ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিত্তবানরা এগিয়ে আসুন ॥ প্রধানমন্ত্রী

অটিজম আক্রান্তদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৩ এপ্রিল ২০১৮

অটিজম আক্রান্তদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অটিজম আক্রান্তদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ ও সমাজে তাদের মর্যাদাপূর্ণ জায়গা করে দেয়ায় ভূমিকা রাখতে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, অটিজম আক্রান্তরা সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। অটিজমের বিষয়ে আমাদের সমাজকে আরও সচেতন হতে হবে। তাদের (অটিস্টিক) পাশে দাঁড়াতে হবে। এটা কারও জন্মের দোষ না, আল্লাহ মানুষকে বিভিন্নভাবেই সৃষ্টি করেন। কাজেই সেটাকে অবহেলার চোখে দেখা ঠিক না। সোমবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ১১তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, যারা অটিজমে ভুগছে তাদের অবহেলা করবেন না। অনেক সুস্থ মানুষ যা পারে না সেই সুপ্ত প্রতিভা তাদের (অটিস্টিক) রয়েছে। আমাদেরকেই সেই সুপ্তপ্রতিভাগুলো বিকশিত করার সুযোগ করে দিতে হবে। আর সমাজে তাদের একটা সুন্দর স্থান করে দিতে হবে। এ সময় অটিস্টিক শিশুদের প্রতিভার বিকাশে দেশের বিত্তশালীদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। সদ্য প্রয়াত বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন হকিংসহ অনেক প্রতিভাধর ব্যক্তির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা প্রতিবন্ধী হয়েও মানবতার কল্যাণে অসামান্য অবদান রেখেছেন এবং রাখছেন। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, সুস্থ মানুষ যা পারে না অনেক ক্ষেত্রে তার থেকে তাদের অনেক ভাল প্রতিভা রয়েছে।’ সুস্থ মানুষকে যেভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে তেমনি যারা প্রতিবন্ধী এবং অটিজমে ভুগছে তাদের প্রতি আমাদের সমাজকে আরও সচেতন হবার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সবাইকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ এটা তাদের জন্মের কোন দোষ নয়। কাজেই সেটাকে অবহেলার চোখে দেখা ঠিক নয়। তাই সমাজের সচেতনতা একান্তভাবেই প্রয়োজনীয়। তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি অভিভাবক এবং শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে যাতে তারা আচার আচরণ, কথা বলা ইত্যাদির মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্তদের সুস্থ করতে ভূমিকা রাখতে পারেন। অর্থাৎ শিক্ষকরাও পারবে তাদেরকে আরও সুস্থ করে তুলতে। তাদের মধ্যে সেই সচেতনতাটা সৃষ্টি করা একান্তভাবেই দরকার। সেটাই আমরা চাই। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডাঃ মোজাম্মেল হোসেন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। সমাজকল্যাণ সচিব জিল্লার রহমান স্বাগত বক্তব্য দেন। অটিজম আক্রান্তদের পক্ষে নবম শ্রেণীর ছাত্রী ইসাবা হাফিজ সুষ্মী বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আজকের দিনটি অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে ‘নারী ও বালিকাদের ক্ষমতায়ন, হোক না তারা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হচ্ছে। অটিজম আক্রান্ত এবং প্রতিবন্ধীদের জীবন মান উন্নয়নের নিমিত্তে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২ এপ্রিলকে সর্বসম্মতভাবে অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনজন অটিজম আক্রান্তকে এবং অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করেন। পরে অটিস্টিকদের পরিবেশন করা মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। সরকার অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ‘সব রকম সুযোগ করে দিতে’ কাজ করে চলেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে একসময় অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম হলে জন্মদাতা মাকে পারিবারিক ও সামাজিক নিগ্রহের মধ্য দিয়ে যেতে হতো। অনেক অটিস্টিকদের ঠিকমতো চিকিৎসা করাতেন না। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সদস্য ইসাবা হাফিজের বঞ্চনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি যখন ইসাবার বক্তৃতা শুনছিলাম তখন খুব কষ্ট হচ্ছিল। এই মানসিকতা পরিবর্তন করে সবাইকে বরং আরও সংবেদনশীল হয়ে, আরও সহানুভূতিশীল হয়ে এদেরকে (অটিজম আক্রান্তদের) আদর-ভালবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিতে হবে। আর তাদের মাঝে যে সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে সেই সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সরকার প্রধান এ সময় অটিজম বক্তা ইসাবার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলেন, ইসাবা বলেছে সে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারবে কি না। আমি বলব সে দিতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় প্রতিবন্ধীদের পাবলিক পরীক্ষায় ২০ থেকে ৩০ মিনিট বাড়িয়ে দেয়ার তাঁর সরকারের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বলেন, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় অন্যরা যে সময়ে পরীক্ষা দেয় তাদের চাইতে সাধারণভাবেই ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় বেশি দিয়ে থাকি। যেন তারা তাদের পরীক্ষাটা ভালভাবে দিতে পারে। ইতোমধ্যে ব্যবস্থাটা আমরা করে দিয়েছি। তিনি বলেন, অটিজম বিষয়টি আমাদের সমাজে এখন আর নতুন নয়। এসব অটিজম বৈশিষ্ট-সম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের বিষয়ে আমি এবং আমার সরকার বিশেষ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছি। তিনি বলেন, আমরা কাউকে প্রতিবন্ধী বা অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন বলে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না। তাদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক ধারণা এ ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। সমাজে সুস্থ মেয়ে হলেই অনেক বাবা-মা বোঝা মনে করে। আর প্রতিবন্ধী বা অটিজম শিশু হলে তো কোন কথাই নাই। প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হলে দোষ দেয়া হয় স্ত্রীকে, যেন সব দোষ তার। