ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক মহাসড়কে পাঁচ স্তরে চাঁদাবাজি ॥ বহিরাগতদের দখলে ফেরিঘাট

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৩ মার্চ ২০১৮

সড়ক মহাসড়কে পাঁচ স্তরে চাঁদাবাজি ॥ বহিরাগতদের দখলে ফেরিঘাট

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে পাঁচ স্তরের চাঁদাবাজি চলছে। সড়ক ইজারার নামে প্রতিদিন পরিবহন থেকে আদায় করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। মজার বিষয় হলো, সারাদেশে ২১ হাজার কিলোমিটারের বেশি মহাসড়ক রয়েছে। এর পুরোটাই দেখভালের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের। অথচ সড়ক বিভাগ ইজারার বিষয়ে কিছুই জানে না। প্রশ্ন জাগতেই পারে ইজারার নামে কারা কিভাবে অর্থ আদায় করছে। পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, চার স্তরের চাঁদাবাজির কবলে গোটা পরিবহন সেক্টর। নির্বাচন সামনে রেখে চাঁদাবাজির মাত্রা বাড়ছে। স্থানীয় সরকার, সিটি কর্পোরেশন, সরকারদলীয় নামসর্বস্ব বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসহ ফেরিঘাট ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সন্ত্রাসী বাহিনীর নামে ইচ্ছে মতো চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এর বাইরে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাঁদা তো আছেই। রাজধানী ঢাকা থেকে আঞ্চলিক সড়ক পর্যন্ত পরিবহন চাঁদাবাজি চলছে। গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালসহ আশপাশের এলাকায় প্রকাশ্যে পরিবহন চাঁদাবাজি দেখা যায়। যদিও চাঁদাবাজরা নিজেদের পরিচয় দিতে নারাজ। মালিবাগ-মুগদা রুটে চলা লেগুনা থেকে খিলগাঁও রেলগেটে প্রকাশ্যে চাঁদা তোলে একাধিক নারী। চালকদের অভিযোগ, বিভিন্ন হাতে এই চাঁদার টাকা বণ্টন হয়। চাঁদা না দিলে গাড়ি চালানো বন্ধ। পরিবহন শৃঙ্খলার নামে সবচেয়ে বেশি চাঁদা আদায় করা হয় ফেরিঘাটগুলোতে। পণ্যবাহী ট্রাক, ভ্যান থেকে ৫শ’ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হচ্ছে নিয়মিত। প্রতিকার চেয়ে স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে একাধিক চিঠি দেয়া হয়েছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। এলাকার নাম উল্লেখ করে চাঁদাবাজি রোধে উচ্চ আদালতে একাধিক রিট করা হলেও এই অপরাধ বন্ধ হয়নি। স্থায়ীভাবে পরিবহন চাঁদাবাজি রোধে আইনী লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, পরিবহন মালিকদের পক্ষ থেকে প্রতিবছর সরকারকে অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স ও রোড ট্যাক্স দেয়া হয়। তাহলে কেন পরিবহন চললেই চাঁদা দিতে হবে? তিনি বলেন, সারাদেশে নানা কায়দায় পরিবহন চাঁদাবাজি হচ্ছে। বেআইনী পৌরট্যাক্সের নামে চাঁদা আদায়ে মালিকরা এখন অতিষ্ঠ। পৌরসভার নির্ধারিত ফির বাইরে কয়েকগুণ চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। এছাড়া ফেরিঘাটগুলোতে বিআইডব্লিউটিএ-বিআই-ডব্লিউটিসি, স্থানীয় প্রশাসন, সংসদ সদস্যদের লোকদের ধাপে ধাপে চাঁদা দিতে হয়। গাড়ি সিরিয়ালের নামে চাঁদা আদায় হয়। অথচ মালিক সমিতির পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন আগে ঘাটে পরিবহন শৃঙ্খলার জন্য সমন্বিত টিম গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে কোন ভূমিকা নেয়া হয়নি। মাস্তান গ্রুপ ও পৌর এলাকার নামে হাইওয়েতে চাঁদাবাজি কোনভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। প্রতিবাদ করলে যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা হয়। বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। একাধিক রিট আবেদন করা হয়েছে উচ্চ আদালতে। তবুও স্থায়ীভাবে প্রতিকার মেলেনি। চাঁদাবাজি রোধে ধারাবাহিকভাবে আইনী লড়াই চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আইনে আছে, শুধু টার্মিনাল ব্যবহার করলেই পৌরসভা অথবা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পরিবহন টোল আদায় করা যাবে। অন্যথায় পরিবহন টোল আদায় পুরোপুরি অবৈধ। মালিক সমিতির অভিযোগ, সারাদেশের সড়ক মহাসড়কগুলো সিটি কর্পোরেশন অথবা পৌরসভার আওতায়। হাইওয়েতে চলা গাড়িগুলো সংশ্লিষ্ট পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের কোন সুযোগ-সুবিধা নেয় না। অথচ হাইওয়ে ইজারার নামে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। ৪০ টাকা টোলের পরিবর্তে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা নেয়া হচ্ছে প্রতিবাস থেকে। ওয়েস্কেলের নামে চাঁদাবাজি ॥ প্রকৌশলীরা বলছেন, হাইওয়েগুলো ১৫ টন ওজন সহনীয় করে নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ ৩০ থেকে ৫০ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে ট্রাক, ওয়াগনসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবহনে। তাই দ্রুত সময়ে রাস্তা ভেঙ্গে যায়। বারবার সংস্কারের প্রয়োজন হয়। এ বিষয়ে প্রকৌশলী জাওয়েদ আলম বলেন, ১৫ টনের বেশি মালামাল পরিবহন করলে রাস্তার ক্ষতি হবে এটাই স্বাভাবিক। দ্রুত সময়ে রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ হিসেবে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন করাকেই দায়ী করেন তিনি। সরকারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন বন্ধে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি ওয়েস্কেল মেশিন বসানো হয়েছে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আয়োজিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ওয়েস্কেলগুলো চোরের খনিতে পরিণত হয়েছে। যে উদ্দেশ্য ওজন নিয়ন্ত্রণ মেশিনগুলো বসানো হয়েছে তা কার্যকর হচ্ছে না। অতিরিক্ত মাল পরিবহন করার অপরাধে কোন ট্রাককে ফিরিয়ে দেয়ার নজির নেই। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা বলছেন, অনিয়মের কারণে ওয়েস্কেলগুলো স্থাপনের সুফল মিলছে না। চাঁদাবাজির পয়েন্ট ॥ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের হোতা নূর হোসেন এখন নেই। কিন্তু তার ছায়া রয়ে গেছে। আছে উত্তরসূরিরা। সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় এক সময়ে তিনি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। তার রাজত্বে একাই ছিলেন রাজা। পরিবহন চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে এমন কোন অপকর্ম নেই তিনি করতেন না। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে টার্মিনাল ইজারার নামে হাইওয়ে থেকে চাঁদাবাজির মূল হোতা ছিলেন তিনি। গাড়ি প্রতি তাকে দিতে হতো ৩০০ টাকা। স্থানীয় আর আন্তঃজেলা সব ধরনের পরিবহন থেকেই চাঁদা আদায় করত নূরের লোকজন। নূরের সাম্রাজ্যের পতনের পর নতুন অধিপতি চাঁদাবাজির দায়িত্ব নেন। অর্থাৎ মহাসড়ক ইজারার নামে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ব্যাপকভাবে পরিবহন চাঁদাবাজি হচ্ছে। রীতিমতো রশিদ দিয়ে আদায় হচ্ছে চাঁদা। অথচ বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ পূর্ববঙ্গে কোন পরিবহনেই সিদ্ধিরগঞ্জের টার্মিনাল ব্যবহার করে না। পরিবহন নেতারা জানিয়েছেন, ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে শনিরআখড়া থেকে চাঁদাবাজি শুরু। এরপর রূপগঞ্জ পৌরসভা, সোনারগাঁও পৌরসভা, গৌরিপুর, কুমিল্লা, ফেনী, মিরেশ্বরাইসহ কক্সবাজার পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে। পণ্যবাহী পরিবহনের টোকেন ও সিরিয়ালের নামে চাঁদা আদায় করা হয় ফেরিঘাটে। যেসব ট্রাক বেশি টাকা দেয় সেগুলোর আগে পার হওয়ার ব্যবস্থা থাকে। ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে রাস্তা ইজারা বা পৌর ট্র্যাক্সের নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে। ঢাকা ময়মনসিংহ সড়কে টঙ্গী, জয়দেবপুর, মাওনা, ভালুকা, ময়মনসিংহ, ফুলপুর, তারাকান্দা, শ্যামগঞ্জ থেকে চাঁদা আদায়ের কথা জানান পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা-টাঙ্গাইল ও সিলেট সড়কের চিত্র ঠিক একই রকমের। