ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

বেলাল চৌধুরী স্মরণাঞ্জলি শব্দের জলে অধ্যয়ণশীল সন্তরণ

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

বেলাল চৌধুরী স্মরণাঞ্জলি শব্দের জলে  অধ্যয়ণশীল সন্তরণ

কবি বেলাল চৌধুরীর জন্য ভালবেসে এক পেয়ালা শব্দ-সুধা সৃজনের এই ব্যর্থ প্রচেষ্টায় তাঁর কবিতার কাছেই হাত পাতি। আজ নিষ্ঠুরনগরী থেকে কবি চলেছেন গাঁয়ের মাটিতে, তার আঁচলে জড়াবেন বলে। বাতাস নিজেই বাঁশি হয়ে সুর তুলছে সকরুণ। এমন প্রহরে ওপরের শিরোনাম পাঠ করি ফের- শব্দের জলে অধ্যয়নশীল সন্তরণ। কবির ‘জল বিষুবের পূর্ণিমা’ কাব্য থেকে নেয়া। পঙক্তিগুলো পুনরায় পড়তে গিয়ে শিহরণ বাড়ে, তবু পাঠ করি : ‘শব্দের জলে আমি অধ্যয়নশীল সন্তরণ করেছি/জুজুবুড়িকে মেরেছি জলের ওপর/আমি মৃত্যুকে কামড়িয়েছি তীক্ষ্ন/খুব আলতোভাবে আমাকে তোলা হলো জল থেকে মসৃণ জালে/ কিছু ভেজা হাত আমাকে ধরল, ছাড়াল জলের বন্ধন থেকে/ ছুড়ে দিল অন্ধকার খালুইর ভেতর- যেখানে আমি/পড়ে রইলাম জলের বাহিরে...’ একি মাছের ডায়েরি, নাকি কবির রোজনামচা! জলহীন মাছ যেন কবি, তবু একদা ছিল শব্দের জলে অধ্যয়নশীল সন্তরণ। কবিতা থেকে কবিকে পৃথক করা চলে না, তবু এই কবিতা কী দারুণ কবিজৈবনিক! আমরা বরং তাঁর কবিতায় কিছুক্ষণ সাঁতার কাটি। দেখব কিভাবে প্রকৃতিপ্রেমের সমান্তরালে বড় হয়ে ওঠে মানবকল্যাণচিন্তা। সুন্দর থাকুক নির্বিঘ্ন নিরাপদ- এটাই প্রকৃত যজ্ঞা। তাই সবুজ অরণ্য নিয়ে তাঁর শুভকামনা : শুধু একটাই কামনা আমার/থাক ওই অরণ্য অক্ষত কুমারী/রঙে রঙে ভেসে যাক সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে/কোন কাঠুরের অনুপ্রবেশ যেন না ঘটে কোনদিন। (অচেনা অজানা থাকো তুমি) এই কবিতা কি কেবলই অরণ্যপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম! যদি বলি এটি ধ্বংস ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী ব্যতিক্রমী উচ্চারণ, তাহলে কি ভুল হবে? সকল কবির জন্য একটি বড় সম্পদ হলো তার ভিন্নতর কল্পনাশক্তি। আর সেইসঙ্গে যদি প্রতীক ব্যবহারে তিনি দেখাতে পারেন সহজাত দক্ষতা, তবে গদ্যের মতো শব্দের সার বেঁধে চলাচলও ধারণ করতে পারে কবিত্বময়তা, মানে কাব্যিক মৃদুচরণ। এর একটি ভাল উদাহরণ হতে পারে ‘আলপিন এবার মানুষ হয়ে যাবে’ কবিতাটি। ঐরাবত বা হাতি হতে পারে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসন-শোষণের প্রতীক। সামান্য শীর্ণকায় আলপিন তার সুচালো প্রান্ত নিয়ে মানুষ হয়ে উঠতে চাইছে এই কবিতায়। ‘অবিবেকী ঐরাবতযুথ কেমন পাশব মদমত্ততায়/স্পর্শকাতর শুঁড় দিয়ে গ্রাস করছে বিশ্বচরাচর/ সামান্য বেঁচে থাকার অধিকার এই নিয়ে ছিল যারা/তাদের তীব্র হাহাকার থেকে আজ ঝাঁক ঝাঁক আলপিন/হুহু করে ছুটে আসছে হে ঐরাবত তোমাদের দিকে/ সমস্ত ঐরাবত এবার মানুষ হয়ে যাবে...’ ‘উপদ্রুত কাল’ কবিতাটি আমার হৃদয় ছুঁয়েছে দুটি কারণে। এক. জামবটজারুলের দেশ রূপসী বাংলার বিমুগ্ধ ছবি এঁকেছেন কবি তুলির এক টানে; দুই. যতোই ঘনাক আঁধার, সময় হয়ে উঠুক অসময়, ঋজু থাকেন কবি তার নির্ধারিত ভূমিকায়- এই স্থিত আদর্শটি। ‘নিষ্ফল রচনা, ফলবতী শ্রমে উপদ্রুত কাল-/দিন যায় নিরবধি, গূঢ় ব্যঞ্জনায় তবু কথা বোনো কবি ॥’ নক্ষত্রের আঙ্গিকে ফোটা রূপালী খইফুল, শালিকের ঠোঁটে ঠোঁটে মরুজ্যোৎ, রৌদ্রঘ্রাণ- এমন প্রশান্তিদায়ক চিত্রকল্পে উজ্জ্বল কবিতাটি। ছবি আঁকায় পারঙ্গমতা চোখে পড়বেই তাঁর বহু কবিতায়। চিত্রপ্রদর্শনীর দেয়ালে দৃশ্যমান শিল্পকর্ম থেকে দর্শকের দৃষ্টি যেমন ক্যানভাস ছাপিয়ে বহুদূর অতি উর্ধে চলে যায়, আবার সৃজন করে চলে নতুন কোন ছবি বা চিত্রমালা- এমন উপাদানও রয়েছে বেলাল চৌধুরীর কবিতায়। ‘দেখা হলো অবেলায়, বইমেলায়’ তেমনই একটি কবিতা। আরও উপভোগ্য হলো এ ধরনের কবিতায় থাকে নাট্যমুহূর্তের মতো উৎকণ্ঠার উদ্ভাসন এবং ছোটগল্পের মতো শেষ হয়েও শেষ না হওয়ার রেশ। কবিতাই কবির ইশতেহার; তবু কবিরা লিখে রাখেন গদ্যে তাঁর কবিতাভাবনা। তিনি লিখেছিলেন, ‘কবিতাকে ভেবেছিলাম জীবনের এক অবশ্যম্ভাবী জরুরী বিষয় হিসেবে। জীবনের অঙ্গ হিসেবে কবিতাকে জড়িয়েও নিয়েছিলাম মনে-শরীরে। কিন্তু কবিতা তো জীবনকে শুষে নেয়। শুষে নেয়ার অসীম এক ক্ষমতা আছে কবিতার। কবি মাত্রেই এই শোষণের শিকার হয়। আমি ছাড়লেও আমাকে ছাড়ে না কবিতা। কবিতার হাত দিয়ে আমি প্রকাশ করে চলি আমার পাপ-পুণ্য, দেখা-অদেখা, ধরা কিংবা অধরাকে। জীবনে বেঁচে থাকার অথবা মৃত্যুতে মরে যাবার উপলব্ধিগুলোকে শব্দে শব্দে যতটা প্রকাশ করতে চেয়েছি- তার কিছু হয়েছে প্রকাশিত, কিছু রয়ে গেছে শব্দের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেই অপ্রকাশিতই তো আমার কবিতাজীবনের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে কবিতাকে সঙ্গী করেছি। কিন্তু উল্টো কবিতাই আমাকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে!’... ২. বেলাল চৌধুরীর তুলনা তিনি নিজেই। এই রকম বন্ধুবৎসল নিরহঙ্কারী প্রচারবিমুখ, উদারমনস্ক, প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক, জীবনবাদী গভীর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ও মনেপ্রাণে আধুনিক মানুষ এই বিক্ষুব্ধ ও জঞ্জালপূর্ণ সমাজে অতি বিরল। সর্বপ্রকার অনুসুয়ামুক্ত, পরোপকারী ও মুক্তমনের অধিকারী উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব আমাদের প্রিয় এই বেলাল ভাই এক কিংবদন্তি পুরুষ। দুই বাংলার সমান জনপ্রিয় সুশ্রী এবং আড্ডাপ্রিয় তিনি এমন একজন মানুষ যিনি প্রথম দেখাতেই সবাইকে আকর্ষণ করার বিরল ক্ষমতা রাখেন। তার প্রথম প্রেম মানুষ তারপরে কবিতা। ওপরের কথাগুলো এক্ষুনি পড়লাম কবির দীর্ঘকালের বন্ধু সহোদরপ্রতীম কবি রবিউল হুসাইনের ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ থেকে। সত্যিই তো। একে একে খসে পড়ছে নক্ষত্র, ফলে দেশের সাহিত্যাঙ্গন নিষ্প্রভ হয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতিহাসের একেকটি অধ্যায়ের যেন অবসান ঘটে চলেছে। মহীরুহ অনুপস্থিত হয়ে গেলে শূন্যতার বোধের পাশাপাশি অসহায়ত্বের অনুভূতিও জেগে ওঠে। বেলাল চৌধুরীর মতো অভিভাবকতুল্য সাহিত্য-ব্যক্তিত্বের চলে যাওয়ার অর্থ কী সেটি অনুধাবনের জন্য সমকাল থেকে দূরবর্তী হওয়ার দরকার পড়বে না। ঢাকা-কলকাতার লেখকসমাজে অদৃশ্য সেতুবন্ধস্বরূপ ছিলেন তিনি বহু যুগ। এক্ষেত্রে তিনি একক ও বিশিষ্ট। তাঁর বিকল্প তৈরি হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। পাঠক হিসেবে ছিলেন সর্বভূক ও নিবিষ্ট। ইন্টারনেট