ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পরকীয়ায় তছনছ দুটি সাজানো সংসার

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ৭ এপ্রিল ২০১৮

 পরকীয়ায় তছনছ দুটি সাজানো  সংসার

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ৬ এপ্রিল ॥ পরকীয়া প্রেমে তছনছ হয়ে গেল দুটি সাজানো সংসার। এ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক ওরফে বাবু সোনা রংপুরে একটি সুপরিচিত নাম। প্রগতিশীল রাজনীতি, ধর্মীয় সংগঠন, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সকল অঙ্গনে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে ছিলেন তিনি। কতগুলো সংগঠনের কোন্ কোন্ পদে ছিলেন তিনি নিজেও হঠাৎ করে তা সঠিকভাবে বলতে পারতেন না। নিরহঙ্কার, সহজ-সরল, সাদাসিধে জীবন যাপন আর অমায়িক আচরণ দিয়ে চারপাশের সকলের ভালবাসা অর্জন করেছিলেন তিনি। সমাজ সেবামূলক কাজে তার তুলনা নেই। স্পষ্টতই সামাজিক ও সাংগঠনিক কাজে বেশি জড়িয়ে পড়ার কারণে পরিবারের প্রতি মনোযোগ দিতে পারেননি। পরিবারের খুব কাছের মানুষগুলো কত দূরে সরে গেছে তা ভেবে দেখার সুযোগই পাননি। শেষ মুহূর্তে মনোযোগ দিতে গিয়েই জীবনটাই হারালেন। ১৯৯৪ সালের ৮ অক্টোবর একই দিনে ইসলাম ধর্মের শিক্ষক হিসেবে কামরুল ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মের শিক্ষক হিসেবে রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনার স্নিগ্ধা সরকার ওরফে দীপা ভৌমিক তাজহাট হাইস্কুলে যোগদান করেন। সে সময় এ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা ওই স্কুলের সহ-সভাপতি ছিলেন এবং তার কারণে তারা দু’জন নিয়োগ পেয়েছিলেন। তদন্তকারী সূত্রগুলোর দেয়া তথ্য মতে, দীপা ভৌমিক পর পুরুষে আসক্ত ছিলেন। সে কারণে বিয়ের পর থেকেই তাদের পারিবারিক অশান্তি লেগেই থাকত। স্কুলে নিয়োগ পাওয়ার পরপরই কামরুলের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন দীপা ভৌমিক। কামরুলের আগে একই স্কুলের আরও এক শিক্ষকের সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। তাকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গা দখল করে চতুর কামরুল। এ্যাডভোকেট রথীশের আয়-রোজগার যথেষ্ট ছিল। কামরুল পরকীয়া প্রেমের সুবাদে দীপা ভৌমিকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকাও হাতিয়ে নিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা বলেন, যেভাবে এ দু’শিক্ষক মেলামেশা করতেন তা নিয়ে আমরা সহকর্মীরা কনাঘুষা করতাম। কিন্তু স্কুলের সভাপতির বউয়ের বিষয়ে কারও কিছু বলার সাহস ছিল না। বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দু’সন্তানের জননী স্নিগ্ধা ভৌমিক ও এক সন্তানের জনক কামরুল ইসলামের পরকীয়া প্রেমের গল্প। প্রায়ই প্রতিষ্ঠান ছুটির পর সব শিক্ষকদের পরে বের হতেন স্নিগ্ধা ও কামরুল। প্রায়ই তারা মোটরসাইকেলে করে দূরে নিভৃত স্থানে গিয়ে সময় পার করত। এ্যাড. রথীশ ভৌমিকের দুই সন্তানের মধ্যে এলএলবি অনার্স পড়ুয়া পুত্র ঢাকায় থাকতেন। নবম শ্রেণী পড়ুয়া কন্যা থাকত বাসায়। কন্যা স্কুলে চলে যাওয়ার পর কামরুল পেছনের দরজা দিয়ে স্নিগ্ধার বাসায় গিয়ে গোপনে অবৈধ মেলামেশা করত। বিষয়টি রথীশ ভৌমিক আঁচ করতে পারলে তাদের সংসারে অশান্তি নেমে আসে। এ দিকে, স্কুল ও এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, কামরুল ইসলাম চতুর ও চঞ্চল স্বভাবের। হাসি, ঠাট্টা করত সবার সঙ্গে। দীর্ঘদিন চলার পথে শিক্ষক স্নিগ্ধা ও কামরুলের মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ সম্পর্কের কারণে স্নিগ্ধার দাফতরিক যাবতীয় কাজকর্ম কামরুল করে দিত। বিনিময়ে স্নিগ্ধা বাড়ি থেকে টিফিন বক্সে করে কামরুলের জন্য খিচুড়ি, ছানা, পায়েসসহ ফলমূল নিয়ে এসে তাকে খাওয়াতেন। তার সহকর্মীরা প্রশ্ন করলে স্নিগ্ধা বলতেন, আমার কাজ করে দেয় বিধায় তাকে নাস্তা খাওয়াই। এসব বিষয় জানতে পারেন স্নিগ্ধার স্বামী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক। তিনি শিক্ষক কামরুলকে সাবধান করে দেন। এ থেকে তাদের মেলামেশা বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে মোবাইল ফোনে কামরুল আর স্নিগ্ধা পরিকল্পনা করে কীভাবে আগের সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা যায়। তারা দিনে কখনও ৩০-৩৫ বারও কথা বলেছেন। এসব বিষয় নিয়ে