ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ডলার সঙ্কটে অস্থির মুদ্রাবাজার

অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ঋণপত্র খোলা ও আমদানি ব্যয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২০ মার্চ ২০১৮

অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ঋণপত্র খোলা ও আমদানি ব্যয়

রহিম শেখ ॥ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (্এলসি) খোলা ও আমদানি ব্যয় বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। চলতি অর্থবছরে প্রথম সাত মাসেই (জুলাই-জানুয়ারি) এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ। গেল অর্থবছরের একই সময়ে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১২ শতাংশের মতো। এ সময় খাদ্যপণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানি তেলের এলসি খোলার হার উল্লেখযোগ্য বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের এলসি খোলার হার, প্রায় ২১৫ শতাংশ। এদিকে আমদানি ঋণপত্র বাড়ায় এ খাতে খরচও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এ খাতে আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। এদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলার সঙ্কটে অস্থির হয়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু রফতানি ও রেমিটেন্স সে অনুপাতে না বাড়ায় তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। জানা গেছে, কয়েক মাস ধরে বেসরকারী খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ অনেকটাই বেড়েছে। এর মধ্যে আমদানি অর্থায়নেও বড় অঙ্কের ঋণ গেছে। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাংকের অর্থায়ন বেড়েছে। এতে প্রতি মাসেই আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এ ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৬৩১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গেল অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৬০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। গেল অর্থবছরে একই সময়ে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে অর্থবছরের ছয় মাসে রফতানি বাবদ বাংলাদেশ আয় করেছে ২ হাজার ১৩২ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। গেল অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১ কোটি ৩২ লাখ ডলার। এ হিসাবে রফতানি আয় বেড়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে রিজার্ভের পরিমাণ। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩৩৬ কোটি ডলার। এক সপ্তাহ পর গত ৮ মার্চ সেই রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৯৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এশিয়া ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেশগুলো বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারত থেকে পেঁয়াজ ও চাল আমদানি বেড়ে যাওয়ায় আমদানির পরিমাণ ব্যয় বেড়ে গেছে। সর্বশেষ আকুর দায় পরিশোধের পর আবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। অধিক হারে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ তৈরি করছে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, একটা দিক দিয়ে এতদিন আমরা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ছিলাম, রিজার্ভ প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলারে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু আমদানি বাড়ায় সেটা আর থাকবে না। আমার তো মনে হয় খুব শীঘ্রই রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে। তিনি বলেন, যদি রফতানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ত তাহলে সমস্যা হতো না। আমদানি ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও রেমিটেন্স ও রফতানি আয় বাড়ছে ধীরগতিতে। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা কমলেও ভয়ের কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বেশ কিছু বড় প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলছে। এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানিতে অনেক খরচ বাড়ছে। গত বছর বন্যায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যশস্য আমদানি অনেক গুণ বেড়েছে। এর কারণে রিজার্ভে কিছুটা চাপ পড়েছে। এদিকে আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তি করতে ব্যাংকগুলো ডলারের যে মূল্য ঘোষণা দিচ্ছে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তার চেয়ে দুই টাকা পর্যন্ত বেশি রাখছে। এতে একদিকে বেড়ে গেছে আমদানি ব্যয়, অন্যদিকে ডলার সঙ্কটে অস্থির হয়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। রেমিটেন্স ও রফতানি আয়ে কিছুটা সুবিধা পাওয়া গেলেও আমদানি খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক বছরের কম সময়ে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী টাকার মান কমেছে প্রায় ৪ টাকা। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ডলারের দাম ছিল ৮০ দশমিক ৬৬ টাকা; গত বৃহস্পতিবার সে ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকায়। কোন কোন ব্যাংক বিদেশ গমনেচ্ছুদের কাছে নগদ ডলার বিক্রি করছে ৮৫ টাকারও বেশি দরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা হলো, এখন কোনভাবে ডলারের দাম ৮৩ টাকার বেশি রাখা যাবে না। এরপরও গত কয়েক মাস ধরে ডলারের মূল্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে ভুল তথ্য দিয়েছে দুই ডজনেরও বেশি ব্যাংক।
×