ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির পরও ৪ মাসে এসেছে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ২৭ মার্চ ২০১৮

মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির পরও ৪ মাসে এসেছে  ৮০ হাজার রোহিঙ্গা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় গত বছরের ২৩ নবেম্বর। চুক্তির পরও প্রায় ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। চুক্তি সম্পাদনের পরও গত চার মাসে ৮০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার পেছনে অনেকে সন্দেহ করছেন, চলতি বছরেই হয়ত রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের শেকড় উৎপাটন করবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। শুধু উত্তর রাখাইনেই নয়, বর্তমানে সিটওয়েতে (আকিয়াব) রোহিঙ্গাদের ওপর বিভিন্নমুখী অত্যাচার চলছে বলে ওপারের বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ২৫ আগস্টের পর সহিংসতায় প্রাণে বাঁচতে প্রায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশে। সব মিলে বাংলাদেশে এখন ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে। ওসব রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হলেও তা কার্যকরের বিষয়টি এখনও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এখন পর্যন্ত কেবল ৩৭৪ জনকে ফেরত নেয়ার আশ্বাসের কথা জানিয়েছে মিয়ানমার। যেখানে রোহিঙ্গাদের তালিকা দেয়া হয়েছিল প্রথম দফায় ৮ হাজার ৩২। এ অবস্থাতে সেখানকার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতিগুলোতে বুলডোজার চালিয়ে আলামত নষ্ট, একাধিক সামরিকায়ন, উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রেখে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য মডেল গ্রাম গড়ে তোলা হচ্ছে। এদিকে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপের মুখে হঠাৎ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে মিয়ানমারে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এনএলডির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অপসারণ, পদত্যাগে বাধ্য করাসহ নানা কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে দেশটির স্টেট কাউন্সেলর আউং সান সুচি পদত্যাগ করতে পারেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে আভাস দেয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট থিন কিউ ও পার্লামেন্টের স্পীকার উইন মিয়েন্ট গত বুধবার হঠাৎ করে পৃথকভাবে পদত্যাগ করেছেন। এর পেছনে সেনাবাহিনীর চাপ রয়েছে বলে বিভিন্ন মহলের সুস্পষ্ট মত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট থিন কিউ ছিলেন আউং সান সুচির ঘনিষ্টজনদের অন্যতম। দেশটির সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর অনেকেই সন্দেহ করছেন মিয়ানমার এখন আর গণতন্ত্রের দিকে নয় বরং আরও সামরিকীকরণের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর ক্রমাগত হস্তক্ষেপ, জাতিগত নিধন ও রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো বিষয়ে তাদের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তারা। বাংলাদেশে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এ নিয়ে এনএলডির উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে যে প্রচ- মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে তা এখনও বিদ্যমান। এসব কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য রাজি হলেও সেনা বাহিনী এতে দ্বিমত পোষণ করে চলেছে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা আউং সান সুচি যে কোন মুহূর্তে অবসরে যেতে পারেন বলে জানা সূত্রে জানানো হয়েছে। সূত্র মতে দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কার্যনির্বাহী কমিটির এক বৈঠকের পর সুচির সরে যাওয়ার বিষয়টি আরও জোরালো হয়েছে। যদিও দলটির এক নেতা সুচির পদত্যাগের গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে বলেন, আউং সান সুচি অবসরে যাবেন ব্যাপারটা তা না। তবে দলের কর্মীরা যদি কঠোর পরিশ্রম করেন, তবেই তিনি অবসরে যাবেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি সহসা অবসরে যাবেন। গত ২৪ মার্চ এনএলডির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির এক বৈঠকে সুচি বলেন, সম্ভব হলে তিনি পদত্যাগ করতে চান। এনএলডি প্রধান সুচির এ মন্তব্যের পর দেশটির গণমাধ্যমে তার পদত্যাগের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে নানা খবর প্রকাশিত হয়। এনএলডির মুখপাত্র ইউ মিও নিউন্ত বলেন, নেইপিদোতে যে বৈঠক হয়েছে, সেটি ছিল শুধু সামাজিক সমাবেশ। বৈঠকে রাজনৈতিক কোন বিষয়ে আলোচনা হয়নি। এটি ছিল অনিয়মিত একটি আলোচনা। প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করায় ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউ উইন মিন্ত দেশের শীর্ষ এ পদের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির সংবিধানে সংশোধনী আনে। এতে সরকারী কর্মকর্তারা দলীয় রাজনীতিতে অংশ নিতে পারবেন না বলে বিধান করা হয়। যে কারণে সামাজিক সমাবেশ অবৈধ নয়। এদিকে আগামীতে যদি প্রত্যাবাসন শুরু হয় তাহলে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে সাময়িকভাবে রাখার জন্য ৬ শতাধিক ভবন (ট্রানজিট ক্যাম্প) নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। চলতি মাসের শেষ নাগাদ ওসব ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে রোহিঙ্গাদের জন্য যেসব ট্রানজিট ক্যাম্প নির্মিত হয়েছে ওসব ক্যাম্প কিভাবে তৈরি করছে, মিয়ানমারের প্রস্তুতি কেমন, তা দেখতে জাপানের পররাষ্ট্র দফতরের সংসদীয় সহকারী মন্ত্রী আইওয়াও হোরি ইতোমধ্যে রাখাইন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
×