ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে ভূমিকা চাই

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৬ মার্চ ২০১৮

বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে ভূমিকা চাই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সরকারকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু ২৫ মার্চ নয়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাসে বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে তার স্বীকৃতির দাবি করা উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। এজন্য বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং সরকারকে সঠিক পন্থায় এগিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন তারা। জাতীয় প্রেসক্লাবের উদ্যোগে ‘২৫ মার্চের গণহত্যা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। সেমিনারে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়। প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মিজানুর রহমান, প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি সাইফুল আলম, কোষাধ্যক্ষ কার্তিক চ্যাটার্জি প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। মূল প্রবন্ধে গণহত্যার সংজ্ঞায় একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক স্বদেশ রায় বলেন, কোন প্রজাতি, কোন বর্ণ, কোন জাতি বা ধর্মের লোককে হত্যার মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়ে ঐ স্থানের উপর যখন এককত্ব বা ধ্বংসকারীর শ্রেষ্ঠত্ব বজায়ের চেষ্টা করা হয় সেটি তখন আর কোন সাধারণ হত্যাকা- না থেকে গণহত্যা হিসেবেই চিহ্নিত হয়। তাই গণহত্যার ব্যাপকতা দুইভাবে দেখা হয়। ২৫ মার্চ গণহত্যা নিয়ে সাংবাদিক স্বদেশ রায় তার প্রবন্ধে বলেন, ২৫ মার্চ গণহত্যা ছিল ব্যাপক। সেই রাতে নির্বিচারে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্মরণ করলেও মূলত এই দিনটি গোটা ৯ মাসের প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৭১ সালে ৯ মাস যে হত্যাকা- হয়েছিল সেই সব হত্যাকা-কে স্মরণ করার জন্য আমরা ২৫ মার্চ নানাভাবে সমবেত হই। আমরা দেখতে পাই ১৯৭১ সালে গণহত্যার মাধ্যমে প্রত্যেকে কোন না কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কেউ স্বজন হারিয়েছেন, কেউ অঙ্গ হারিয়েছেন। কেউ আবার এমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যে ৪৭ বছরেও আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। গণহত্যার এই সব উদ্দেশ্য নিয়ে সমাজে কোন গবেষণা হয়নি। আর গবেষণা না হওয়ার দুটি কারণের কথাও উল্লেখ করেন জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালীন হিসাব থেকে স্বাধীনতার পরপরই বলা হয়েছিল গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ নিহতের কথা। তবে বঙ্গবন্ধু যে জরিপ শুরু করেছিলেন তা শেষ করতে পারলে এই সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যেত। স্বদেশ রায় বলেন, বঙ্গবন্ধু থেকে শিশু রাসেলও গণহত্যার শিকার। পাকিস্তানী কোলাবরেটরদের চলমান গণহত্যা আজও আমরা বন্ধ করতে পারিনি। গণহত্যা দিবস স্মরণ ও এটি বন্ধ করতে হলে এই মুহূর্তে সবাইকে শতভাগ বাঙালী হতে হবে বলেও জানান। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, শুধু ২৫ মার্চ নয়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাসে বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি করা উচিত। শাহরিয়ার কবির বলেন, ২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বিভ্রান্তিটা শুরু হয়েছে জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে। তবে এই স্বীকৃতি এখন আর পাওয়া সম্ভব না। সরকার ২০০৮-০৯ সালে চেষ্টা করলে এই স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব ছিল। কারণ ইতোমধ্যে আর্মেনীয় গণহত্যার স্বীকৃতি হিসেবে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। জাতিসংঘের সেই স্বীকৃতিপত্রে বাংলাদেশ স্বাক্ষরও করেছে। তাই এখন আর এ দাবি করে লাভ নেই। আমাদের উচিত মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে এ দেশে যে গণহত্যা চালানো হয়েছে তার স্বীকৃতি অর্জনের চেষ্টা করা। একাত্তরের ঘাতকসহ গণহত্যায় জড়িতদের বিচার ব্যবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিশাল অর্জন আছে। বিশ্বে কোথাও এমন বিচারের নজির নেই। অনেক আদালতে এই রায়কে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একাত্তরে গণহত্যায় জড়িতদের বিচার হলেও সংগঠনের বিচার হচ্ছে না। এখনও জামায়াতে ইসলামীর বিচার হয়নি। অচিরেই ওই বিচারও করতে হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বলেন, এই গণহত্যা বিষয়টি নিয়ে এগুনোর মতো সক্ষমতা সরকারের মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কারোরই নেই বলেই মনে হয়। এই এজেন্ডার নিয়ে কাজ করার মতো সক্ষমতা এই দুটি মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান নেই। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্বীকৃতি আর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতির মতো গণহত্যা বিষয়টি নয়। গণহত্যা বিষয়টি একটু ভিন্ন। তবে এই স্বীকৃতি আদায়ে একটু সময় লাগবে। দেশে-বিদেশে এমন সভা সেমিনার ব্যাপকভাবে করতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা এই স্বীকৃতি পাব। জবি উপাচার্য আরও বলেন, গণহত্যা স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টাও যেমন অব্যাহত রাখতে হবে তেমনি এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরের কেউ যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। কেননা, জাতিসংঘে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত উপস্থাপন করবে সরকারই। তাই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার ক্ষমতায় না থাকলে বিষয়টি স্তব্ধ হয়ে যাবে।প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, এই ভূখ-ে গণহত্যা আমরা মনে করি অনেক আগেই শুরু হয়েছে। যার চূড়ান্ত রূপ দেখেছি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। ভয়াবহ, নৃশংস গণহত্যা সেদিন সংঘঠিত হয়। সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে যার পরিমাপ করা যাবে না। অতিসম্প্রতি মিয়ানমারে যা হচ্ছে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে ধ্বংস করা ’৭১ সালে সে রকম জাতিসত্ত্বা ধ্বংসের চেষ্টা হয়েছিল। যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম আরও বলেন, গণহত্যা যারা করেছিল তাদের বিচার শুরু হলেও ’৭৫ সালের পর তা বন্ধ করে দেয়া হয়। ২৫ মার্চ সারাদেশ ১ মিনিট ব্ল্যাক আউট থাকবে। ১ মিনিটের ব্ল্যাক আউট করে কি ৩০ লাখ শহীদের আর্তনাদের মর্মস্পর্শী কণ্ঠ সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারব? এখন আর দাবির তোলার সময় নেই, এখন সময় দাবি বাস্তবায়নের। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে আমাদের যা যা প্রয়োজন করা উচিত। প্রেসক্লাবের কোষাধ্যক্ষ কার্তিক চ্যাটার্জি বলেন, ২৫ মার্চ একটি জাতিকে ধ্বংস করার পদক্ষেপ। আমরা যখন স্বাধীনতা আন্দোলনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখনই এমন হত্যাকা- হয়। সেই জঘন্যতম হত্যাকা-ের স্বীকৃতি আজও পাইনি। এই সেমিনার থেকে দাবি জানাচ্ছি এই গণহত্যাকে যেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। সভাপতির সমাপনী বক্তব্যে প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই জাতিসংঘে যা করা দরকার করুন। বিশ্ববাসীর কাছে বিষয়টি তুলে ধরুন। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ দেয়ার কথাও বলেন তিনি। এ সময় সেমিনারে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
×