ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উগ্র মতাদর্শের জঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ওদের ওপর আমার বিন্দুমাত্র রাগ নেই- মায়া আছে করুণা আছে ;###;দেশকে এমনভাবে গড়ে তুলুন তরুণরা যেন ভুলপথে না যায়

কোন গ্রেফতার নেই ॥ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা ॥ ১১ দিনেও

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৫ মার্চ ২০১৮

কোন গ্রেফতার নেই ॥ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা ॥ ১১ দিনেও

শংকর কুমার দে ॥ ‘আমার বিন্দুমাত্র রাগ নেই, মায়া আছে, করুণা আছে। কেন এটা করেছে- বেহশতে যাবে বলে? এটা তার মাথায় ঢোকানো হয়েছে। আমার সঙ্গে কথা বলতে আসো। অস্ত্রটা বাসায় রেখে আসো। আমি শুনতে চাই, কেন তোমার এত কষ্ট’- হামলাকারী ফয়জুরের উদ্দেশে এসব কথা বলেছেন বিশিষ্ট লেখক ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ১১ দিন পর সিলেট ফেরার পথে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডমেস্টিক টার্মিনালে ও সিলেটে পৌঁছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে হাস্যোজ্জ্বল জাফর ইকবাল এসব কথা বলেছেন। গত ৩ মার্চ সিলেটের এই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টায় ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে ফয়জুল হাসান ওরফে ফয়জুর নামে এক যুবক যাকে সেলফ রেডিক্যালাইজড বলেছেন পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। হামলাকারী ফয়জুলকে সেলফ রেডিক্যালাইজড অর্থাৎ উগ্রপন্থী অভিহিত করার পর তার বাবা, মা, মামা, ভাই ও পরিবারের সদস্য ছাড়া হামলার ১১ দিন পরও আর কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমনকি জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনার সঙ্গে হামলাকারী ফয়জুরকে দীর্ঘদিন ধরে যারা মোটিভেট করেছে কীভাবে এ হামলা করা হবে, আর কারা তার সঙ্গে জড়িত ছিল, কারা কিভাবে ছক কষে ছিল তদন্তে এখনও সেই রহস্যের জট খোলেনি। দেশব্যাপী বহুল আলোচিত জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টায় হামলার ঘটনার রহস্য উন্মোচনের তদন্ত করছে পুলিশের পাশাপাশি, র‌্যাব, সিআইডি, পিবিআই এবং ঢাকার কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফয়জুল হাসান নামে এক যুবকের হামলায় আহত অবস্থায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১১ দিন চিকিৎসা শেষে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বুধবার সিলেট ফেরার পথে ঢাকায় বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অনেক কথা বলেন। এদিন বিকেলে সিলেটে পৌঁছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন তিনি। তিনি হামলাকারীর উদ্দেশে বলেন, এত সুন্দর পৃথিবী। সেখানে এত সুন্দর সুন্দর কাজ করা সম্ভব। তারা সেগুলো না করে এ ধরনের একটা কাজকে জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে নিয়েছে, সেজন্য তাদের প্রতি আমি দুঃখ অনুভব করি। কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন তরুণরা ভুল পথে না যায়, তারা যেন সাধারণ মানুষের মতো সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে। সিলেটে ফেরার আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি জানান, এখন তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ রয়েছেন। তিনি বলেন, আমার শারীরিক অবস্থা ভাল। আমার মাথায় চারটি আঘাত ছিল। এ কারণে ছেলে মানুষের মতো টুপি পরে এসেছি, যাতে ওগুলো দেখা না যায়। সেগুলোর স্টিচ খুলে দেয়া হয়েছে। ডাক্তার এখন রেস্ট করতে বলেছেন। তবে পিঠ ও হাতে স্টিচ এখনও খোলা হয়নি। সেগুলো ১৮ মার্চ খোলা হতে পারে বলে জানান তিনি। জাফর ইকবাল বলেন, ওই হামলার পর সবাই যেভাবে সহযোগিতা করেছে, চিকিৎসকরা যেভাবে যতœ নিয়েছেন, সেজন্য সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি বলেন, সবার মাঝে ফিরে আসতে পেরে তার খুব ভালো লাগছে। একটা কথা না বললেই না, আমি কে? আমি একটা ইউনিভার্সিটির মাস্টার, বাচ্চা কাচ্চার জন্য বই লিখি, তাই তো? কিন্তু আমাদের প্রাইম মিনিস্টার, উনি নিজে আমাকে ওখান থেকে হেলিকপ্টারে নিয়ে এসেছেন। উনি এত ব্যস্ত। তারপরও নিজে এসে আমাদের দেখে গিয়েছেন। কেউ যেন আসতে না পারে, আমার যেন ইনফেকশন না হয়, সেজন্য নিজে থেকে উনি সেটা বলে গিয়েছেন। আমি কী বলব! আমি উনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই, আমি ডাক্তারদের কৃতজ্ঞতা জানাই, আমি দেশের মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানাই। সিলেট