ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ রাষ্ট্রপতি পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞ দেখতে যাচ্ছেন

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২ এপ্রিল ২০১৮

 আজ  রাষ্ট্রপতি পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞ দেখতে যাচ্ছেন

স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ ॥ সকল ষড়যন্ত্র, আলোচনা সমালোচনাকে পেছনে ফেলে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ এখন পুরোদমে এগিয়ে চলছে। পদ্মার দুই তীরের মানুষের স্বপ্ন মিলবে এক বিন্দুতে। সেই সেতুর কর্মযজ্ঞ দেখতে আজ সোমবার আসছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। তাই পদ্মা তীরে এখন উৎসব আমেজ। দেশ-বিদেশে আলোচিত বৃহত এই প্রকল্প এখন সুসময় পার করছে। ইতোমধ্যে প্রায় আধা কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। চারটি পিলারে ওপর তিনটি স্প্যান শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌপথে চলাচলরত যাত্রীরা এখন প্রতিদিন এর দৃশ্যমান অংশটি দেখতে পাচ্ছে। চতুর্থ স্প্যানও বসানো প্রক্রিয়া চলছে। খুব শীঘই চতুর্থ স্প্যান বসবে খুঁটির ওপর। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের এই স্বপ্ন পূরণে বীরের পরিচয় দিয়েছেন। আর তাই দুই প্রান্ত মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরায় এ সফরকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। নিজস্ব অর্থায়নে এটি এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এর জন্য খরচ হবে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। এই সেতু হলে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণাঞ্চল। এই সেতুতে ট্রেনও চলবে। এশিয়ান হাইওয়ের পথ হিসেবেও সেতুটি ব্যবহৃত হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। পদ্মা সেতু ঘিরে হংকংয়ের আদলে নগর গড়ার পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ঢাকার পোস্তগোলা হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত দেশের সর্বাধুনিক এক্সপ্রেস সড়ক নির্মিত হচ্ছে। সরেজমিনে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। দেশী-বিদেশী হাজারো শ্রমিক ও প্রকৌশলীদের ব্যস্ততা। প্রকৌশলীরা বললেন, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথ অনেক ধাপ এগিয়ে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় পদ্মায় সেতু তৈরিতে সব চ্যালেঞ্জই সফল। তাই পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সেতুর মূল কাজ উদ্বোধন করেন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া চৌরাস্তার কাছে। তারও আগে তিনি ২০০৫ সালে মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশ্বব্যাংকসহ নানা ষড়যন্ত্র পার করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। পদ্মায় নদীতে ১২৬টি পাইল পুরোপুরি বসে গেছে। আরও ৯টি পাইলের বটম সেকশনের কাজ হয়েছে। নদীতে প্রথম ডিজাইন অনুযায়ী ২৪০টি পাইল বসার কথা ছিল। তবে সম্প্রতি চূড়ান্ত ডিজাইনে ২২টি পিলারে আরও একটি করে পাইল বৃদ্ধি করায় এখন পাইল বসবে ২৬২টি। সেই অনুযায়ী আরও ১২৭টি পাইল বসবে। সেই লক্ষ্যেই কাজ এগিয়ে চলছে। ওদিকে জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সেতুর (ভায়াডাক্ট) কাজ অনেক এগিয়ে গেছে। এই ভায়াডাক্টে স্থাপন হওয়া ১৯৩টি পাইলকে ৪০টি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়েছে। এই পাইলগুলোর মধ্যে ৪টি, ৬টি এবং ১০টি করে এই ৪০টি গ্রুপ করা হয়েছে। এই গ্রুপগুলোর মাথায় ক্যাপ তৈরি হচ্ছে। জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সেতুতে এই ৪০ ক্যাপের মধ্যে ৩০টি ক্যাপ হয়ে গেছে। এছাড়া তীরের ৪২ নম্বর খুঁটির কাজও সম্পন্ন হওয়ার পথে। এদিকে মাওয়া প্রান্তে সংযোগ সেতুর (ভায়াডাক্ট) ১৭২টি পাইলের মধ্যে ৯৬টি পাইল স্থাপন হয়েছে। আর মাওয়ার তীরের খুঁটিটি অর্থাৎ ১ নম্বর খুঁটির ১৬টি পাইলের মধ্যে ৩টি বসে গেছে। তাই টেস্টের কাজ চলছে। এই টেস্ট সম্পন্ন হলেই বাকি পাইলগুলো বসতে কাজ শুরু করা হবে। পদ্মা সেতুর দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, শত শত যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে প্রকল্পে। এর মধ্যে নির্মাণের আধুনিক প্রায় সব প্রযুক্তিই এখানে ব্যবহার হচ্ছে। প্রকৌশলীরা জানান, ১শ’রও বেশি ক্রেনই রয়েছে সেতু এলাকায়। এর মধ্যে বৃহত আকারের ১২টি এবং মাঝারি রয়েছে ৬০। এরকম নানা সব যন্ত্রপাতি ব্যাস্ত রয়েছে পদ্মায় সেতু তৈরির কাজে। সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, সেতুর ৪২টি খুঁটির মধ্যে ২৯টি খুঁটির ডিজাইন ও নক্সা চূড়ান্ত হয়েছে। বাকি ১৩টির ডিজাইন চূড়ান্ত হলেও নক্সা চূড়ান্তের কাজ চলছে। এই কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে কোরিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরও বিশেষজ্ঞ দু’জন অধ্যাপককে সংযুক্ত করা হয়েছে। তাই খুব শীঘ্রই এই ডিজাইনটি হাতে চলে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে কর্তৃপক্ষ জানান, পদ্মার তলদেশে নরম মাটির কারণে ১৪টি খুঁটি নিয়ে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়। তবে আরও ৮টি খুঁটিতে কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা সেতুটির দীর্ঘ স্থায়িত্বের বিষয়টি বিবেচনা করে পুরো ২২টি খুঁটিরই নতুন ডিজাইন পরিবর্তন করেছে। এর মধ্যে ৯টির ডিজাইন নক্সাসহ পুরোপুরি চূড়ান্ত অনুমোদন সেতু কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছেছে। তবে বাকি ১৩টির নক্সা না পৌঁছলেও এর ল্যান্থসহ অন্যান্য সকল নির্দেশনা দিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই পদ্মা সেতুর বড় চ্যালেঞ্জ এখন সমাধান হয়ে গেছে। এই ২২টি খুঁটির ডিজাইন চূড়ান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তায়ন আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। এদিকে চতুর্থ স্প্যানটি এখন রয়েছে মাওয়ার কুমারভোগের বিশেষায়িত কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের পেন্টিং শপে। এখানে ১৫০ মিটার দীর্ঘ এবং প্রায় ৩২শ টন ওজনের চারলেন বিশিষ্ট স্প্যানটি রঙের চূড়ান্ত কাজ চলছে। এই রঙের কাজ শেষ হলেই এটি নিয়ে যাওয়া হবে জাজিরার প্রান্তে। সেখানে ৪১ নম্বর খুঁটি প্রস্তুত করা হয়েছে। ৪০ ও ৪১ নম্বর খুঁটিতে (পিয়ার) বসবে ৭ নম্বর স্প্যানটি। কুমারভোগের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের অদূরে পদ্মায় নোঙ্গর অবস্থায় প্রস্তুত এখন ৩৬শ টন ধারণ ক্ষমতার ভাসমান ক্রেনের জাহাজ ‘তিয়ান ই’। এই জাহাজ স্প্যানটি পাজা করে নিয়ে বসিয়ে দিবে খুঁটির ওপর। সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির অপেক্ষায় অবস্থান করছে ‘তিয়ান ই’। এদিকে রাষ্ট্রপতির আগমনকে স্বাগত জানিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, পদ্মা সেতু বাঙালি জাতির এক বীরত্বগাঁথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেধা প্রজ্ঞা এবং সাহসিকতার এই অসাধারণ উদাহরণ হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। সকল ষঢ়যন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। রাষ্ট্রপতি সফরের চূড়ান্ত নিরাপত্তা ॥ রাষ্ট্রপতির পদ্মা সেতুর সফরের চূড়ান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের পুরো নিরাপত্তায় এবং তাকে বরণে প্রস্তুত এখন মাওয়া। এই নিয়ে আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। রবিবার সরেজমিনে ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হেলিকপ্টারে করে আসবেন। তার কপ্টার অবতরণ করবে পদ্মা সেতুর সার্ভিস এরিয়া-১ হেলিপ্যাডে। দুপুর ১টা ১০ মিনিটে তাঁর অবতরণের কথা রয়েছে। এরপর তিনি সার্ভিস এরিয়ার বিশেষ কটেজে উঠবেন। এখানেই মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে সেতুর সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরা হবে এবং রাষ্ট্রপতিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন সম্পর্কে অবহিত করা হবে। এখানেই তিনি দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নিবেন। পরে বিকেল সাড়ে ৩টায় তিনি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন শুরু করবেন। মাওয়ার কুমারভোগের বিশেষায়িত কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের কার্যক্রম দেখবেন। পরে পদ্মা নদীতে সেতুর কর্মযজ্ঞ দেখবেন। তিনি পদ্মা নদীর কাজ দেখতে দেখতে নৌ পথে কাঁঠালবাড়ি পৌঁছবেন সন্ধ্যা ৬টায়। এরপর তিনি শরীয়তপুরের নাওডোবার সার্ভিস এরিয়া-২ এ আসবেন। এখানেই রাত্রি যাপন করবেন। নির্মল এই পরিবেশে সন্ধ্যা ৭টায় এখানে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রাষ্ট্রপতি সস্ত্রীক উপভোগ করবেন। পরে ৩ এপ্রিল বেলা ১১টায় সেতুতে দায়িত্বরতদের সঙ্গে এক ঘণ্টা মতবিনিময় করবেন। মধ্যাহ্ন ভোজ শেষে বেলা ২টা ৪০ মিনিটে কপ্টারে করে রাজধানীর যাওয়ার উদ্দেশে রওনা হবেন। নিরাপত্তায় ১৩ শ’ পুলিশ ॥ অপরদিকে রাষ্ট্রপতির আগমন উপলক্ষে রবিবার বিকেলে মাওয়া কালিরখিল মাঠে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের প্রতি এক ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ব্রেফিং করেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম পিপিএম। লৌহজং থানার ওসি মোঃ আনিচুর রহমানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শ্রীনগর সার্কেল) কাজী মাকসুদা লীমা। পুলিশ সুপার জানান, এসএসএফ, র‌্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় ১৩শ’র উপরে পুলিশ সদস্য কাজ করছে। এ নিয়ে নৌ ও সড়ক পথে ব্যাপক নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে।
×