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী জনকণ্ঠকে বলেন, কোন সরকারের আমলেই পরিবহন চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। কখনও কম, কখনও বেশি। তিনি বলেন, একটি সংগঠনের নামে এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন চাঁদাবাজি হচ্ছে। এই সংগঠনটি এক সময়ে মাইক্রোবাস শ্রমিক ফেডারেশন নামে পরিচিত ছিল। পরে স্বাধীনবাংলা শ্রমিক ফেডারেশন থেকে এখন নতুন রূপে মাঠে নেমেছে। তিনি বলেন, টার্মিনাল ব্যবহার না করলে পৌর ট্যাক্স আদায়ের কোন বৈধতা নেই। কিন্তু কার কথা কে শোনে। সরকার দলীয় লোকজন দেশের ৬৪ জেলাতেই নানা কৌশলে পরিবহন চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত। ৪০ টাকা টার্মিনাল টোলের স্থলে পাঁচগুণের বেশি টাকা নেয়া হচ্ছে। যারা আইন ভাঙছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেই। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে জাতীয় সড়ক রয়েছে তিন হাজার ৬১৮ কিলোমিটার। আঞ্চলিক সড়ক চার হাজার ৩২০ কিলোমিটার ও জেলা সড়ক আছে ১৩ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার। ব্রিজের সংখ্যা তিন হাজার ২৩৪টি। কালভার্ট আছে ১৩ হাজার ৭৫১টি। সারাদেশে রেজিস্ট্রেনপ্রাপ্ত ৩০ লাখের বেশি পরিবহনের মধ্যে বেশিরভাগ গণপরিবহন চাঁদাবাজির শিখার। বিশেষ করে বাস ও পণ্যবাহী পরিবহনগুলোকে চাঁদা না দিয়ে পথ চলা দায়। সড়ক বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন, মহাসড়ক ইজারা দিতে পারে একমাত্র সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কেউ মহাসড়ক ইজারার নামে টাকা আদায় করলে তা হবে আইনত দ-নীয় অপরাধ। বহিরাগতদের দখলে ফেরিঘাট ॥ পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের অভিযোগ দেশের প্রায় সবকটি ফেরিঘাট বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হচ্ছে। কোন ফেরিঘাটেই সরকারী নির্ধারিত টোল দিয়ে গাড়ি পারাপার সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও পাটুরিয়া, কাওরাকান্দি, মাওয়া, শরিয়তপুর, চাঁদপুরসহ সবকটি ঘাটের চিত্র প্রায় একই রকম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বহিরাগত লোকজন এখন ঘাটের মূল নিয়ন্ত্রক। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে ফেরি পারাপার। বাংলাদেশ বাস ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান জনকণ্ঠকে বলেন, বহিরাগতরা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ফেরিঘাটসহ সারাদেশে পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় করছে। পরিবহন নেতারা অভিযোগ করে বলেন, সড়ক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার হাইওয়ে পুলিশ গঠন করেছে। সম্প্রতি হাইওয়ের নিরাপত্তা ও যানজট রোধে কাজ না করে পুলিশ পরিবহনের ত্রুটি বিচ্যুতি ধরতে ব্যস্ত। বিআরটিএর পক্ষ থেকে ট্রাক ও ওয়াগন, কন্টেনার রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হলেও পুলিশ ধরে ধরে মামলা দিচ্ছে। চাঁদাবাজি করছে। এক মামলায় পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হচ্ছে। পুলিশের অভিযোগ অনুমোদন ছাড়াই গাড়ির পেছনের অংশ বর্ধিত করা হয়েছে। অথচ মালিকরা বলছেন, এর বৈধতা আছে। যুগের পর যুগ এই প্রক্রিয়ায় চলছে পরিবহন। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিরা ইচ্ছা করলেই পরিবহন থেকে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারে। চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে না। বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা সব সময় কঠোর অবস্থানে। বাস্তবতা হলো নানা কায়দার দেশের সব জেলাতেই পরিবহন চাঁদাবাজি চলছে। কখনও কম, কখনও বেশি। মালিক-শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সমন্বয় সম্ভব হলে চাঁদাবাজি অনেকটাই কমে আসবে বলেও মত দেন প্রবীণ এই শ্রমিক নেতা।
×