ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মইনুল ইসলাম

আমাদের উন্নয়ন ও স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

আমাদের উন্নয়ন ও স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র

আমাদের দেশ ও জনগণের পরম আরাধ্য বিষয় হচ্ছে উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমাদের দারিদ্র্য মোচনের মহৌষধ। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষার মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলোর অভাবে যুগ যুগ ধরে জর্জরিত মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত সচ্ছল জীবন চায়। ক্ষুধা এবং অভাবের হাত থেকে মুক্তি তাই এক বড় স্বাধীনতা। এর সুবাদে মানুষ রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদও উপভোগ করতে পারে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার সম্মিলিত সুফল হলো প্রকৃত স্বাধীনতা। আর এ কারণেই নোবেল বিজয়ী বাঙালী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘Development means freedom’ বা উন্নয়ন বলতে বোঝায় স্বাধীনতা। আমরা ’৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তবে এখন আমাদের প্রচেষ্টা বা সংগ্রাম চলছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রে জনগণের ক্ষমতা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে আমাদের যে সংগ্রাম চলছে, তার শত্রু-মিত্র শনাক্ত করাই আলোচ্য নিবন্ধের উদ্দেশ্য। একটি দেশের উন্নয়নের পথে অনেক বাধা থাকে। এগুলোই উন্নয়নের শত্রু। বাংলাদেশের এ শত্রুদের মোটা দাগে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো সন্ত্রাস এবং অন্যটি হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি এক ধরনের নীরব সন্ত্রাস। এই সামাজিক সন্ত্রাসগুলো আমাদের উন্নয়নের পথে বড় বাধা তথা মহাশত্রু। সাধারণ সন্ত্রাসগুলো হচ্ছে গুম, খুন, অপহরণ, জিম্মিকরণ এবং মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি। এর সঙ্গে যোগ করা যায় ক্ষমতার দাপট প্রদর্শন, আধিপত্য বিস্তার, নদ-নদী, পাহাড়-বনভূমি দখল বা ধ্বংস করা। প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ এবং উপাচার্যকে অপমান ও নির্যাতন এবং নারী নির্যাতন ও শ্লীলতাহানির মতো ঘৃণ্য সন্ত্রাস। রাজধানী ঢাকা শহরে ডিবি পরিচয়ে গুম, খুন, অপহরণ, জিম্মিকরণ এবং মুক্তিপণ আদায়ের দুর্ঘটনার কথা প্রায়ই শোনা যায়। এ ধরনের অশুভ চক্র এবং এদের নায়কদের নানা অপকর্মের খবর দেশের নানা জায়গা থেকেও পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছাত্র নামধারী একদল বিপথগামী যুবকও আছে যাদের নানা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য এরা দেশব্যাপী খ্যাতি লাভ করেছে। এদের অসংখ্য অপকর্মের মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কয়েকটি দুর্ঘটনা উল্লেখ করলেই এদের প্রকৃত রূপটি ফুটে উঠবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারি গত কয়েক বছর ধরেই চলছে। এর মধ্যে একদল আত্মহত্যা করেছে। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের কারণ হচ্ছে ২২ কোটি টাকার টেন্ডারটি তাদের পছন্দের ঠিকাদার না পাওয়া। ফলে তারা প্রক্টর অফিসসহ কয়েকটি অফিসে ভাংচুর চালিয়েছে। কিছু দিন আগে উত্তর চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে বিবদমান পক্ষের তা-ব থামাতে মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের হাত জোর করে নিবৃত্ত করার আবেদনের ছবি টিভিতেই দেখা গেল। ইতোমধ্যে খুনের দায়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যুদ-ের আদেশ হয়েছে। এর আগে বিশ্বজিৎ হত্যায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যুদ- এবং কয়েকজনের যাবজ্জীবন কারাদ-ের ঘটনাও এখানে উল্লেখযোগ্য। ইদানীং কুষ্টিয়ায় হাসপাতালে চিকিৎসক এবং পুলিশকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। মাত্র কয়েকদিন আগে সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের নতুন করে মারামারির দুর্ঘটনাটিও বলার দাবি রাখে। এ ব্যাপারে শুধু এটুকুই বলা