ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবেশ অধিদফতরের জরিপে তথ্য

শব্দদূষণে দেশে ১১.৭ ভাগ মানুষ বধির হয়ে পড়ছেন

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২৮ এপ্রিল ২০১৮

শব্দদূষণে দেশে ১১.৭ ভাগ মানুষ বধির হয়ে পড়ছেন

শাহীন রহমান ॥ ট্রাফিক সিগন্যাল জ্যামে আটকে থাকায় গাড়িগুলো অনবরত হুইসেল বাজিয়ে চলছে। বাংলা মোটরে আকস্মিক এই হুইসেলে অনেকেই কানে হাত দিতে বাধ্য হলেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ ধরনের আকস্মিক তীব্র শব্দে মানুষ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। পরিবেশ অধিফতরের এক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে শব্দের ভয়াবহ মাত্রার কারণে দেশে ১১.৭ শতাংশ মানুষ উভয় কানে শোনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিফতরের এক জরিপে দেখানো হয়েছে এ ধরনের আকস্মিক তীব্র শব্দ যানবাহন এবং এর হর্ন, শব্দের প্রধান উৎস হিসেবে উঠে এসেছে। হর্ন গণনায় দেখা যায়, অনেক স্থানেই মাত্র ১০ মিনিটে ৫শ’ থেকে ১ হাজার বারের মতো হর্ন বাজাতে দেখা গেছে। এছাড়া সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, নির্মাণ কাজ এবং কল-কারখানা থেকেও শব্দ দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতর দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে এরকম আকস্মিক শব্দের মানমাত্রা পরিমাপবিষয়ক একটি জরিপ করেছে। সেখানে দেখানো হয়েছে সবস্থানেই শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম করেছে। রেকর্ডকৃত আকস্মিক শব্দের মাত্রা হচ্ছে, ঢাকায় সর্বোচ্চ ১৩২ ডেসিবল। সর্বনিম্ন ৫১ ডেসিবল। চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ১৩৩ ডেসিবলও সর্বনিম্ন ৪৭ ডেসিবল। সিলেটে সর্বোচ্চ ১৩১ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৫০ ডেসিবল, খুলনায় সর্বোচ্চ ১৩২ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৪২ ডেসিবল, বরিশালে সর্বোচ্চ ১৩১ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৫৪ ডেসিবল, রংপুরে সর্বোচ্চ ১৩০ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৪৬ ডেসিবল, রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ১৩৩ ডেনিবলও সর্বনিম্ন ৫৬ ডেসিবল এবং ময়মনসিংহে সর্বোচ্চ ১৩১ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৪৭ ডেসিবল। রাজধানীর শিশু মেলা থেকে কলেজ গেট পর্যন্ত রয়েছে বেশ কয়েকটি সরকারী এবং বেসরকারী হাসপাতাল। এর মধ্যে রয়েছে মানসিক হাসপাতাল, হুদরোগ, কিডনি এবং সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আইন অনুযায়ী হাসপাতাল এলাকাকে নিরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই এলাকায় পরিবেশ অধিফতরের কয়েকটি সাইনবোর্ড রয়েছে। যেখানে লেখা রয়েছে নিরব এলাকা। উচ্চ মাত্রার শব্দ বা হর্ন বাজানো নিষেধ। কিন্তু সরেজমিন দেখা গেছে এই সাইনবোর্ড সম্পর্কে গাড়ির চালকদের কোন সচেতনতা নেই। তারা ইচ্ছেমতো হর্ন বাজিয়ে চলেন যা সহনীয় মাত্রার বহুগুণ বেশি শব্দ তৈরি করে। অথচ নিরব এলাকায় শব্দের সহনীয় মাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ ডেসিবল। শুধু হাসাপাতাল এলাকায় নয় সরেজমিনে আবাসিক এলাকায় বা শিল্প এলাকায় শব্দের যে সহনীয় মান রয়েছে তাও অতিক্রম করে চলেছে প্রতিনিয়ত। বিধিমালায় শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা এলাকা ভেদে ৩৫ থেকে ৭৫ ডেসিবল পর্যন্ত ধরা হয়েছে। এর বাইরে উচ্চমাত্রার শব্দ যেমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইনে শাস্তির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কোনটিই মানা হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন শব্দ দূষণ রোধে সচেতনা তৈরিতে পরিবেশ অধিদফতর কিছু কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। গত ২৫ এপ্রিল আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবসও পালন করা হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে। ১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর এপ্রিল মাসের শেষ বুধবার আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস পালিত হয়। বিগত দুই বছর পরিবেশ অধিদফতরের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস উদ্যাপিত হয়ে আসছে। এর বাইরে বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠন থেকেও আলাদাভাবে দিবসটি পালন করে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দিন দিন অবনতিই হচ্ছে। পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সোবহান বলেন, শহর এলাকায় শব্দ দূষণের প্রকোপ গ্রামাঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি। ঘরের বাইরে, রাস্তায় বা কর্মস্থল নয় ঘরের ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন ভ্যাকতুয়াম ক্লিনার ফুড ব্লেন্ডার ও গ্রানাইডার পাখা থেকেও বিরক্তিকর শব্দ বের হচ্ছে। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান এবং ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন উচ্চ শব্দ শিশু, গর্ভবতী মা এবং হৃদরোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে এবং পরিপাকে বিঘœ ঘটায়। বিশেষজ্ঞরা বলছে রাস্তঘাটের আকস্মিক কোন তীব্র শব্দে মানুষ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘদিন মাত্রাতিরিক্ত শব্দের মধ্যে অবস্থান করলে কানে শোনার ক্ষমতা লোপ পায়, যা আর ফিরে পাওয়া যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্ব জনসংখ্যার ৫ শতাংশ শ্রবণজনিত সমস্যার কারণে তাদের নিত্য জীবনে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশে ১১.৭ শতাংশ মানুষ উভয় কানে শোনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে শব্দদূষণের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিন্ড ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যেতে পারে। এজন্য শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, দিক ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো, মানসিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা তৈরি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একজন মানুষের প্রতিদিন বিভিন্ন মাত্রার শব্দের মধ্যে অবস্থানের মানদ- নির্ধারণ করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে একজন মানুষ যথাক্রমে ৯০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট, ১০০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ১৫ মিনিট, ১১০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ৩০ সেকেন্ড, ১২০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ৯ সেকেন্ড এবং ১৩০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ০১ সেকেন্ডের কম সময় অবস্থান করতে পারেন। যেখানে সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবল শব্দকে সহনীয় হিসেবে ধরা হয়। শব্দ দূষণের ক্ষতির হাত থেকে জনসাধারণকে সুরক্ষা দিতে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ প্রণীত হয়েছে। সেখানে এ এলাকাভেদে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে রাত ও দিন ভেদে সর্বনি¤œ ৪০ ডেসিবল থেকে এবং সর্বোচ্চ ৭৫ ফই শব্দ অনুমোদিত রয়েছে। জরিপে দেখা গেছে রাজধানীর ঢাকার নীরব এলাকায় এর চেয়ে অনেক বেশি শব্দ উৎপাদন হচ্ছে। যা বিশেষজ্ঞরা মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলছেন। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুসারে, নীরব এলাকা অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, উপাসনালয় রয়েছে এমন এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোন প্রকার হর্ন বাজানো যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা হতে ৫শ’ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে ইট বা পাথর ভাঙ্গার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। সন্ধ্যা ৭টা (সাত) হইতে সকাল ৭টা (সাত) পর্যন্ত মিকচার মেশিনসহ নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য যন্ত্র বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে না। কোন ধরনের অনুষ্ঠানে শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী কোন যন্ত্রপাতি দৈনিক ৫ ঘণ্টার বেশি সময়ব্যাপী ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করা যাবে না এবং অনুমোদনের সময়সীমা রাত ১০টা অতিক্রম করবে না।
×