ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় কালক্ষেপণ করছে মিয়ানমার

ইয়াবা পাচার ও খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২০ এপ্রিল ২০১৮

ইয়াবা পাচার ও খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ গত বছরের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সাত মাস সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাবাসনের বিষয়টি অকার্যকর হয়ে থাকায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ দিন দিন বিভিন্ন অপরাধ ও বেআইনী তৎপরতায় জড়িয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে মাদক ইয়াবা পাচারের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া। এছাড়া রয়েছে মানবপাচার, চুরি, ডাকাতি ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে যাওয়া। ফলে উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলে সার্বিক পরিস্থিতি কেবলই বিপর্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করার ঘটনাও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থার একাধিক সূত্রে স্বীকার করা হয়েছে, রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ইয়াবা, মানবপাচার, ডাকাতি ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। দেশীয় অস্ত্রসহ বদিউল আলম নামে এক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। বৃহস্পতিবার সকালে কুতুপালং বাজারে র‌্যাব সদস্যদের অভিযানে অস্ত্রসহ এই বদিউল আলম গ্রেফতার হয়। গ্রেফতার রোহিঙ্গা বদিউল আলম বালুখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্প সি-ব্লকের আশ্রিত গ্রহণকারী রোহিঙ্গা ও মৃত আমীর আলীর পুত্র। র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন জানিয়েছেন, কয়েক সন্ত্রাসী কুতুপালং বাজারে সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত অভিযানে দেশীয় অস্ত্রসহ বদিউল আলমকে গ্রেফতার করা হয়। মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশের সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বহু সন্ত্রাসী অস্ত্রসমেত এসেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এরা বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত হলেও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ থেকে নিজেদের বিরত রাখছে না। প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক ৫ রোহিঙ্গাকে এসব সন্ত্রাসীরা খুন করেছে। দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবিরগুলো বিভিন্ন অপরাধে অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর গত সাত মাসাধিকাল সময়ে আশ্রয় শিবিরগুলোতে পনের খুনসহ নানা অভিযোগে মামলা হয়েছে দেড় শতাধিক। গ্রেফতার হয়েছে সাড়ে তিন শ’ রোহিঙ্গা। কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্র মতে, গেল বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে টেকনাফ এবং উখিয়া থানায় রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় ৩৩৬ জনকে আসামি করে ১৬৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অস্ত্র আইনে ১২টি মামলায় ৩০ জন, মাদক আইনে ৫৮টি মামলায় ৮৯ জন, পাসপোর্ট আইনের ৪১টি মামলায় ৭১ জন, ধর্ষণ আইনে ২টি মামলায় ২ জন, অপহরণ আইনে ৩টি মামলায় ৯ জন, চোরাচালান আইনের ৫টি মামলায় ১২ জন, চুরি আইনের ১টি মামলায় ১ জন এবং ডাকাতির আইনের ৫টি মামলায় ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। বর্তমানে টেকনাফ ও উখিয়ার ২০ ব্লকে ভাগ করা আশ্রয় শিবিরগুলোতে নতুন-পুরাতন মিলে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। দুইটি উপজেলায় টেকনাফ ও উখিয়া থানা পুলিশের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় ৫টি নতুন পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে যাওয়া ঠেকাতে ৩২টি চেকপোস্ট রয়েছে। তারপরও রোহিঙ্গারা যত্রতত্র চলাফেরাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। সূত্র মতে, টেকনাফ বাহারছড়া, উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা মাদকের আস্তানা গড়ে তুলেছে। এতে হুমকির মুখে স্থানীয় উঠতি তরুণ ও ছাত্র সমাজ। টেকনাফের শামলাপুর ক্যাম্পটি সমুদ্র ঘেঁষা হওয়ায় ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গারা সাগর পথে ইয়াবার চালান এনে ঢুকাচ্ছে ওই ক্যাম্পে। আবার সীমান্ত থেকে অতি কাছাকাছি হওয়ায় রোহিঙ্গারা বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে ইয়াবার চালান এনে সরবরাহ দিচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু মাদকের চালান আটক করলেও বেশির ভাগ চালান কৌশলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গন্তব্য স্থানে। মাদক ব্যবসায়ী রোহিঙ্গারা তাদের ক্রেতার সুবিধার্থে অনেক সময় তাদের সঙ্গে ক্রেতাকে মেহমান হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্ষণিকের জন্য আশ্রয় দেয়। নগদ টাকা বুঝে নেয়ার পর রোহিঙ্গারা রেশন তুলতে বা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটা করতে যাবার ভান করে ইয়াবার চালান সড়কের পাশে এনে পৌঁছে দেয়। নোয়াখালীপাড়া, জাহাজপুরা, হলবনিয়া, মাথাভাঙ্গা, বড় ডেইল, কুতুপালং, শৈলেরডেবা, মাছকারিয়া, ফলিয়াপাড়া, বালুখালী পানবাজার, থাইংখালী ও কাস্টম এলাকার চিহ্নিত বিক্রেতারা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ইয়াবা ক্রেতা। প্রসঙ্গত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ইতোমধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছে। এই প্রকল্পে বরাদ্দের ১ হাজার ৩১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এককালীন ছাড় করছে সরকার। যার মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ৭৬৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা অগ্রিম উত্তোলন করবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই অর্থ ছাড় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের অনুমোদিত আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের জন্য সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দকৃত অর্থ হতে ১ হাজার ৩১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এককালীন ছাড় করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে এই অর্থ থেকে ৭৬৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা অগ্রিম উত্তোলনেরও অনুমতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পটি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে বাস্তবায়ন হচ্ছে। যেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার আবাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। প্রকল্পে মোট ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের নবেম্বর মাসে শেষ হবে। বিদেশী সহায়তা ছাড়াই সম্পূর্ণ দেশজ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, এ অর্থ দিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পুনর্বাসন করা হবে। ১ লাখ ৩ হাজার ২০০ মানুষের বসবাসের জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ভাসানচরের অভ্যন্তরে সড়ক, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, নলকূপ বসানোসহ যাবতীয় অবকাঠামো তৈরি হবে। এদিকে, বর্ষা মৌসুম আসন্ন। লাখ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পে গিজ গিজ করছে। পাহাড় ধস বা ভূমি ধস হওয়ার আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি প্রাণহানির বিষয়টিও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বা স্থানান্তরের বিষয়টি যতই বিলম্বিত হচ্ছে ততই নানা শঙ্কা ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। অপরদিকে, জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্সসহ শক্তিশালী বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে সোচ্চার রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এ ইস্যুর সমাধানের প্রক্রিয়া কেবলই কালক্ষেপণ করে চলেছে। বিভিন্ন ছলচাতুরির মাধ্যমে বিষয়টি বিলম্বিত করার প্রক্রিয়া সকলের কাছে স্পষ্ট। এরপরও চলতি মাসের শেষদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল প্রথমে মিয়ানমার ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সফরের পর কি বক্তব্য আসে সেদিকেই নজর সংশ্লিষ্ট ও আগ্রহী মহল।
×