ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে এক মৌসুমে সর্বাধিক সেঞ্চুরির রেকর্ড

সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিকে ইতিহাস গড়লেন আশরাফুল

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২ এপ্রিল ২০১৮

সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিকে ইতিহাস গড়লেন আশরাফুল

মোঃ মামুন রশীদ ॥ ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় তুখোড় মেধাবী ক্রিকেটার হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। তবে আরেকটি কারণে ছিলেন সমালোচিত, তা হচ্ছে ধারাবাহিকতার অভাব। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কালো থাবায় জর্জরিত হয়ে ৫ বছর আন্তর্জাতিক ও তিন বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর লড়াইটা ছিল নিজের সঙ্গেই। সেই লড়াইয়ে এবার দেশের অন্যতম ক্রিকেট আসর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে (ডিপিএল) জিতেই গেলেন আশরাফুল। ধারাবাহিকতা না থাকার সমালোচনাকেও কবর দিয়েছেন টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। রবিবার ডিপিএলের রেলিগেশন লীগে নিজ দল কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের হয়ে ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে আবারও অপরাজিত ১০২ রানের ইনিংস খেলে সেঞ্চুরির এ হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছেন। এর আগে দেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে আর কোন ব্যাটসম্যানই এ কীর্তি গড়তে পারেননি। সবমিলিয়ে চলতি লীগে ৫ সেঞ্চুরি করে দেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন তিনি। এর আগে দেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে আর কোন ব্যাটসম্যান এক মৌসুমে এত শতক হাঁকাতে পারেননি। ১৯৯৯-২০০০ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগ লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের মর্যাদা পায়। তার আগে কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের হয়েই পাকিস্তানের জহুর ইলাহী সর্বাধিক পাঁচটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। লীগের এক আসরে করা সর্বাধিক সেঞ্চুরির কীর্তি ছিল সেটাই। কিন্তু জহুরের করা ওই সেঞ্চুরিগুলো অবশ্য লিস্ট ‘এ’ তালিকাভুক্ত না হওয়ায় আশরাফুলই এখন বাংলাদেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে সর্বাধিক ৫ সেঞ্চুরি হাঁকানো ব্যাটসম্যান। অথচ ২০০১ সালে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া আশরাফুল সবমিলিয়ে শতক হাঁকাতে পেরেছিলেন এই লীগের আগ পর্যন্ত মাত্র ৫টি। ব্যাটিং গড়টাও যেমন ছিল সেটা কোনভাবেই ভদ্রোচিত চেহারার ছিল না। কিন্তু এবার যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে গেলেন আশরাফুল। ফিক্সিংয়ের কালিমা মেখে দীর্ঘদিন ক্রিকেটে নিষিদ্ধ ছিলেন আশরাফুল। প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞার পর শর্তসাপেক্ষে ৩ বছর পর ২০১৬ সালে তিনি দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট আসরে ফেরেন। