ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা বাড়ছে নিরাপদ নয় ফুটপাথ, আইল্যান্ডও পথ চলায় সাবধান হোন- সামনেই মৃত্যুদূত!

রাজপথে মরণখেলা ॥ অদক্ষ চালকের বেপরোয়া ড্রাইভিং

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১৪ এপ্রিল ২০১৮

রাজপথে মরণখেলা ॥   অদক্ষ চালকের বেপরোয়া ড্রাইভিং

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিপজ্জনক ঢাকার পথ! যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে অনাকাক্সিক্ষত সড়ক দুর্ঘটনা। ফুটপাথ কিংবা আইল্যান্ড ধরে হাঁটলেও জীবনের নিশ্চয়তা নেই। রাস্তা পারাপারে ঝুঁকি তো রয়েই গেছে। কারণ, সামনে-পিছে বেপরোয়া চালক। মৃত্যুদূত। তার ইচ্ছা হলেই জীবন কেড়ে নিতে পারে! বাস্তবতা হলো, কোন অবস্থাতেই চালকের বেপরোয়া পথচলা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকদের একটা বড় অংশ লাইসেন্সবিহীন। অপেশাদার। ঢাকার সরকারী তিতুমীর কলেজের স্নাতকের ছাত্র রাজীব গত ৩ এপ্রিল রাজধানীতে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের রেষারেষিতে হাত হারান! দুই বাসের চাপায় তার ডান কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় রাজীবের মাথার সামনে-পেছনের হাড় ভেঙ্গে যাওয়া ছাড়াও মস্তিষ্কের সামনের দিকে আঘাত লাগে। প্রথমে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নেয়া হলেও সেখান থেকে পরে তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তার চিকিৎসার জন্য গঠন করা হয় মেডিক্যাল বোর্ড। সর্বশেষ লাইফ সাপোর্টে নেয়ার ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তার শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। দুলছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আশা-নিরাশার দোলাচলে রাজীবের পরিবার। চিকিৎসকরাও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু এমন তো হবার কথা ছিল না। বাবা-মা নেই। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাজীব বড়। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি চাকরিও করত সে। সামান্য উপার্জন দিয়ে তিন জনের জীবন চলত কোন রকমে। কিন্তু যিনি ছোট ভাইদের বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালবাসায় আগলে রেখেছিলেন তিনিই এখন বাঁচা-মরার লড়াই করছেন। তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে যেতে বসেছে তিন ভাইয়ের স্বপ্ন। অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু যেন বদলে গেল। সত্যিই, চোখে পানি চলে আসার মতোই ঘটনা। সেদিন চোখের সামনে যারা রাজীবের হাত ছিঁড়ে যেতে দেখেছেন তারা এখনও ঘুমোতে পারেন না। এমন বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছে সড়কে মানুষের নিরাপত্তা! এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বুধবার ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে নিউভিশন পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাস বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রুনী আক্তারের ওপর উঠে যায়। এতে তার ডান পা থেঁতলে যায়। গুরুতর আহত এই শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবেন কিনা এ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। রাজধানী ঢাকার রাজপথে বাস চলাচলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা নিত্যদিনের চিত্র। কমবেশি সব বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া যায়। পুলিশ ও সাধারণ যাত্রীর বক্তব্য, চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি না হওয়ায় দিন দিন সমস্যা বাড়ছে। তাছাড়া লাইসেন্সবিহীন চালকের দৌরাত্ম্য বাড়ছে সমানতালে। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো, যানজট। কারণ বেশিরভাগ চালক ভাড়ায় (চুক্তিতে) বাস পরিচালনা করে। কিন্তু যানজটের কারণে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। যখন সড়ক ফাঁকা থাকে তখন বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে যাত্রী পাওয়ার আশা ও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা বাড়ে। এতে দুর্ঘটনাও বাড়ছে দিন দিন। ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চালকদের নিয়মের মধ্যে আনার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে যা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য পরিবহন মালিক, শ্রমিকের পাশাপাশি যাত্রীদের সচেতন হতে হবে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, রাজধানীর ২৭৯ রুটে যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাসের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বেতনভুক্ত চালক দিয়ে লোকাল (বাস) গাড়ি চালালে মালিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে নগরীর অধিকাংশ পরিবহন মালিক তাদের বাস-মিনিবাস চালককে চুক্তিতে চালাতে দিচ্ছে। চুক্তির কারণেই চালকরা বেপরোয়া। এ কারণে একই রুটের বাসের মধ্যেই ভয়াবহ মরণ রেস দেখা যায়। আর এ প্রতিযোগিতার কারণেই এ রেসের পরিণতি হয় দুর্ঘটনা। সূত্র জানায়, রাজধানীতে চালকের মরণ রেসের কারণে কয়েক বছর আগে শাহবাগ শিশু পার্কের