ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হাসানই ডিবি পরিদর্শক জালালের হত্যাকারী

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২২ মার্চ ২০১৮

দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হাসানই ডিবি পরিদর্শক জালালের হত্যাকারী

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ডিবি পুলিশের পরিদর্শক জালালউদ্দিনের হত্যাকারী হাসান নামের এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বলে অনেকটাই নিশ্চিত তদন্তকারী সংস্থাগুলো। চার মাস আগে হাসান ওই বাড়ির চিলেকোঠার একটি রুম মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকায় ভাড়া নেয়। বুধবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ হাসানের গ্রেফতার হওয়ার তথ্য মেলেনি। তবে হাসানের স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তানসহ মোট সাতজন ডিবি পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুলিশ কর্র্মকর্তা খুনের ঘটনায় ডিবি পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করছে। জালাল উদ্দিনের মাথা থেকে উদ্ধারকৃত বুলেটের খোসাটির পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। গত ১৯ মার্চ সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে বারোটার দিকে ডিবির পশ্চিম বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার শাহাদাত হোসেনের নেতৃত্বে দুই সার্জেন্টের অস্ত্র চুরির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করতে মিরপুর মডেল থানাধীন মধ্যপীরের বাগের আলিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের কাছেই ১০৫/এ/১ নম্বর আড়াইতলা বাড়িতে অভিযান চালায়। আড়াই তলা বাড়িটির মালিক হেলাল। তিনি সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। তার স্ত্রী লাভলী বেগমও মারা গেছেন। দুই মেয়ে লিজা আর এমিকা পাশের পাবনা গলির ২৬২/১ নম্বর মধ্যপীরের বাগের নয়তলা বাড়ির দোতলায় বসবাস করেন। তাদের একমাত্র ভাই রাফী কারাবন্দী। মেয়েদের বাড়িতে গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি। তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ। বাড়িটির সামনে বিশাল বিশাল গর্ত করে বাড়ি তৈরির কাজ করছেন হেলালের ভাই বেলাল। আড়াই তলা বাড়িটির প্রবেশের তেমন কোন রাস্তা নেই। সামনের দিক থেকে বাড়িটিতে ইট বালু মাটি পেরিয়ে যেতে হয়। আর পেছন দিক থেকে বাড়িটিতে দেড় ফুট গলির রাস্তা দিয়ে ঢুকতে হয়। এছাড়া বাড়িটিতে প্রবেশের আর কোন রাস্তা নেই। বাড়িটির দক্ষিণ ও পূর্বদিকে লাগোয়া দুইটি বাড়ি। এ দুইটি বাড়ির মাঝে প্রায় দুই ফুট সরু একটি গলি রয়েছে। বাড়িটির এক মহিলা বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, রাত সাড়ে বারোটার দিকে চারদিকে বুটের আওয়াজ পাওয়া যায়। এর খানিক পরেই কলাপসিবল গেটে কে যেন গেট খুলে দেয়ার জন্য ডাকাডাকি করতে থাকে। বেরিয়ে সামনে গেলে তারা পুলিশের লোক বলে পরিচয় দেয়। গেট খুলে দেয়ার আগেই ওপর থেকে গুলি আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। দ্রুত গেট খুলে দেয়া হয়। পুলিশ উপরে চলে যায়। এরপর অন্তত ১০ থেকে ১২টি গুলির শব্দ হয়। খানিক পরে একজন পুলিশ সদস্যকে মাথায় রক্তাক্ত অবস্থায় ধরে নিচে নামানো হয়। সব মিলিয়ে আধা ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি হয়। এরপর সব নিরব হয়ে যায়। তিনি আরও জানান, বাড়টির নিচতলায় ও দু’তলায় পাঁচটি করে দশটি আর তৃতীয় তলায় চিলেকোঠায় তিনটি রুম। চিলেকোঠার তিনটি রুমের মধ্যে মাঝের রুমে হাসান নামে একজন ছিল। সে চার মাস আগে রুমটি ভাড়া নেয়। তার বাড়ি বরিশাল বলে জানা গেছে। হাসান