যাত্রাকালে ঢাকার বিমানবন্দরে এই শিক্ষক জানান, যে মুক্তমঞ্চে তার ওপর হামলা হয়েছিল, সিলিটের ক্যাম্পাসে ফিরে সেই মুক্তমঞ্চেই তিনি ছাত্রছাত্রীদের সামনে আসবেন বলে। অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, আমি হয়ত একটু বোকা মানুষ। এজন্য ভয় টয় পাই না। আমার তখনও ভয় করে নাই। ঘটনা যখন ঘটে তখনও ভয় করে নাই। এখনও করছে না। আমি এখনও নিরাপদ বোধ করছি। আমার নিরাপত্তা আসলে পরিচিত মানুষজন। দেশের মানুষ, আমার ছাত্রছাত্রীরা। আর পুলিশ মিলিটারি তো আছেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনোই ভয় পাই না। ওই হামলায় দেশে প্রগতিশীলতার ওপর আঘাত এসেছে বলেও মনে করেন না বলে জানান জাফর ইকবাল। তিনি নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে বলেন, আমাদের দেশটা খুব সুন্দর, খুব সুইট। তোমরা দেশকে ভালবাস, দেশও তোমাদের ভালবাসবে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডমেস্টিক টার্মিনালে জাফর ইকবালের সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ইয়াসমিন হক ও মেয়ে ইয়েশিম ইকবাল। এ সময় তাকে বেশ হাস্যোজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। বুধবার বেলা পৌনে ১টায় সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে পৌঁছে জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমিন হক সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে যেখানে হামলা হয়েছিল বুধবার বিকেল ৪টায় সেখানে বক্তব্য দেবেন জাফর ইকবাল। তাকে এক মাস বেড রেস্টে থাকতে বলেছেন ডাক্তাররা। তবে এক সপ্তাহ থাকতে হবে পুরো বেড রেস্টে। তিনি সিলেট এসেছেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করতে। আগামীকালই আবার ঢাকা ফিরে যাবেন। শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ॥ হোসাইন ইমরান শাবি থেকে জানান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে তার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেছেন, তোমরা দেখিয়েছ ম্যাচিউরড ছেলেমেয়ে হলে কী করতে হয়। এখানেই বসেছিলাম আমরা, যখন আমাকে আঘাত করা হয়েছিল। তিনি বলেন, আমার বিন্দুমাত্র রাগ নাই। মায়া আছে, করুণা আছে। কেন এটা করেছে? বেহেশতে যাবে বলে। এটা তার মাথায় ঢোকানো হয়েছে। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে আসো। অস্ত্রটা বাসায় রেখে আসো। আমি শুনতে চাই, কেন তোমার এত কষ্ট। বুধবার বিকেলে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, একজন মানুষ কত দুঃখী হতে পারে যার মনে হয়, একজনকে মেরে বেহেশতে যাবে। পৃথিবীতে তাকিয়ে দেখো। কী সুন্দর। এ সুন্দর পৃথিবীর কিছুই সে দেখে না, জানে না। কেবল জানে একজনকে মারলে বেহেশতে যাব। তিনি বলেন, এখানেও একজন হয়ত আছে। যে ভাবছে, পারলাম না আরেকবার এ্যাটেম নিতে হবে। তার উদ্দেশে বলছি, আমার সঙ্গে কথা বলতে আসো। অস্ত্রটা বাসায় রেখে আসো। আমি শুনতে চাই, কেন তোমার এত কষ্ট। জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমাকে নাস্তিক বলো? আমি কোরান শরিফ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিখুঁতভাবে পড়েছি। সেখানে একটি আয়াত আছে, তুমি যদি একজনকে মারো, তুমি সারা মানবজাতিকে হত্যা করছো। কেমন করে তারা এত বড় দায়িত্ব ঘাড়ে নেয়। কে তোমাদের এসব বুঝিয়েছে। যারা বুঝিয়েছে তারা নিশ্চিন্তে আছে। আর তুমি, যে কিনা রিমান্ডে আছো, তোমার মা, ভাই, বাবা রিমান্ডে যারা এসব কথা বলো, তারা আসো আমার সঙ্গে কথা বলো। হামলাকারী ফয়জুরের ওপর তার কোন ক্ষোভ নেই উল্লেখ করে তাদের পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতাদের খুঁজে বের করার কথা বলেন। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক উগ্রপন্থী তরুণের হামলায় আহত অধ্যাপক জাফর ইকবাল ১১ দিন পর চিকিৎসা নিয়ে ফিরলেন নিজের প্রিয় ক্যাম্পাসে। বুধবার দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে তিনি ক্যাম্পাসে নিজ বাসভবনে পৌঁছেন। এ সময় সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক ও মেয়ে ইয়েশিম ইকবাল। দুপুর পৌনে ১টায় নভো এয়ারের একটি বিমানে তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন তারা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা জাফর ইকবালকে ফুল দিয়ে বরণ করেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করতে ক্যাম্পাসে ফিরলেও তিনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। একদিন থেকে তিনি আবার ঢাকা ফিরবেন চিকিৎসা নিতে। বিশ্রামও নিতে হবে এক মাস। ক্যাম্পাসে পৌঁছে নিজ বাসভবনের নিচে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, আমি জানতাম না দেশের মানুষ আমাকে এত ভালবাসে। এ আঘাত না পেলে বিষয়টি আমার অজানা থাকত। কারও প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই। আমি মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছি। হামলার পর তার পাশে থাকার জন্য গণমাধ্যমকর্মীসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানান। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই সিলেটে ফিরে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে গেলেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল; যার আঘাতে আহত হয়েছিলেন তার প্রতি রাগ-ক্ষোভ নয়, করুণাই ঝরল তার কণ্ঠে। অধ্যাপক জাফর ইকবালের ক্যাম্পাসে ফেরা উপলক্ষে নিরাপত্তা জোরদার করতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মুক্তমঞ্চের সমাবেশকে কেন্দ্র বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী। ক্যাম্পাসের প্রবেশ পথগুলোতে যাতায়াতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। সিলেটে ফিরে বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে বক্তব্য দেন জাফর ইকবাল, যেখানে গত ৩ মার্চ তাকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে হামলা করে উগ্রপন্থী তরুণ ফয়জুল হাসান। মাথা, পিঠ ও হাতের জখম নিয়ে ১২ দিন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার পর বুধবার সকালে ছাড়া পান জাফর ইকবাল। গত ৩ মার্চ র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হামলাকারী ফয়জুল হাসান বলেছে, জাফর ইকবাল ‘ইসলামের শত্রু’। এ জন্যই সে হত্যার উদেশ্যে হামলা করেছে। জাফর ইকবালকে প্রথমে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচার শেষে রাতেই তাকে পাঠানো হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। জাফর ইকবাল বলেছেন, সাবেক মাদরাসা ছাত্র ফয়জুলের মতো এই চিন্তা-ভাবনার মানুষ তার আশপাশে অনেক আছে বলে মনে করেন তিনি। ছাত্র-শিক্ষকদের ওই সমাবেশে তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত সে ছেলে শুধু একা নয়, তার মতো অনেকে আছে, এখানেই হয়ত দাঁড়িয়ে আছে, যে নাকি আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে পারলাম না, আরেকবার ‘এটেম্পট’ নিতে হবে। উগ্রপন্থীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে যদি কোন বিভ্রান্তি থাকে তাহলে আস, শুধু অস্ত্রটা বাসায় রেখে এসো, সামনা সামনি আমার সঙ্গে কথা বল প্লিজ তোমার মনে যে বিভ্রান্তি আছে তা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বল। আমি জানতে চাই, আমি শুনতে চাই। কোরান শরীফে বলা আছে, তুমি যদি একজন মানুষকে মার, তুমি যেন সব মানবজাতিকে হত্যা কর। তাহলে একজন মানুষ যদি কোরান শরীফ পড়ে তাহলে কী করে সে একজন মানুষকে হত্যা করে? অধ্যাপক জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় হামলাকারী ফয়জুল হাসান ছাড়াও তার বাবা শফিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফজলুল হক, চাচা ও ভাই এনামুল হাসান গ্রেফতার হয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রিমান্ডে নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জাফর ইকবাল এই প্রসঙ্গ তুলে হামলাকারীর উদ্দেশে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, কে তোমাদের বিভ্রান্ত করে? কে তোমাদের বুঝিয়েছে? যারা তোমাদের বুঝিয়েছে তারা নিশ্চিন্তে আরামে বসে আছে। তাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে। তুমি যার কথা শুনে এ কাজে নেমেছ, তুমি জেলখানায় আছ, রিমান্ডে আছ। তোমার বাবা-মা-ভাই-বোন রিমান্ডে আছে। এটা কি একটা জীবন হলো? কেন এই জীবন বেছে নিয়েছ? সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ নিয়ে সোচ্চার অধ্যাপক জাফর ইকবালের আগে বিভিন্ন সময় জঙ্গীদের হুমকি পেয়েছিলেন। ৩ মার্চ বিকেলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠান চলাকালে পুলিশের উপস্থিতিতে হামলার শিকার হন তিনি। জাফর ইকবালের বাঁ হাতে এখনও ব্যান্ডেজ, মাথায় টুপি পরে প্রসঙ্গে বলেন, আমার মাথায় চারটি আঘাত ছিল। এ কারণে ছেলে মানুষের মতো টুপি পরে এসেছি, যাতে ওগুলো দেখা না যায়। সেগুলোর স্টিচ খুলে দেয়া হয়েছে। ডাক্তার এখন রেস্ট করতে বলেছেন। আগামী ১৮ মার্চ পিঠ ও হাতে স্টিচ খোলা হতে পারে বলে জানান তিনি। জাফর ইকবালকে এক মাস বেড রেস্টে থাকতে বলেছেন ডাক্তাররা। তবে এক সপ্তাহ থাকতে হবে পুরো বেড রেস্টে। তিনি সিলেট গেছেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি বলেন, আমি শুধু আমার প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জানাতে এসেছি, আমি ভাল আছি। পুরোপুরি সুস্থ না হলেও শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করতে সিলেট এসেছেন বলে জানান জাফর ইকবাল। বৃহস্পতিবারই জাফর ইকবাল আবার ঢাকা ফিরবেন। সন্দেহে আনসার আল ইসলাম জঙ্গী সংগঠন ॥ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) বা আনসার আল ইসলাম এই হত্যা চেষ্টার নেপথ্যে সম্পৃক্ত রয়েছে মনে করেই তদন্ত শুরু করেছে তদন্তকারীরা। ২০১৩ সালে এই জঙ্গী সংগঠনটির হিটলিস্টে নাম পাওয়া যায় জাফর ইকবালের। তারপর তার কাছে কাফনের কাপড় পাঠায় এই জঙ্গী সংগঠনটি। ২০১৬ সালে জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন হককে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হত্যার হুমকি দেয় এই জঙ্গী সংগঠনটি। দেশে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি করতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য এই হত্যা চেষ্টার ঘটনাটি ঘটানোর জন্য অশুভ মহলের একটি চক্রান্ত বলে তদন্তকারীদের দাবি। জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টার ঘটনায় এ পর্যন্ত হাতে নাতে ধরা পড়া হামলাকারী ফয়জুল হাসান ছাড়াও তার মা, বাবা, ভাই, চাচা, মামা, কম্পিউটার ব্যবসায়ীসহ সাতজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কারা, কিভাবে, কেন, হত্যার চেষ্টার ঘটনা ঘটিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে ব্যর্থতা বা অবহেলা ছিল কিনা, পর্দার অন্তরালের নেপথ্যের মদদদাতাদের চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত করা হচ্ছে। এছাড়া জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর হামলার ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও কাজ শুরু করেছে। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান জাফর ইকবাল ॥ পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর জাফর ইকবালকে হত্যা চেষ্টার মামলাটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দ্রুততার সঙ্গে প্রত্যক্ষ হত্যা চেষ্টাকারী ও পরোক্ষভাবে মদদদাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য তদন্ত করা হচ্ছে। জাফর ইকবালকে যেভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, ঠিক অনুরূপভাবে প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার অভিজিত রায়সহ অন্তত ১৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। একমাত্র ব্লগার রাজীব হত্যাকা- ছাড়া এই ১৪ জন প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক হত্যাকারীদের আইনে সোপর্দ করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ব্যর্থতার কারণেই এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এ জন্যই জাফর ইকবালের হত্যা চেষ্টার ঘটনাটির বিষয়ে সিলেটের জালালাবাদ থানায় অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ের করা মামলাটির তদন্ত পুলিশের হাতে থাকলেও ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব, পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি), গোয়েন্দা সংস্থা। জাফর ইকবালকে হত্যার হুমকি, কাফনের কাপড় পাঠানো, হিটলিস্টে নাম থাকার ঘটনায় জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী সিলেটের জালালাবাদ থানায় জিডি করার পর ২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিল থেকেই ২৩ জনের পুলিশ টিম পালাক্রমে তাদের সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহড়া দিয়ে নিরাপত্তা দিয়ে আসছে সরকার। জাফর ইকবালকে হত্যার হুমকি, কাফনের কাপড় পাঠানো, হিটলিস্টে নাম থাকার ঘটনায় জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী সিলেটের জালালাবাদ থানায় জিডি করার পর ২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিল থেকেই ২৩ জনের পুলিশ টিম পালাক্রমে তাদের সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহড়া দিয়ে নিরাপত্তা দিয়ে আসছে সরকার। তবে ঘটনার সময়ে যারা পুলিশ প্রহড়ায় ছিল তাদের মধ্যে দুই কনস্টেবলকে সিসিটিভির ক্যামেরার ফুটেজে মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ব্যস্ত থাকার দৃশ্যে দেখা যাওয়ায় তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। অপরপক্ষে জাফর ইকবালকে রক্ষা করতে গিয়ে দুই পুলিশ কনস্টেবল আহতও হয়েছেন। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান জাফর ইকবাল।
×