যায়, ছাত্র নামধারী একদল বিপথগামী যুবক কাজ করছে। শাসক দল আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী এবং উন্নয়নকামী দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। দেখা যাচ্ছে, উপরোক্ত সাধারণ সন্ত্রাসীরাই হোক বা নেতাকর্মীরাই হোক তারা শাসক দলের নামকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বিএনপি আমলে একই কাজ ছাত্রদল এবং যুবদলও করেছে। শাসক দলের নেতাকর্মী থেকে সন্ত্রাস এবং দুর্নীতি করা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে দুর্নীতিবাজ এবং সন্ত্রাসীরা সে দলের অনুসারী বা নেতাকর্মী সেজে যায়। রাজনৈতিক পরিচয়ে তাদের অপকর্ম সহজসাধ্য হবে কিংবা আইনের হাত থেকে রক্ষা পাবে, সে ভরসাই যে তাদের সাহস যোগায় তা সহজেই অনুমেয়। সন্ত্রাসের আরেকটি সংস্করণ হচ্ছে ঘুষ দুর্নীতি। এটি একটি নীরব কিন্তু সুপরিকল্পিত এবং সরকারের প্রায় সব অফিসে বিরাজমান এক মহাঅভিশাপ। তাছাড়া আছে সরকারী মালিকানার ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট। সে লুটপাট যেমন ভুয়া ঋণ প্রদানের মাধ্যমে হয়, তেমনি হয় ঋণ খেলাপীর মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শীর্ষ ২৫ ঋণখেলাপীর কাছে আটকে পড়েছে ১০ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। ঋণখেলাপী ছাড়াও আছে সরাসরি লুটপাটকারীদের দল। সোনালী ব্যাংকের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারী নেতা হলমার্কের তানভীর, বেসিক ব্যাংকের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের নায়ক শেখ বাচ্চু এবং জনতা ব্যাংকের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হাজী ইউনুস বাদল। ইউনুস বাদল অবশ্য অভিযোগটি অস্বীকার করেছে। তবে সরকারী ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা ধনী হওয়ার বহু ঘটনা দেশবাসী জানে। দুর্নীতির এই ভয়াবহতা সরকারী দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যেমন ইদানীং অকপটে স্বীকার করে, তেমনি বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির ওপর নজর সরকারী বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআইয়ের জরিপেও ধরা পড়ে। গেলবারের টিআই জরিপে বিশ্বের ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৩ নম্বরে। আগের বছরে ছিল ১৪৫ নম্বরে। আমাদের দুই ধাপ অগ্রগতি হয়েছে বটে। তবে প্রাপ্ত নম্বর এক শ’য়ের মধ্যে মাত্র ২৮। অথচ সারাবিশ্বের গড় হচ্ছে ৪৩। আর দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশের মধ্যে আমরা ২ নম্বর দুর্নীতিবাজ দেশ এবং মাত্র আফগানিস্তানের ওপরে আমাদের অবস্থান। সম্প্রতি জেনেভায় জাতিসংঘের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক কমিটি বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা দাবি করেছে, সরকার যেন দুর্নীতির দমন আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করে এবং এ ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা ও রাজনীতিকদের ছাড় দেয়া না হয়। তারা মনে করে দুর্নীতি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারকে মারাত্মকভাবে বিঘিœত করছে (দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারে উদ্বেগ, প্রথম আলো ০৫-০৪-১৮)। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিবছর আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষতি করে ২ থেকে ৩ শতাংশ। সুখের কথা এর মধ্যেও দেশ এগিয়ে চলছে। জাতিসংঘের মতে আমরা ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। তবে সন্ত্রাস এবং দুর্নীতি আমাদের জীবন ও স্বাধীনতার জন্য হুমকি হিসেবে বিরাজ করছে। পরিশেষে বলব আমাদের উন্নয়ন ও স্বাধীনতার বড় শত্রু হচ্ছে সন্ত্রাস এবং দুর্নীতির নায়করা। অন্যদিকে এ বিষয়ে আমাদের মিত্র হচ্ছে দেশের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যারা ক্ষেতে-খামারে কল-কারখানায়, বিদ্যালয়, হাসপাতাল এবং নানা সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নিত্যদিনের কাজকর্মের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×