প্রচলনের আগে তিনি ছিলেন দেশের গুটিকতক সাহিত্যিকদের অন্যতম যাঁর কাছে পাওয়া যেত বিশ্বসাহিত্যের হালফিল খবর ও বিশ্লেষণ। ভবঘুরে ও আড্ডাবাজ দিলখোলা মানুষ হিসেবে তাঁর একটা পরিচয় গড়ে উঠেছিল। কাছের লেখকরাই শুধু জানতেন তাঁর বিশ্বসাহিত্যজ্ঞান ছিল কতটা বিস্তৃত। নোবেলবিজয়ী লেখক গুন্টার গ্রাস একবার এসেছিলেন ঢাকায়। পুরনো ঢাকা সফর তাঁর জন্য জরুরী। উপন্যাসে ব্যবহার করবেন তিনি সেই অভিজ্ঞতা। সে সময় একমাত্র বেলাল চৌধুরী ছাড়া আর কেই বা ছিলেন যিনি ওই খ্যাতিমান জার্মান লেখককে সঙ্গ দেবেন? তাঁর দেশের গ্যেটে বা টমাস মানের প্রসঙ্গ যদি উঠেই যায় আড্ডায় তাহলে কথার পিঠে কথা চালানোয় সমঅবস্থান বজায় থাকতে হবে না! সাহিত্যনির্ভর সাময়িকী সম্পাদনার ক্ষেত্রেও বেলাল চৌধুরীর আসন ছিল উঁচুতে। সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী, ভারতবিচিত্রা সম্পাদনা তাঁর গুরুত্বপূর্ণ পেশাদার কাজ। তিনি পাঠকপ্রিয় কবি হয়ত ছিলেন না, যদিও তাঁর কবিতায় একটা অন্যরকম স্বাদ বরাবরই ছিল, যা দিব্যি প্রতিদিনের বাস্তব জীবনের সঙ্গে মানিয়ে যায়। আবার তা একইসঙ্গে বৈদেশিক কবিতারও মিত্রবন্ধুসুলভ। স্বভাবগত রঙ্গরস, বিদ্রুপ এবং ভিন্নতর অভিব্যক্তি পাওয়া যেতো তাঁর কবিতায়। লেখক-সম্পাদক-বান্ধব-অভিভাবক- সব ভূমিকা মিলিয়ে সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তাই। যে কেউ তাঁর সঙ্গে নিঃসংকোচে কথা বলতে পারত, বন্ধু হয়ে উঠতে পারত। দীর্ঘ জীবনই তিনি পেলেন, কিন্তু কে না জানে তাঁর মতো প্রাণবন্ত এক সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য আশি বছরও কত কম। খেদের সঙ্গে বলতে হয়, ধীরে ধীরে আমাদের সাহিত্যভুবন এমন একটি অবয়ব ধারণ করেছে যে সত্যিকারের ভালো মানুষ রীতিমতো দুর্লভ হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। বেলাল চৌধুরী ছিলেন একজন পরোপকারী ভাল মানুষ। কে পায়নি তাঁর উপকার? নব্বই দশকের শুরুর দিকে সাহিত্য মাসিক মাটি সম্পাদনার কাজে যুক্ত হয়েছিলাম। তখন তাঁর কাকরাইলের বাসায় যাওয়া পড়ত। মাটির প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশিষ্টজনদের মন্তব্য সংগ্রহ করেছিলাম আমরা। একদিন তিনি আমার চাকরিস্থল দৈনিক বাংলার বাণীতে এসে উপস্থিত। আমি তখন পেস্টিং রুমে। সেখানে এসেই বললেন, তোমাকে রুমে না পেয়ে এখানে এসেছি। কাগজ-কলম দাও, আমার মন্তব্য লিখে দিচ্ছি। লিখলেন: ‘সাদাসিধে মাটি নামের সর্বাঙ্গসুন্দর মাসিক পত্রিকাটি বাংলাদেশে একটি নির্ভেজাল খাঁটি সাহিত্য পত্রিকার একান্ত অভাবকে পূর্ণ করে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে। সদাহাস্যময় তরুণ কবি মারুফ রায়হান অবিচল নিষ্ঠা ও একান্ত অধ্যবসায়ের সঙ্গে অসাধ্য সাধন করেছেন...।’ কতটা উদার না হলে একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ও সম্পাদক নবীন একজনের কাজ নিয়ে এমনভাবে লিখতে পারেন। মানুষকে ভালবাসার, তার কোন উপকারে আসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন আমাদের প্রিয় বেলাল ভাই। তাঁর প্রস্থানে আজ সর্বস্তরের মানুষের মন কাঁদছে। কারু বিদায়বেলায় গভীর বেদনাবোধের মতো অমূল্য সম্পদ অর্জন করা যায় কেবল সত্যিকারের ভালবেসেই। ২৫ এপ্রিল ২০১৮ [email protected]
×