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের প্রতি সকলেরই সদয় হতে হবে। তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করলে তারাও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। অটিজম বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতে প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে অটিজম বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদের কথা উল্লেখ করে বলেন, আগে বাংলাদেশে অটিজম সম্পর্কে মানুষের তেমন কোন ধারণা ছিল না। আমার কন্যা সায়মা ওয়াজেদের নিরলস প্রচেষ্টায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অটিজমের গুরুত্ব ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অটিজম সচেতনতা ও জনস্বাস্থ্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য সায়মা ওয়াজেদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া ‘অটিজম চ্যাম্পিয়ন’ এর স্বীকৃতি পেয়েছে। সায়মা ওয়াজেদ ‘ইউনেস্কো’র একটি আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডের সভাপতি এবং জাতিসংঘের মানসিক স্বাস্থ্য প্যানেলের একজন সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে চলেছে। অটিস্টিকদের জন্য আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন, ট্রাস্ট গঠন, ভাতা প্রদান ও বই বিতরণসহ তাঁর সরকারের সময়ে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি ৯৬৩ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ৮ হাজার ৪০৫টি ব্রেইল বই বিতরণ করা হয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘অভিগম্য অভিধান’ বা এ্যাকসিসিবল ডিকশনারি তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা মোবাইল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে বাংলা একাডেমির চারটি অভিধান ব্যবহার করতে পারবে। এ ছাড়া ঢাকার মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন কমপ্লেক্সের ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫ তলা বিশিষ্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। ঢাকার অদূরে সাভারে ১২ একর জমিতে প্রায় ২৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিবন্ধী ক্রীড়া কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় সংসদ ভবনের পশ্চিম পার্শ্বে ৪ দশমিক ১৬ একর জায়গা প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাঁর সরকার ইতোমধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপযোগী কর্মক্ষেত্র চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিসিএসসহ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরির জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারী চাকরিতে ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এবার দু’জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পেয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব অটিস্টিক ব্যক্তি, শিশু-কিশোর, তাদের পরিবার ও পরিচর্যাকারীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, অটিজমের লক্ষণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুচিকিৎসা করা হলে তা ভাল হতে পারে। তিনি বলেন, অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধীদের প্রতিভা বিকাশে উৎসাহ দিতে বিভিন্ন উৎসবে মানুষের কাছে তিনি যেসব কার্ড পাঠান, অটিস্টিক শিশুদের আঁকা কার্ডই পাঠান। যার কার্ড নির্বাচিত হয় তাকে সম্মানি হিসেবে এক লাখ করে টাকাও প্রদান করি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিভিন্ন উৎসবের জন্য কার্ড সাধারণত ২০ থেকে ২৫ হাজার কপি ছাপান হয়। এভাবেই আমি কয়েক বছর থেকে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের হাতে আঁকা ছবি দিয়েই শুভেচ্ছা কার্ড বানিয়ে তা পাঠিয়ে আসছি। তিনি বলেন, আমরা চাই অটিস্টিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে। এ ছাড়া স্কুলে সহপাঠীদের মধ্যে অটিস্টিকদের প্রতি সহানুভূতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিদেশী স্কুলের উদাহরণ টানেন তিনি। অটিজম বিষয়ে সরকারের ভূমিকার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অটিজমের ওপর একটা রেজ্যুলেশন গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী একটা সচেতনতা শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন লোকদের জন্য প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একটা কমপ্লেক্স তৈরি করতে চাই। অটিস্টিক হয়ে জন্ম নেয়া শিশুদের আজীবন সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে এখানে। সূচনা ফাউন্ডেশন নামে একটি ফাউন্ডেশনও করে দিয়েছে সরকার। যার উদ্দেশ্য হলো, প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
×