ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সারাদেশে নিবন্ধিত খামার ৩৬৩২, রফতানিরও সুযোগ রয়েছে

গ্রামেগঞ্জে গড়ে উঠছে ভেড়ার খামার, অনেকেই স্বাবলম্বী

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১০ মার্চ ২০১৮

গ্রামেগঞ্জে গড়ে উঠছে ভেড়ার খামার, অনেকেই স্বাবলম্বী

ওয়াজেদ হীরা ॥ অভাবের দিনগুলোতে ছোট্ট সন্তান নিয়ে একাই লড়াই চালিয়েছেন ফরিদা খাতুন (৩৪)। আরেকটি বিয়ে করে স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর ভাগ্য উন্নয়নে লড়াই করেন এই নারী। দুটি ভেড়া কিনে শুরু করেন ভেড়া পালন। সেই থেকে শুরু, আর ফিরে তাকাতে হয়নি। সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের এই লড়াকু নারী এখন সফল ভেড়ার খামারি। প্রায় অর্ধশত ভেড়া এখনো তার খামারে পালন হচ্ছে। সংসারে এসেছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও। ফরিদার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসংখ্য নারী এই ভেড়া পালনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে আর পরিবারের বাড়তি আয়ের যোগান দিচ্ছে। শুধু নারীরাই নয় রয়েছে পুরুষরাও। এছাড়াও অনেক শিক্ষিত তরুণ বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে গড়ে তুলছেন ভেড়ার খামার। বেকারত্ব দূর করে নিজেরা যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছেন সেই সঙ্গে হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নতিও। অন্যান্য প্রাণীর মতো বাণিজ্যিকভাবে ভেড়া পালনের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। আর ভেড়ার খামার করার মাধ্যমে বেকারত্ব ঘুচানোসহ আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ারও রয়েছে অপার সম্ভাবনা। অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে এই প্রাণীতে লালন-পালন খরচ ও রোগব্যাধি কম হওয়ায় ক্রমেই মানুষ এর খামারের দিকে ঝুঁকছে। আগে শুধু গরু বা ছাগল পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন নতুনত্ব ও সৃষ্টিশীল চিন্তা নিয়ে নানা কিছুর লালন-পালন হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে ভেড়ার খামার। আর প্রাণিসম্পদ অধিদফতর জানিয়েছে দিন দিন এই খামারের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করা হচ্ছে। লাভজনক হিসেবে বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে বার্তা দেয়া হচ্ছে। জানা গেছে, দেশের উত্তর, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক গড়ে উঠেছে অনেক ভেড়ার খামার। তুলনামূলক কম পুঁজিতে গড়ে তোলা ২০-৩০টি ভেড়ার একটি খামারে বছরে আয় ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ টাকা। বিদেশে ভেড়ার মাংস ও পশমের চাহিদা অনেক বেশি। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানিরও প্রচুর সুযোগ রয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুরের গলাচিপার আল মামুন ও আড়াইবাড়িয়ার আবুল কালাম এরা ভেড়া পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। অল্প সময়ের প্রশিক্ষণে তাদের অনেকে লাভবান হয়েছে বলেও জানান জনকণ্ঠের এই প্রতিবেদকের কাছে। যোগাযোগ করা হলে আবুল কালাম বলেন, অর্থনৈতিকভাবে একটু দুর্বল আমি। ভেড়ার জন্য আলাদা ঘর হলে ভাল হয় তবে ঘর তৈরির চেষ্টায় আছি। দুটি ভেড়া দিয়ে অনেক ভেড়া পেয়েছি বিক্রি করেছি। ভেড়ার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমি আরও ভালভাবে এটি পালন করা শিখেছি। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসেবে সারা দেশে ৩৬৩২ ভেড়ার নিবন্ধিত খামার রয়েছে। এর বাইরেও কেউ কেউ অল্প পরিসরে দুই চারটি বা ১০ থেকে বিশটি করে ভেড়া লালন পালন করছে। দেশের প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন এবং জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানের কথা বিবেচনায় বর্তমান সরকারের ৩১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘সমাজভিত্তিক ও বাণিজ্যিক খামারে দেশী ভেড়ার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ (কম্পোনেন্ট-বি) প্রকল্প’। প্রকল্পের পরিচালক জানিয়েছেন, ২০১২ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হবে। ইতোমধ্যে দেশে তিনটি ডেমনেস্ট্রেশন খামার স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো করা হয়েছে রাজশাহী, বগুড়া এবং বাগেরহাট জেলায়। ডেমনেস্ট্রেশন খামারের মাধ্যমে খামারে উৎপাদিত বাড়ন্ত ভেড়ী ও পাঁঠা খামারীদের মধ্যে নির্ধারিত সরকারী মূল্যে বিতরণ করা হবে। প্রকল্প কর্মকর্তারা আশা করছেন এইভাবে খামারিদের মধ্যে বাড়ন্ত ভেড়ী বিতরণ করা হলে মানুষ সহজেই ভেড়ার খামারে আরও বেশি উৎসাহী হবে। এছাড়াও প্রকল্পের অধীনে পার্বত্য অঞ্চলের ২৫ উপজেলায় ৫০০ পরিবারের মাঝে ১৫০০ ভেড়া বিনামূল্যে বিতরণ, ১৩০০০ সুফলভোগীকে ভেড়া পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া, ১২৮ কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার ভেড়ার খামার তৈরি, সারাদেশে ১৩০০০ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ভেড়ার খামার স্থাপন এবং ভেড়ার মাংস জনপ্রিয় করার নানামুখী প্রচার চালানোসহ প্রকল্পের প্রায় সব কাজ শেষ হয়েছে। ৬৪ জেলায় ৪৮০ উপজেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আগ্রহী প্রায় ছয় হাজার খামারির মধ্যেও দেয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ। যাদের অনেকেই এখন ভেড়া পালনে লাভবান হচ্ছে। পূর্বের চেয়ে আরও গোছালভাবে তৈরি করছে ভেড়ার খামার। আর বাড়াচ্ছে আয়। ১৩ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ভেড়ার খামারিদের কারও দুদিন কারও পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের আজিজুল, আবুল কুমার, খুকি, আছিয়া খাতুন, রাহিমা বেগড়ম সবাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও একই জেলার অষ্ট্রগ্রামের শাসছুননাহার, পাপিয়া আক্তার, আনোয়ারা বেগম, ঝরণা আক্তার, মরিয়ম কিংবা সুমি প্রশিক্ষণ নিয়ে লাভবান হয়েছেন। এদের অনেকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে জানা যায়, এরা অল্প সময়ে জানতে পেরেছে ভেড়া পালনের সঠিক পদ্ধতি। একই সাথে ভেড়া পালনের সাধারণ কিছু বিষয়। প্রশিক্ষণ শেষে অনেকের ভেড়ার খামারও গড়ে তুলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। একটি দুটি করে ক্রমেই ভেড়ার পাল বাড়ছে। সিলেট, সুনামগঞ্জের কতিপয় প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীরা মুঠোফোনে বলেন, ভেড়ার এই প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা এখন সহজেই পরিচ্ছন্ন বাসস্থান, বা ভেড়ার খাবার নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। এছাড়াও ভেড়ার রোগ বিষয়ে একটু সচেতন এখন। স্বল্প পুঁজির এ সকল উদ্যোক্তাদের মতে, ভেড়া পালন লাভজন তবে কিছুটা মূলধন হলে দ্রুতই খামারে ভেড়ার সংখ্যা বাড়বে। ভেড়া পালন করা সফল খামারি শরিফুল বাশার। দশটি ভেড়া দিয়ে শুরু করলেও এখন তাঁর খামারে রয়েছে প্রায় ৩৫টি ভেড়া। তিনি বলেন, দেশের উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে খাপ খাইয়ে একটি ভেড়ি বছরে ২ বার এবং প্রতিবারে ২ থেকে ৩টি বাচ্চা দেয়। ছাগলের চেয়ে এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং বাচ্চার মৃত্যুর হারও অত্যন্ত কম। শুরুটা কষ্টকর হলেও পরবর্তীতে উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সহায়তায় এখন বেশ দক্ষ এই খামারি। জানা গেছে, জাতীয় আয় ও সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদের মধ্যে ৪র্থ স্থান অধিকারীর ভেড়া অত্যন্ত কষ্ট সহিষ্ণু। এছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশে শুকনা খড় এবং শস্যের অবশিষ্টাংশ খেয়েও জীবন ধারণ করতে পারে। খামার পরিচালনায় খাদ্য খরচ অনেক কম। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অনেক জেলায় ভেড়া পালনের সম্ভাবনা বেশি। যেসব জায়গায় পতিত জমি থাকে বন-জঙ্গল আছে সেখানে পালনের সুবিধাও বেশি। ভেড়া পালনের খরচ কম উল্লেখ করে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভেড়া পালনের সুবিধা অনেক। গরু যে ঘাস খেয়ে যায়, পেছন পেছন ভেড়া উচ্ছিষ্ট ঘাসটি খেয়ে নেয়। তাদের জন্য বাড়তি কোনও খাবার লাগে না। একটু খেয়াল রাখলেই চলে। কোন শ্রমও দিতে হয় না। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের খামার বিভাগ থেকে জানা যায়, একটি প্রাপ্তবয়স্ক ভেড়ার ১৫ থেকে ২০ কেজি হতে পারে। প্রতিটি ভেড়া থেকে বছরে গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি পশম পাওয়া যায়। যা দিয়ে উন্নতমানের শীতবস্ত্র নির্মাণ করা যায়। ভেড়া উৎপাদন বাড়ার হার শতকরা ১২ ভাগ। যা গরু, ছাগল ও মহিষের চেয়ে অনেক বেশি। এদের বাসস্থানের খরচও কম। নরম, রসালো ও সুস্বাদু ভেড়ার মাংসে আমিষের পরিমাণ গরু ও ছাগলসহ অন্যদের চেয়ে বেশি। ভেড়ার মাংসে জিংক, আয়রন এবং ভিটামিনের পরিমাণ বেশি এবং চর্বি ও কোলেস্টরেল কম। বাণিজ্যিকভাবে গারোল প্রজাতির ভেড়া পালন বেশ জনপ্রিয়। নওগাঁয় একাধিক খামারির সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশীয় ভেড়া থেকে গারোল প্রজাতির ভেড়ায় ১০ থেকে ১৫ কেজি বেশি মাংস পাওয়া যায় বলে খামারিদের আগ্রহ এখন এই ভেড়াতে। এছাড়াও ভাল বাজার দর ও সহজে প্রতিপালন করা যায় বলে এর চাহিদা তৈরি হয়েছে। সরকারের এই উদ্যোগে দেশে বর্তমানে ভেড়ার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ। বর্তমানে বছরে প্রতিটি ভেড়ি গড়ে ২.৫টি করে বাচ্চা দেয়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডাঃ মোঃ আইনুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, আমার অন্যান্য সেক্টরের মতো ভেড়ার প্রতিও গুরুত্ব দিয়েছি। ভেড়া লালন পালনের মাধ্যমে শুধু বেকারত্বই নয় বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের মাধ্যমে দেশের সমৃদ্ধির চাকা আরও ঘুরে যেতে পারে। সরকার ইতোমধ্যেই নানা পদক্ষেপ ও প্রজেক্টের মাধ্যমে এই বিষয়টির ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন বলে জানান মহাপরিচালক। বর্তমানের তরুণদের লেখাপড়া শেষে বসে না থেকে বিভিন্ন ধরনের খামার গড়ে তোলার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ভেড়া পালনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার একটি পথ হতে পারে। একটু যতœ নিয়ে এটিও ছাগলের মতো পরিপাটি ও সুন্দর লাগে। দক্ষিণ ভারতে থাকার সময় আমি দেখেছি সেখানে ভেড়া পালন এবং এর উন্নয়ন। আমাদের দেশেও ভেড়ার মাংস জনপ্রিয় করতে পারলে গরু এবং ছাগলের মাংসের ওপর চাপ যেমন কমবে একই সাথে মানুষের এটি পালনের আগ্রহ আরও বেশি বাড়বে। ভেড়া পালনের মাধ্যমে শুধু মাংসই নয় একই সঙ্গে এর পশমের মাধ্যমে আরও অনেক প্রোডাক্ট পাওয়া সম্ভব সেটিও জানান এই অধ্যাপক। সরকারের নানা উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে এসব লালন-পালনের মাধ্যমে সংসারে বাড়তি আয় যোগান দেয়ার। এছাড়াও শিক্ষিতরা যদি চাকরির আশায় বসে থেকে সময় নষ্ট না করে বিভিন্ন খামারের প্রতি আকৃষ্ট হয় তবে শুধু নিজেকে স্বাবলম্বীই নয়;বরং অন্যদের চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও থাকবে। আর সে হিসেবে ভেড়া পালন একটি উপযুক্ত প্লাটফর্ম হতে পারে।
×