তার স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতো। এক মেয়ের বয়স দুই থেকে আড়াই বছর হবে। আরেক মেয়ে কোলে। পাঁচ থেকে ছয় মাস বয়স হবে। হাসান ভাঙ্গারীর ব্যবসা করে বলে জানিয়েছে। তার স্ত্রীর চলাফেরা ছিল রহস্যজনক। কোন কোন দিন বোরখা পরতো। আবার কোন সময় বোরখা ছাড়াই বের হতো। হাসানের বয়স কম। পরিবারটির চলাফেরার মধ্যে এক ধরনের লুকিয়ে থাকা বা জঙ্গী জঙ্গী ভাব ছিল। আর তার পাশে উত্তর দিকের রুমে একজন চালক থাকত। তিনি হাসানের এক মাস আগে অর্থাৎ পাঁচ মাস আগে রুমটি ভাড়া নেয়। সে তার স্ত্রী আর এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করতো। প্রতিটি রুমের ভাড়া সাড়ে তিন হাজার টাকা। তার নাম জানা যায়নি। পুলিশ হাসানের স্ত্রী ও দুই সন্তান, পাশের রুমের চালককে পুরো পরিবারের সবাইকেসহ ধরে নিয়ে গেছে। আর নিচ থেকে একজন সবজি বিক্রেতা ও একজন চালককে পুলিশ নিয়ে গেছে। চারদিকে পুলিশ ছিল। কিভাবে হাসান পালাতে পারে জানতে চাইলে ওই নারী বলছিলেন, বাড়িটির দক্ষিণ দিকে একটি সরু গলি রয়েছে। অন্য সবদিকেই পুলিশ ছিল। এজন্য ধারণা করা হচ্ছে, সেই গলি দিয়েই হাসান পালিয়ে যেতে পারে। পুলিশকে হত্যা করার আগেই না পালিয়ে পুলিশকে হত্যা করে পালানোর বিষয়টি রহস্যজনক। ধারণা করা হচ্ছে, হাসান কোন জঙ্গী হতে পারে। কারণ যে পুলিশকে হত্যা করে পালাতে পারে, সে পুলিশ উপরে ওঠার আগেই পালাতে পারতো। কিন্তু তা না করে পুলিশকে হত্যা করে পালানোর বিষয়টি খুবই রহস্যজনক। হাসান হয়তো আগ থেকেই পালানোর রাস্তাটিও দেখে রেখে ছিল। এ ব্যাপারে ডিবির যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলছিলেন, হাসানকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। প্রাথমিকভাবে হাসান সন্ত্রাসী বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে হাসান কোন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। সে বিষয়টি জানার চেষ্টা চলছে। হাসান গ্রেফতার হলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করবে। নিহত পুলিশ কর্মকর্তার মাথা থেকে উদ্ধারকৃত বুলেটের খোসাটির ব্যালাস্টিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য সিআইডির ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সার্জেন্টের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের গুলিতে জালালউদ্দিনের মৃত্যু হয়েছে কিনা তা উদ্ধারকৃত বুলেটের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বা হাসান গ্রেফতার হওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। তার আগে সুনিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি ডিএমপির ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের দুই সার্জেন্ট মামুনুর রশীদ ও সোহেল মিরপুর মডেল থানায় দুইটি মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, তারা রাজধানীর মিরপুর মডেল থানাধীন ঝিলপাড়ের একটি বহুতল বাড়িতে বসবাস করেন। চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি তারা তাদের অস্ত্র বাসায় রেখে বাইরে যান। দুপুর আড়াইটার দিকে তারা কাজের উদ্দেশে বের হওয়ার সময় অস্ত্রের সন্ধান করলে দেখেন অস্ত্র নেই। বাসার জানালার গ্রিল কেটে অন্যান্য মালামালের সঙ্গে অস্ত্র দুইটি চুরি হয়ে গেছে। মামলা দুইটির তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবির পশ্চিম বিভাগ। সেই অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডিবির পরিদর্শক জালালউদ্দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে মারা যান। জালালউদ্দিনের মাথায় দুইটি বুলেট বিদ্ধ হয়ে ব্রেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
×