ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা

ফয়জুলের সঙ্গে কোন জঙ্গী নেতার কানেকশন খতিয়ে দেখা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৪ এপ্রিল ২০১৮

ফয়জুলের সঙ্গে কোন জঙ্গী নেতার কানেকশন খতিয়ে দেখা হচ্ছে

শংকর কুমার দে ॥ বিশিষ্ট লেখক ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টায় হামলাকারী ফয়জুল হাসানকে মদদদান ও পৃষ্ঠপোষকতার নেপথ্যে আর কোন জঙ্গী নেতা বা কোন জঙ্গী সংগঠনের হাত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ তাকে হত্যার চেষ্টায় হামলার পর ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে একটি গ্রুপ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঘন্য মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ঘটনায় একটি গ্রুপের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে রমনা থানায় মামলা করা হয়। কুৎসা ও নোংরা তথ্য ছড়ানোর ঘটনায় পুলিশের আবেদনের পর ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ‘খালিদ বিন ওয়ালিদ’ নামে একটি আইডি জব্দ করা হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জনপ্রিয় লেখক জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি গ্রুপ বিভিন্ন স্ট্যাটাস দিয়ে এভাবে ‘উল্লাস’ প্রকাশ করে। তার বিষয়ে ছড়িয়ে দেয়া হয় বি™ে^ষপহৃর্ণ অপব্যাখা। যার মধ্যে কিছু কিছু স্ট্যাটাসের ভাষা অত্যন্ত অশ্লীল। কিছু স্ট্যাটাসের সঙ্গে আবার এ গ্রুপটি নোংরা ছবিও শেয়ার করা হয়েছিল। জাফর ইকবাল একজন নাস্তিক। তিনি আর যাই হোন না কেন, মুসলিম নন। আগেও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তখন সফল হয়নি। এবার সফল হয়েছে। এবার মজা দেখ।-এই ধরনের স্ট্যাটাস দেয় ওই গ্রুপটি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের হাতে দুই জন গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে শুধু জাফর ইকবাল নন রাষ্ট্র্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করে সাইবার জগতে চালানো হচ্ছে বি™ে^ষপূর্ণ প্রচারণা, যা জাতীয় চেতনার সঙ্গে পুরোপুরি বেমানান। কিছু আইডি থেকে বিশিষ্টজনদের গালমন্দ করা হচ্ছে। যারা অনলাইনে বিশিষ্টজন ও জাতীয় দিবসকে টার্গেট করে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করছে তাদের মধ্যে দু’জনকে গ্রেফতারের পর এ চক্রের অন্যদের খেঁজা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাফর ইকবালের ওপর জঙ্গী হামলার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু আইডি থেকে হামলার সমর্থন জানিয়ে স্ট্যাটাস দেয়া হয়। সাইবার ক্রাইম ইউনিট শুরুর পর বেরিয়ে আসে ‘খালিদ বিন ওয়ালিদ’ নামে একটি ফেসবুক ও টুইটার আইডি থেকে জাফর ইকবালকে নিয়ে বি™ে^ষপূর্ণ প্রচারণা অতিমাত্রায় ছড়ানো হচ্ছে। আরও কিছু ফেসবুক ও টুইটার আইডি থেকে আনন্দ প্রকাশ করা হয়েছে। এরই মধ্যে আরও কিছু আইডি শনাক্ত করে তার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। জানা যায়- খালিদ বিন ওয়ালিদ নামে আইডির প্রোফাইল ছবি ছিল ইসলামিক স্ট্যাটাস (আইএস) পতাকা তদন্তে বেরিয়ে আসে, খালেদ বিন ওয়ালিদ আইডি মহৃলত নেপথ্যে পরিচালনা করছে হবিগঞ্জের শায়েস্তা গঞ্জের বিরামচরের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন খান। এক সময় ইকবাল একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করত। তবে মাঝেমধ্যে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় চাকরি হারায় ইকবাল। এরপর বাসায় বসে নিয়মিত বেনামি আইডি থেকে আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন লেখা পোষ্ট করত। এছাড়া জাফর ইকবালসহ অন্যান্য বিশিষ্টজনদের নামেও মিথ্যাচার প্রচার করে আসছিল এই ব্যক্তি। তদন্ত সংশিষ্ট সূত্র জানান, গত ১৩ মার্চ সহকারী পুলিশ সুপার ইশতিয়াক আহমেদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম হবিগঞ্জ থেকে ইকবালকে গ্রেফতার করে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া সূত্র ধরে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আলামিন রুমী নামে একজন মাদ্রাসা শিক্ষককে। রুমীও নামে-বেনামে বিভিন্ন আইডি থেকে জাফর ইকবালসহ আরও কয়েকজন বিশিষ্টজনদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ স্ট্যাটাস দেয়। সিলেট থেকে গ্রেফতার ইকবালের জঙ্গীদের ব্যবহƒত টেলিগ্রাম অ্যাপসে একাউন্ট ছিল। এছাড়া অনলাইনে যেসব অখ্যাত নিউজ চ্যানেল থেকে বি™ে^ষপূর্ণ প্রচারণা ছড়ানো হয়। এছাড়া তার একাধিক বেনামি আইডিতে আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা জসীমুদ্দিন রাহমানির বিভিন্ন লেখা পাওয়া গেছে। এমনকি ইকবাল গ্রেফতারের পর থেকে তার ভাগ্নে রাজীবও গা ঢাকা দিয়েছে। রাজীবও বিভিন্ন বেনামি আইডি থেকে উগ্রমতাদর্শ প্রচার করে আসছিল বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ইবকাল একটি পোস্ট শেয়ার করেছে যাতে লেখা আছে- ‘জাফর ইকবাল একজন সু-লেখক হতে পারেন, কিন্তু ধর্মীয় কোনও বিষয়ে তার কাছ থেকে কোনও উপদেশ গ্রহণ করা আর একটা অপদার্থকে পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করা একই কথা। আরেকটি স্ট্যাটাসে সে লিখেছে, ‘বাংলার মুক্তমনাদের জানাতে চাচ্ছি, আপনারাই বলেন, বাংলার একটা অভিজিৎ রায় মারলে হাজার অভিজিৎ রায় জš§ নেবে। এক জাফর ইকবাল হত্যা করলে হাজার হাজার জাফর ইকবাল জন্ম নেবে। তাহলে আপনারাই এদের হত্যা করে এদেশ নাস্তিকময় করে তুলুন।’ ‘মুরসালিন এসকে’ নামে একটি আইডিতে বলা হয় ‘মুজাহিদিনরা এদেরই টার্গেট করে’। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, যারা উগ্রপন্থী তারা নানা গ্রুপে কাজ করে। কেউ দায়িত্ব পালন করে অপারেশনাল ইউনিটে। আবার কেউ আধ্যাত্মিক বয়ান দেয়। কেউ আবার ‘মিডিয়া টিমের’ সদস্য হয়ে জঙ্গী সংগঠনের কর্মকা- বাস্তবায়ন করে। যারা মিডিয়া টিমে থাকে তারা টার্গেট করা ব্যক্তির সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করা। এছাড়া এই দলের সদস্যরা কোন জঙ্গী অপারেশনের পর তা সমর্থন করে পোস্ট দিয়ে থাকে। এ দলভুক্ত সদস্যদের কৌশল থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়লে তথ্য না দেয়ার কৌশল হিসেবে নিজেদের ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ হিসেবে প্রমাণ করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা সংশ্লিষ্টদের কাছে নানা ধরনের ওষুধ চেয়ে থাকে। মহৃলত এসব ওষুধ হলো চেতনানাশক। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এসব ওষুধ দেয়া হলেই বিপদে পড়তে হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টায় হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত হামলাকারী ফয়জুল হাসান, তার বাবা, মা, মামা, ভাই, এক বন্ধু এই ছয়জন গ্রেফতার হয়েছে। এখনও পর্যন্ত জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টার পরিকল্পনার সঙ্গে হামলাকারী ফয়জুলকে দীর্ঘদিন ধরে যারা মোটিভেটেড করেছে তারা কীভাবে এই হামলা করা হবে, আর কারা তার সঙ্গে জড়িত ছিল, কারা কিভাবে ছঁক কষে ছিল তা উদঘাটনের চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশব্যাপী বহুল আলোচিত জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় হামলার ঘটনার রহস্য উন্মোচনের তদন্ত করছে পুলিশের পাশাপাশি, র‌্যাব, সিআইডি, পিবিআই এবং ঢাকার কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। গত ৩ মার্চ সিলেটের এই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় ফয়জুল হাসান নামের এক যুবক তাকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করার পর প্রায় এক মাস চিকিৎসা শেষে গত ২ এপ্রিল কাজে যোগদান করেছেন তিনি কর্মস্থলে যোগদান করেছেন।
×