ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

কেটে ফেলা চুল রফতানি বাড়াচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১ এপ্রিল ২০১৮

কেটে ফেলা চুল   রফতানি বাড়াচ্ছে

‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা/মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর/ হাল ভেঙে যে নাবিক হারিয়েছে দিশা’Ñ কবি জীবনানন্দ দাশের এমন পঙিতমালা কিংবা ‘দেব খোঁপায় তারার ফুলের মতো বিখ্যাত গানে আলোচিত নারীর চুল। প্রেম, ভালবাসা, বিরহ কিংবা শিল্পীর রং তুলিতে নারী কেশের চিত্রায়ণও অমূল্য। তবে বাস্তবে বাংলাদেশের নারীর চুলও দামী। প্রতিবছরই বাড়ছে রফতানি হচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামগঞ্জে জনপ্রিয় চুলের ব্যবসা। এই চুল বিশ্বের আটটি দেশে রফতানি হচ্ছে । মহিলাদের মাথা থেকে ঝরেপড়া চুল দিয়ে চুলের ক্যাপ, খোপাসহ তৈরি হচ্ছে হরেক রকমের জিনিস। যার বাজার মূল্য খুব বেশি। ফলে মহিলাদের মাথার চুল এখন আর ফেলে দেয়ার জিনিস নয়। প্রতি কেজি চুল বিক্রি হচ্ছে চার থেকে চৌদ্দ হাজার টাকা। এ সব চুল প্রক্রিয়াজাত করে চীন ও কোরিয়াসহ বিশ্বেও বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। চুল রফতানির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে চুল সংগ্রহের বড় বাজার। এসব চুল সেলুন ও বিউটি পার্লার থেকে সংগ্রহ করা হয়। লম্বা চুলের চাহিদা বেশি। বর্তমানে চিন, জাপান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ায় চুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এগুলো দিয়ে পরচুলা, কৃত্রিম চুল, চোখের ভ্রু তৈরি হয়। বাংলাদেশে এসব পণ্য তৈরির চারটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান চুলের তৈরি পণ্যও রফতানি করছে। আগে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চুল যেত চোরাই পথে। সেখান থেকে চিনা ব্যবসায়ীরা কিনে নিতেন। ২০০০ সালে চিনের ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে চুল কিনতে আগ্রহী হন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় দেশের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে চুলের বাজার গড়ে ওঠে। মূলত চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চুলের বাজার। এ ছাড়া সাতীরা, যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, রাজশাহী, নওগাঁ, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, কক্সবাজার, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে চুল বিকিকিনির ব্যবসা গড়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন আকারের চুল নিয়ে এসব স্থানে বিক্রি করেন হকাররা। তারা সংগ্রহ করেন সেলুন ও বিউটি পার্লার থেকে। এগুলোর চাহিদার কথা বিবেচনা করে সেলুন ও বিউটি পার্লারগুলো এখন চুল সংগ্রহ করে রাখে। ব্যবসায়ীদের কাছে সব চুলের কদর নেই। লম্বা চুলের চাহিদা বেশি। কারণ এগুলো দিয়ে পরচুলা তৈরি হয়। প্রথমে এগুলো শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ভাল করে শুকানো হয়। পরে আকার ও মান অনুসারে আলাদাভাবে প্যাকেজ করা হয়। এরপর বিক্রি করা হয় গ্রেড অনুসারে। ক্রেতারা সাধারণত ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি লম্বা চুল ক্রয় করেন। তবে চুল যত লম্বা হয়, দামও তত বেশি। প্রক্রিয়াজাত করা চুল গ্রেড অনুসারে প্রতি কেজি ৭ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুধু দেশের বাজারেই এ দিয়ে ব্যবসা হচ্ছে তা নয়, আসছে শত-কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮৫ লাখ ২১ হাজার ডলারের চুল রফতানি হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৬৬ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই রফতানির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে এক কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার ডলার (প্রায় সাড়ে ৮৬ কোটি টাকা)। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রফতানি বেড়েছে ২০ কোটি টাকার। আর বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে রফতানি বাবদ আয় হয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার বা ১৪০ কোটি টাকা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে গত অর্থবছরে বিভিন্ন দেশে এই চুল রফতানি করে আয় হয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ ডলার অর্থাৎ ১৫০ কোটি টাকারও বেশি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তালিকায় উইগ এবং হিউম্যান হেয়ারকে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে বলা হচ্ছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি জানায় গত অর্থবছরে এই পণ্য রফতানি করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল অর্জিত হয়েছিল তার চেয়েও বেশি। মূলত স্বাধীনতার পর থেকেই এই ব্যবসাটি চলে আসছিল। তবে তা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়তে থাকে ১৯৯৯-২০০০ সালের পর থেকে।
×