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর গত ডিপিএলে প্রথম খেলে নিজেকে চেনাতে পারেননি আশরাফুল। ৫ ম্যাচে করেছিলেন ১২৩ রান। এ কারণেই এবার বড় কোন ক্লাব তাকে নেয়নি। অবশ্য এ মৌসুমটা যে দুর্দান্ত যাবে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন শুরুতেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। এবার কলাবাগান তাকে দলে টানলেও শুরুটা বেশ ভয়াবহ রকমেরই ছিল। তৃতীয় ম্যাচেই প্রাইম দোলেশ্বরের বিপক্ষে একটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু এরপর যেন ব্যর্থতার অমানিশায় ডুবে যাচ্ছিলেন। টানা তিন ম্যাচে ৮, ০, ০ রান করে এমনকি একাদশ থেকেও ছিটকে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। গুঞ্জন শোনা গেছে অনেক অনুরোধ করে অগ্রণী ব্যাংকের বিপক্ষে রবিন লীগের ম্যাচটিতে খেলেছিলেন। সেই ম্যাচে অপরাজিত ১০২ রান করার পর থেকে আর সমস্যা হয়নি তার। পরের ম্যাচে ০ করলেও, তারপর তিন ম্যাচে ৬৪, ১৬ ও ১২৭ রান করেন। অর্থাৎ সর্বশেষ ৬ ম্যাচে তিনটি শতক (দুটি অপরাজিত) ও একটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ফুরিয়ে না যাওয়ার বড় প্রমাণই দিয়েছেন ৩৩ বছর বয়সী এ তারকা। এরপর রবিবার রেলিগেশন লীগে দলের শেষ ম্যাচে তিনি দারুণ ধৈর্য ও স্থিতি নিয়ে খেলেছেন। ১৯৩ মিনিট ক্রিজে থেকে দেখে শুনে খেলে ১৩৭ বলে ১০ চারে ১০২ রান করে অপরাজিত থাকেন। ভাগ্যদেবীও বোধহয় আশরাফুলের পক্ষেই ছিলেন। নয়তো এই ইতিহাস লিখতে পারতেন না। রেকর্ডধারী হয়ে থাকতেন পাকিস্তানের জহুর ইলাহী। সেঞ্চুরির জন্য শেষ বলে প্রয়োজন ছিল দুই রান। সোহরাওয়ার্দী শুভকে চার মেরে আশরাফুল তুলে নেন টানা তৃতীয় সেঞ্চুরি। সেই সঙ্গে পূরণ করেন ক্যারিয়ারের দশম সেঞ্চুরি। যার পাঁচটিই আবার এই মৌসুমে। আশরাফুলের অপরাজিত ১০২ রানের ইনিংসের ভর করে ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিপক্ষে ৩ উইকেটে ২৫২ রানের সংগ্রহ দাঁড় করে তার দল। এছাড়া ওপেনার ওয়ালিউল করিম করেন ৯৫ বলে ৬ চার, ৫ ছক্কায় ৭৯ রান। জবাবে ওপেনার মিজানুর রহমানের ১০৪ বলে ১১ চার, ৬ ছক্কা ১১৫ ও ইয়াসির আলীর অপরাজিত ৪৫ রানের সুবাদে ৪৪.৩ ওভারে ৪ উইকেটে ২৫৪ রান তুলে ৬ উইকেটের জয় পায় ব্রাদার্স। আশরাফুলের দল রেলিগেটেড হয়েছে আগেই, তবে প্রিমিয়াল লীগে টিকে থাকার সুযোগ জিইয়ে রেখেছে ব্রাদার্স এ জয়ে। চলতি বছরের আগস্টে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞার শাস্তিপূরণ হয়ে যাবে আশরাফুলের। এরপর ফ্র্যাঞ্চাইজি টি২০ লীগ বিপিএল ও প্রথম শ্রেণীর বিসিএল এবং জাতীয় দলে খেলার জন্য আর কোন বাধা থাকবে না। তবে জাতীয় দলে খেলতে হলে পারফর্মেন্স থাকলেই যথেষ্ট নয়, ভাল ফিটনেসের বিকল্প নেই। তাই ফের জাতীয় দলে খেলতে চাইলে কঠিন পরীক্ষাতেই বসতে হবে আশরাফুলকে। কিন্তু এবার ইতিহাস গড়ে জাতীয় দলের নির্বাচকদের ভাবনার খোরাক দিয়েছেন। বলা যেতে পারে নিজের যোগ্যতা দেখিয়ে এক ধরনের চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিয়েছেন। কারণ লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে টানা ৩ সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে রেকর্ড গড়েছেন। মোহামেডানের বিপক্ষে ১২৭, অগ্রণী ব্যাংকের বিপক্ষে ১০৩ নটআউট এবং ব্রাদার্সের বিপক্ষে ১০২ নটআউট- এই তিন সেঞ্চুরি বাংলাদেশের এ প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পোস্টারবয়কে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা এবং ২০০৩ সালে অসি ক্রিকেটার মাইক হাসি লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে টানা ৫ সেঞ্চুরি করে বিশ্বরেকর্ডের মালিক। আশরাফুলের সামনে অবশ্য সেই সুযোগ নেই। কারণ চলতি লীগ শেষ হয়ে গেছে তার দলের। কিন্তু আশরাফুল চলতি মৌসুমে রান সংগ্রাহকের তালিকাতেও শীর্ষে উঠে গেছেন। ৫ সেঞ্চুরি ও ১ হাফসেঞ্চুরিতে ৬৬.৫০ গড়ে আশরাফুলের সংগ্রহ ৬৬৫ রান। এ ছাড়াও দোলেশ্বরের লিটন দাস এবং আবাহনীর নাজমুল হোসেন শান্ত এবার ৩টি করে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। এর বাইরে ২টি করে সেঞ্চুরি আছে এনামুল হক বিজয়, ফজলে মাহমুদ, মার্শাল আইয়ুব, শাহরিয়ার নাফীস, জহুরুল ইসলাম অমির।
×