন তাতেই খুশি বলেও জানান। তবে নাজমা বেগমের মতো দাম নিয়ে খুশি হতে পারেনি সিরাজুদ্দিন (৪০)। তিনি তরমুজ দেখিয়ে বলেন, এটির দাম নিয়েছে আড়াই শ’, শুনেছি ফলন ভাল দামটা আরও কম হওয়া দরকার ছিল। আরেক ক্রেতা ফরমান আলী তরমুজের দর দাম করে বনিবনা না হওয়ায় ফিরে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, বাজারে এত তরমুজ তবুও দাম কমে না। এত দামে কি আর আমরা কিনতে পারি? একটা তরমুজের দাম সাড়ে ৩শ’ টাকা চায়। মৌসুমি ফল বাজারে এসেছে শখ করলাম একটা কিনব কিন্তু দাম বেশির জন্য কিনতে পারলাম না। পরে কিনবেন বলেও জানান তিনি। কাওরান বাজার, শান্তিনগর, মতিঝিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারি দাম হিসেবে তরমুজের দাম একটু বেশিই রাখা হচ্ছে। সে হিসাবে খুচরা বিক্রেতাদের লাভের পাল্লাটা ভারি। আর উচ্চমূল্য দিয়ে খেসারত দিচ্ছেন ক্রেতারা। খুচরা বিক্রেতাদের যুক্তি তাদের আড়ত থেকে আনা নেয়ায় প্রচুর খরচ হয়ে যায়। ব্যাংক পাড়ায় তরমুজ বিক্রি করার সময় বিক্রেতা আসলাম বলেন, আমাদের তরমুজ কেনার পর ভ্যানে করে আনতে গিয়ে আরও কয়েক শ’ টাকা খরচ হয়। শ্রম দেই, একটু লাভ না হলে খামু কি? ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন প্রতিদিন যে হারে তরমুজ আসতেছে দাম আরও কমে যাবে। বর্তমানে খুচরা বাজারে সাইজ অনুযায়ী তরমুজ বিক্রি হচ্ছে, বড় ৪৫০-৫৫০, মাজারি ২০০-৩৫০, ছোট ১০০-১৫০ টাকায়। তরমুজের উপকারিতা সম্পর্কে রাজধানীর একটি বেসকরকারী হাসপাতালের চিকিৎসক ফরিদ জনকণ্ঠকে বলেন, গরমে ক্লান্তি ভাব দূর করে রসাল ফল তরমুজ। সারাদিনের গরমে শরীর যখন দুর্বল তখন তরমুজই এনে দিতে পারে সতেজতা। তরমুজ গরমে পানির চাহিদা মেটানোর জন্য উপযোগী। এতে থাকা নানা পুষ্টি ও খনিজ উপাদান মানবদেহ সতেজ রাখতে সাহায্য করে। গরমে শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে, চোখের জন্য ভাল। এছাড়াও তরমুজের রয়েছে বিবিধ উপকারিতার কথা বলেন তিনি। তবে তিনি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা বর্তমানে তরমুজে নানা রকমের রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। তাই তরমুজ কেনার সময় সচেতন থাকা প্রয়োজন। এদিকে, দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলাতেই তরমুজের ভাল ফলন হয়। বেলে-দোআঁশ মাটি তরমুজ চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় ওই সব এলাকার চাষিরাও বেশ আগ্রহ নিয়ে তরমুজ চাষ করেন। ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তরমুজ চাষে এবার বাম্পার ফলন হয়েছে ওইসব এলাকায়। কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে একাধিক এলাকার ভাল ফলনের খবর পাওয়া যায়। জানা গেছে, স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। পটুয়াখালী জেলা কৃষি কর্মকর্তা হৃদয়েশ্বর দত্ত জানিয়েছেন, এবার পটুয়াখালীতে তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে তরমুজ চাষিরা এবার বেশি লাভবান হবে। ভোলার এক চাষি সমির উদ্দিন জানান, গত বছর বর্ষায় তরমুজ ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় তারমতো অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবার অনেকেই তরমুজ চাষ করেননি, তবে যারা করেছেন তারা বাম্পার ফলন পেয়েছেন। তবে কৃষি অফিস থেকে কোন সহযোগিতা পাননি সে অভিযোগও করেন। ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছর জেলার সাত উপজেলায় ১২ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছিল। সেখানে এ বছর চাষ হয়েছে মাত্র তিন হাজার ১শ’ ৬০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৯ হাজার ৩৪০ হেক্টর কম জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। তবে চাষিরা বেশ খুশি। নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ বিভিন্ন স্থানে তরমুজ চাষে বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে, তরমুজ শুধু খাওয়ার জন্যই নয় কেউ কেউ ব্যবহার করেন রূপচর্চাতেও। গরমে প্যাচপ্যাচে ঘাম, রোদের তাপ সব মিলিয়ে বাজে অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তরমুজ দিয়ে ত্বকের যত্ন নেন অনেকেই। বিভিন্ন বিউটি পার্লারে এসব নিয়ে নানা ধরনের পরামর্শ দেয়া হয়। রূপচর্চা সংশ্লিষ্টদের মতে, তৈলাক্ত ত্বকের জন্য তরমুজ খুবই উপকারী। তরমুজের টুকরো ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে ত্বকে ঘষলে উজ্জ্বল হবে বলেও জানান। তরমুজে থাকা এ্যামাইনো এসিড চুলের বেড়ে ওঠার জন্য দারুণ উপকারী। তরমুজের নির্যাস সপ্তাহে একদিন তেলের সঙ্গে মিশিয়ে চুলে দেয়ার পরামর্শও দেন। পরে এক ঘণ্টা পর চুল ধুয়ে ফেলতে হবে। এছাড়াও তরমুজের সঙ্গে সুজির দানা মিশিয়ে স্ক্রাব তৈরি করে আধাঘণ্টা করে মুখে রাখার কথা জানিয়েছেন। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন এই স্ক্রাব ব্যবহার করলে ত্বকের সজীবতা অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে জানা গেছে। খাওয়া কিংবা রূপচর্চা যাই হোক তরমুজ উপকারী। আর উপকারী এই মৌসুমি ফল সাধ্যের মধ্যে চান ক্রেতারা।
×