রথীশের পরিবারে নেমে আসে চরম অশান্তি। দেখা দেয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ও বিরোধ। কামরুল ও দীপা ভৌমিককে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত তদন্তরত সংস্থাগুলোর সূত্র এবং স্কুল সূত্র মতে, অব্যাহত শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের কারণে গত ৪ মার্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষক সভাপতির নির্দেশে তিনটি অভিযোগে কারণ দর্শাও দেন কামরুল ইসলামকে। কামরুল ইসলাম নোটিসের জবাব দেন। সেই জবাব নিয়ে গত ১৯ মার্চ কলেজ পরিচালনা কমিটির বৈঠক বসে। বৈঠকে জবাব পর্যালোচনা করে সন্তোষজনক না হওয়ায় কামরুলের সঙ্গে কথা বলার জন্য অভিভাবক সদস্য বিপুল সরকারকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি করে দেন এ্যাডভোকেট বাবু সোনা। গত ২৮ মার্চ স্কুলে দুপুরে ওই কমিটির কাছে সরাসরি নোটিস ও জবাবের বিষয়ে কথা বলেন কামরুল। এক পর্যায়ে ভুল স্বীকার করেন। এ বিষয়টি খুবই খারাপ ভাবে নেন কামরুল ও দীপা ভৌমিক। কামরুলকে নোটিস দেয়া এবং নোটিসের জবাব প্রাপ্তির পর কমিটি করে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনায় দীপা ভৌমিক খুব নাখোশ হন রথিশ চন্দ্র ভৌমিকের ওপর এ নিয়ে কথাকাটাটি হয় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। কামরুলের সঙ্গে দীপার অবাধ প্রেম ও অসামাজিক কার্যকলাপ এবং স্কুলে কামরুলের অবৈধ হস্তক্ষেপে দীপার সমর্থন ও কামরুলকে কারণ দর্শাও নোটিস নিয়ে পারিবারিক বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। বিষয়টি নিয়ে একটি সমঝোতার জন্য ৩০ মার্চ রাতে পারিবারিক সালিশের দিনধার্য করা হয়। কিন্তু পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কামরুলের স্কুলের তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হওয়ার পরের দিন এবং দীপার সঙ্গে পারিবারিক সালিশে আগের দিন ২৯ মার্চেই নিজ বাড়ির নিজ শয়ন কক্ষেই দীপা ভৌমিক ও কামরুল ইসলাম বাবু সোনাকে হত্যা করে। মোবাইল ফোনের কল লিস্টের সূত্র ধরে আইনজীবীর স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক এবং তার সহকর্মী স্কুলশিক্ষক কামরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে ষষ্ঠ দিন ৪ঠা এপ্রিল হত্যাকা-ের রহস্য বের করা হয়। স্নিগ্ধা ভৌমিক র‌্যাবকে জানায়, স্বামীর বেপরোয়া জীবন-যাপন, পরিবারিক কলহ, সন্দেহ ও অশান্তির কারণে তিনি পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত হয়ে স্বামী রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে ভাতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। তাকে এ কাজে সহায়তা করে তার কথিত প্রেমিক কামরুল। পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, স্নিগ্ধা ভৌমিক ও তার সহকর্মী কামরুল মাস্টারের সঙ্গে শত শত বার ফোনে কথোপকথন হয়েছে। সময়ে এবং অসময়ে এই কথাগুলো হয়েছে। তাদের বিভিন্ন কনভারসেশন ছিল। কামরুলের ফোনে আরেকটি ফোনের কললিস্টে অস্বাভাবিক কথা বলা ওই ফোনটি ছিল রথিশের সহকারী মদন চন্দ্র বর্মন মিলনের নামে। মিলনকে আটক করে পুলিশ জেনে যায় ওই নম্বরটি দিয়ে রথিশের স্ত্রী কথা বলতেন কামরুলের সঙ্গে। আমরা এর পরেই কামরুলকে হেফাজতে নিলাম। জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করে বাবু সোনাকে তারা হত্যা করেছে। কিন্তু তার মরদেহের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্ত করে পুলিশকে। কিন্তু স্নিগ্ধাকে আটক করে মরদেহর সঠিক অবস্থানে পৌঁছে যায় ঘটনার ছায়া তদন্তে থাকা র‌্যাব। এ দিকে শুক্রবার (৫ এপ্রিল) রাত ১০টার দিকে বাবু সোনার স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক, তার প্রেমিক কামরুল ইসলাম, ছাত্র সবুজ ও রোকনুজ্জামানকে আদালতে হাজির করা হয়। খুনের ঘটনায় স্নিগ্ধা ভৌমিক, সবুজ ও রোকনুজ্জামান ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দী দেয়ার পর রাতেই তাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান হয়। অপর আসামি কামরুল খুনের ঘটনায় তার জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে। অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত মঞ্জুর তা করে। এ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে খুনের ঘটনায় রংপুরের সর্বত্র ক্ষোভ-ধিক্কার অব্যাহত রয়েছে।
×