ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিমানের দুর্নীতির তিন খাত চিহ্নিত, বন্ধে দুদকের সুপারিশ

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২১ এপ্রিল ২০১৮

বিমানের দুর্নীতির তিন খাত চিহ্নিত, বন্ধে দুদকের সুপারিশ

মশিউর রহমান খান ॥ রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনে এগোতে পারছে না। স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থাটির উন্নয়নে সব সরকার চেষ্টা করলেও বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি হওয়ায় প্রতিনিয়ত উন্নয়ন কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের কাছে সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেন। এতেই এসব তথ্য উঠে আসে। বার্ষিক রিপোর্টে প্রতিষ্ঠানটির নানা খাতের দুর্নীতির কথা উল্লেখ করা হয়। দুর্নীতি বন্ধে তিনটি নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে দুদক নানা সুপারিশ করে। খাত তিনটি হচ্ছে বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহলিং, ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টার (বিএফসিসি), মার্কেটিং, সেলস এবং প্রকিউরমেন্ট শাখা। তিনটি খাতেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহলিং খাতের দুর্নীতি বন্ধে চার দফা সুপারিশ করেছে দুদক। দুদক সুত্র জানায়, বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দুদকের পক্ষ থেকে বিমানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম ক্রয়ের তালিকাসহ ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ইজিপি বাধ্যতামূলক করা, ক্রয়ের সকল রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দুর্নীতির চিত্র বোর্ডসভায় উপস্থাপন করা, ক্রয় কমিটিতে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া ও তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন সংস্থা থেকে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ক্রয় কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। মেইনটেন্যান্স ও ওভারহোলিং খাতে কেনাকাটার সময় আন্তর্জাতিক দরপত্রের নিয়ম সঠিকভাবে পরিপালন হচ্ছে কিনা তা দেখতে বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা, আন্তর্জাতিকমানের শেফ নিয়োগ দিয়ে বিমানের খাবারের মান উন্নয়ন করা, অপচয় বন্ধে নজরদারি বৃদ্ধি, সরকারের বাইরে বেসরকারী অন্যান্য উড়োজাহাজ সংস্থা যাতে বিমানের ক্যাটারিং থেকে খাদ্য ক্রয় করে তার উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। দুদক সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দুর্নীতি বিরোধী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দমনের অংশ হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসংক্রান্ত একটি টিম গঠন করে। অনুসন্ধান শেষে এই টিম তিনটি খাতে দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে। একই সঙ্গে দুর্নীতি বন্ধে খাত তিনটির জন্য পৃথক করে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুদকের কাছে। সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রপতির কাছে বার্ষিক রিপোর্ট জমা দেন। দুদকের দেয়া প্রতিবেদনে দুর্নীতির ধরন ও তার প্রভাব সম্পর্কেও বর্ণনা করা হয়েছে। মূলত উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতির কারণেই লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইনসটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় রক্ষণাবেক্ষণ খাতে। এ খাতে বিমানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটা হয়। বিমানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে শত শত কোটি টাকা আত্মসাত করা হয়। নিম্নমানের যন্ত্রাংশ অতি উচ্চমূল্যে ক্রয় দেখিয়ে ঠিকাদার ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে অর্থ আত্মসাত করা হয়। এছাড়া মেরামতের জন্য উড়োজাহাজ দেশে ও প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশেও পাঠানো হয়। এসব কেনাকাটার ক্ষেত্রে দরপত্রে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়। বিমানের বোর্ড পরিচালক ও কর্মকর্তারা নিজেরা লাভবান হওয়ার উদ্দেশে তাদের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার নিয়োগ করে কার্যাদেশ দেন। রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহলিং খাতের দুর্নীতি বন্ধে চার দফা সুপারিশ করেছে দুদক। এর মধ্যে প্রথম সুপারিশ হচ্ছে বিমানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম ক্রয়ের তালিকা, কখন কেনা হয়েছে, কী দামে কেনা হয়েছে, কোন্ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনা হয়েছে, কত টাকা মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে; এসব রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দুর্নীতির চিত্র বোর্ডসভায় উপস্থাপন করতে হবে। দ্বিতীয় সুপারিশ হিসেবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শান্তি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তৃতীয় সুপারিশে মেইনটেন্যান্স ও ওভারহলিং খাতে কেনাকাটার সময় আন্তর্জাতিক দরপত্রের নিয়ম সঠিকভাবে পরিপালন হচ্ছে কিনা, তা পর্যালোচনা করতে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠনের কথা বলা হয়েছে। চতুর্থ সুপারিশে বর্তমানে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি টাকার দুর্নীত সংঘটিত হয়। তাই টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ই-জিপি বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় খাত হিসেবে প্রতিবেদনে বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টারের (বিএফসিসি) দুর্নীতির বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের কারণে কেবল বিএফসিসি খাতে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন বিমান। ক্যাটারিং সার্ভিসের দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদক তিন দফা সুপারিশ করেছে। সেগুলো হলো আন্তর্জাতিকমানের শেফ নিয়োগ দিয়ে খাবারের মান উন্নয়ন করা, অপচয় বন্ধে নজরদারি বৃদ্ধি এবং অন্যান্য উড়োজাহাজ সংস্থা যাতে বিমানের ক্যাটারিং থেকে খাদ্য কেনে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে দুর্নীতির আরেকটি উৎস হিসেবে সংস্থাটির মার্কেটিং, সেলস এবং প্রকিউরমেন্ট শাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিমানের যন্ত্রপাতিসহ সকল প্রকার ক্রয় এ শাখার মাধ্যমেই করা হয়। তবে শাখায় তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বাইরে কর্মকর্তাদের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠান থেকেও মালপত্রসহ স্পেয়ার পার্টস কেনা হয়। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিল-ভাউচার তৈরি করে অর্থ আত্মসাত করেন কর্মকর্তারা। এ শাখার দুর্নীতি বন্ধে ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুদকের সুপারিশ হচ্ছে সরকারের পিপিআর সঠিকভাবে ফলো করা ও মার্কেটেং সেলস ও প্রকিউরমেন্টে আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ নিশ্চিত করা । এছাড়া ক্রয় কমিটিতে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করেছে দুদক। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থা থেকে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ক্রয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি। বিমানের দুর্নীতি নিয়ে দুদকে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের যে কোন প্রকার অনিয়ম বা দুর্নীতি বন্ধে যদি সুপারিশ করে তাহলে এসব সুপারিশ আমাদের কাছে এলে অবশ্যই তা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে দুদকের সুপারিশমালা এখনও আমাদের কাছে এসে পৌঁছেনি। প্রাপ্তির পর এসব বিষয়ে উর্ধতনদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দমনের অংশ হিসেবে আমরা তা বন্ধ করতে পদক্ষেপ নেব।
×