সামনে এক কিশোরের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। একইভাবে বছরখানেক আগে মৌচাকে দুই বাসের মাঝে পড়ে এক যুবক নিহত হয়। চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কথা স্বীকার করে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আমরা চেষ্টা করছি চালকদের দক্ষ করে তোলার জন্য। এজন্য সমাজের সকল পর্যায় থেকে সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি বলেন, শিক্ষিত বেকারদের চালকের পেশায় আনার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি বলেন, সঙ্কট সমাধানে কয়েকটি কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল আমিন নুরু বলেন, অনেক চালকের বৈধ লাইসেন্স না থাকায় সংগঠনের পক্ষ থেকে সব সময় সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তিনি বলেন, চালকের সিংহভাগই অল্প শিক্ষিত। লাইসেন্স প্রাপ্তির বিষয়টি জটিল। এ কারণে লাইসেন্স নেয়ার ইচ্ছা থাকলেও অনেকে নিতে পারে না। সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের বার বার নিয়ম মেনে গাড়ি চালানোর জন্য চেষ্টা হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক চাই কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, বাস চালকরা কাউকেই মানছে না। এক প্রকার ফ্রি স্টাইলে গাড়ি চালাচ্ছে। চাকায় পিষ্ট হয়ে বা ধাক্কায় কে মরল, আহত হলো তা দেখার সময় নেই। তিনি বলেন, বর্তমানে চালকরা সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গত বছরের চেয়ে সাড়ে ২৮ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে। তিনি বলেন, আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। একের পর এক যাত্রী প্রাণ হারালেও কয়টা চালকের শাস্তি হয়েছে? প্রশ্ন রাখেন তিনি। পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, অধিকাংশ চালকই রোজভিত্তিক গাড়ি চালাচ্ছেন। এতে চালকরা ব্যাকুল রোজগার বাড়াতে। বিআরটিএ ১৫ থেকে ১৬ লাখ লাইসেন্স দিয়েছে কিন্তু গাড়ি চলছে ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ। বুয়েটের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, রাজধানীতে যেমন চালক-মালিকরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকরাও তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। পুরো সড়ক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে দিন দিন এমন ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা বাড়বে। তিনি বলেন, পুরো রাজধানীতে একটি শক্তিশালী সংস্থার মাধ্যমে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ-চালানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য দেড় শ’ থেকে ২শ’ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রায় ২ হাজার স্টাফ দিয়ে একটি সংস্থা গঠন জরুরী। যারা পুরো ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এমন সিস্টেম করতে হবে যাতে কোন অবস্থায়ই সিরিয়াল ব্রেক করে কোন বাস ওভারটেক করতে পারবে না। প্রতি রুটে ২ মিনিট পরপর বাস চলার ব্যবস্থা রাখা দরকার। বিআরটিএ থেকে গত ১ এপ্রিল পাওয়া তথ্যানুসারে, দেশে ২০ ধরনের ৩৩ লাখ ৮২ হাজার ২৪৭টি গাড়ির নিবন্ধন আছে। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫২টি। তাতেই ধরা পড়ে ৯ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৫টি নিবন্ধিত গাড়ি চালানোর বৈধ চালক নেই। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫২টি লাইসেন্স পেয়েছে ১৯ লাখ চালক। কারণ অনেক চালকের একাধিক লাইসেন্স রয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি, ঢাকা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুসারে, দেশে কমপক্ষে ১০ লাখ অননুমোদিত যানবাহন আছে। এসবের মধ্যে সিএনজিচালিত তিন চাকার গাড়ি পাঁচ লাখ। বিআরটিএতে অনুমোদন আছে দুই লাখ ৪২ হাজার ৮৮২টির। বাকিগুলোর নিবন্ধনই নেই। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোঃ হানিফ খোকন বলেন, ঢাকা শহরে ভাড়ায় চালানোর জন্য ১৩ হাজার ৬৫২ বৈধ অটোরিক্সা আছে। এগুলোর বিপরীতে বৈধ চালক আছে প্রায় ১০ হাজার। কিন্তু একবেলা ও দু’বেলা চালানোর জন্য সব মিলে চালক আছে প্রায় ৩০ হাজার। এখানে লাইসেন্স ছাড়া চালক ২০ হাজার। রাজধানীতে কোথায় কোথায় দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, সে তথ্য উঠে এসেছে বুয়েটের গবেষণায়। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এমআরআই) তথ্যমতে, রাজধানীতে মানুষ বেশি, যানবাহনও বেশি। তাই এখানে দুর্ঘটনার হারও বেশি। ঢাকায় এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। একটি আদর্শ মহানগরে ২৫ শতাংশ জায়গা সড়কের জন্য থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় সড়কের জন্য আছে মাত্র ৭ শতাংশ জায়গা। এ কারণে এখানে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটছে। সংস্থাটির গবেষণায় উঠে এসেছে, রাজধানীতে ৫৪ ঝুঁকিপূর্ণ মোড় আছে, যেখানে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। তাতে কেউ নিহত হচ্ছে, কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। আবার কেউ আহত হচ্ছে।
×