ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. শেখ আবদুস সালাম

পদ্মা সেতু ॥ যথাসময়ে যেন শেষ হয়

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৬ মার্চ ২০১৮

পদ্মা সেতু ॥ যথাসময়ে যেন শেষ হয়

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর ৩৭ এবং ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর একটি স্প্যানের প্রথম গার্ডারটির ইরেকশন সম্পন্ন হয়েছিল। তখন টেলিভিশনের পর্দায় ‘দৃশ্যমান’ পদ্মা সেতু দেখে আমরা আনন্দবোধ করেছিলাম। এ বছর জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ৩৮ এবং ৩৯ নম্বর পিলারের ওপর আর একটি গার্ডার ইরেকশন সম্পন্ন হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কয়েক মাস আগে আশা পোষণ করে বলেছিলেন যে, ২০১৮ সালের শেষ দিকেই এই সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি পার হবে। এসব খবর সত্যিই আমাদের মধ্যে এক অন্য ধরনের আশাবাদের জন্ম দেয়। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টার টেস্টিমনি হিসেবে দৃশ্যমান পদ্মা সেতু যেমন উন্নয়নের বাস্তব উদাহরণ জোগায়, তেমনি সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিও এর ফলে আমাদের আস্থা অনেক বেড়ে যায়। গত ২১ জানুয়ারির পত্র-পত্রিকায় এই প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী যথাসময়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। সম্প্রতি আমাদের সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও জাতীয় সংসদে বলেছেন যে, যথাসময়ে পদ্মা সেতু সমাপ্ত করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। পদ্মা ব্রিজের কাজটি প্রাথমিকভাবে শুরু করা হয়েছিল যুমনা বহুমুখী ব্রিজ প্রোজেক্টের একটি সম্প্রসারিত কাজ হিসেবে (১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়)। এই সেতু সম্পর্কে ২০১০ সালে প্রকাশিত তাদের একটি প্রবন্ধে S H R Sham, G X Yu and S. D Silva লিখেছেন- In developing suitable design solution AECOM has utili“ed the state – of the art geotechnical and structural technologies, to provide the bridge with a robust foundation system. এই সেতুর ভূ-প্রকৌশলগত এবং কাঠামোগত (geotechnical and structural) কাজ সম্পাদনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জড়িত। যুক্তরাজ্যের জচঞ এবং নেদারল্যান্ডসের NEDECO-কে দিয়ে এই সেতুর কনসেপচুয়াল ডিজাইন ও প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডির কাজ করানো হয়েছিল। তারা ২০০০ সালে তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছিল। জাপানের ঘরঢ়ঢ়ড়হ কড়র ঈড়. খঃফ এবং ঈচঈ এই ব্রিজ নির্মাণের ফিজিবিলিটি স্টাডি এবং প্রিলিমানারি ডিজাইনের কাজটি করেছিল। তারা রিপোর্ট দিয়েছিল ২০০৫ সালে। Maunsell AECOM (যুক্তরাষ্ট্র, হংকং বেজ্ড কোম্পানি) এই সেতুর ডিটেইল্ড স্টাডি ও ফাইনাল ডিজাইন সম্পন্ন করে চূড়ান্তভাবে সুপারস্ট্রাকচার সল্যুশনের কথা বলে ২০১০ বা ২০১১ সালে তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছিল। স্মর্তব্য, ২০১৫ সালে যখন পদ্মা সেতুর প্রাথমিক পাইলিং কাজ শুরু হয় তখন বর্তমানে দেশের বাইরে কর্মরত Kocks Consult এসনঐ-এর একজন বাংলাদেশী সিনিয়র সেতু প্রকৌশলী আমার কাছে পদ্মা সেতু যথাসময়ে শেষ হওয়ার ব্যাপারে সংশয়ের কথা জানিয়েছিলেন। বর্তমানে পদ্মা সেতুর কাজ যখন বিরামহীনভাবে এগিয়ে চলেছে, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে পদ্মা নদীর তলদেশের মাটির গতি-প্রকৃতির যে বিষয়টি আমরা জানতে পারছি তা যথাসময়ে সেতু বাস্তবায়নকে খানিকটা হলেও যেন অনিশ্চিত করে তুলেছে। সেই কারণে অনেকে ধারণা করছেন, পদ্মা সেতু শেষ করতে ২০১৯ সাল বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত গড়িয়ে যেতে পারে। কিছুদিন ধরে যথাসময়ে পদ্মা সেতু শেষ হওয়ার ব্যাপারে কিছু আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসের দিকে জামিলুর রেজা চৌধুরীর মুখ থেকেও সেই আশঙ্কার কথা উচ্চারিত হয়েছিল। তিনি তখন বলেছিলেন যে, পদ্মা সেতু শেষ হতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৬ মাস বেশি সময় লেগে যেতে পারে। সম্প্রতি Kocks Consult এসনঐ-এর সেই ইঞ্জিনিয়ার সাহেব পদ্মা সেতু যথাসময়ে শেষ করা সম্ভব হবে না- এই মর্মে তার সেই ধারণার ওপর ভিত্তি করে আমাকে কিছু তথ্য পাঠিয়েছেন। সেসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই আমার এই লেখা। যতদুর জানা যায়, হংকংভিত্তিক যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান অঊঈঙগ তখন পদ্মা সেতুর সাব-সয়েল ইনভেস্টিগেশনের কাজটি করেছিল। তখন তারা যেখানে যেখানে পাইল বসবে সেসবের প্রতিটি পর্যায়ে নদীর নিচের মাটির স্তর কেমন সে সম্পর্কেও নিশ্চয়ই তাদের মতামত দিয়েছিল। এসবের ওপর ভিত্তি করেই বর্তমান পদ্মা সেতুর টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল এবং সেভাবেই কনট্রাক্ট এ্যাওয়ার্ড বা কর্মচুক্তি সই করা হয়েছিল। এখন টেন্ডার প্রাপক অর্থাৎ কন্ট্রাক্টিং প্রতিষ্ঠিান পাইলিং-এর কাজ করতে গিয়ে দেখছে যে, মাটি স্তরের চেঞ্জিং রেঞ্জ এত বিস্তৃত যে, ফাউন্ডেশন নির্মাণের ব্যাপারটিতে এখন বড় আকারে পরিবর্তন করতে হতে পারে। যদি তা হয় সেক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায়- আগের যে তথ্য বা ফিজিবিলিটি রিপোর্ট কিংবা ডিজাইন, সেখানে গোড়াতেই কি কোন ক্রটি ছিল? এখন এসে সেসবের ওপর কি ভরসা করা যাচ্ছে না? বলা হচ্ছে, পদ্মার তলদেশের সয়েলের বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু কি সেই অপ্রত্যাশিত এবং অজানা পরিবর্তন বা কারণ, যার জন্য হঠাৎ করে পদ্মা ব্রিজের পাইলিং-এর কাজ থমকে যেতে বসেছে? কেন এখন বিশেষ করে মাওয়া পয়েন্টের ফাউন্ডেশন তথা পাইলিং নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে? কন্ট্রাক্ট এ্যাওয়ার্ড পেয়ে একটি চায়না কনস্ট্রাকশন ফার্ম বর্তমানে পদ্মা ব্রিজের কাজটি করে যাচ্ছে। আমরা ধারণা করতে পারি, পদ্মা ব্রিজের শুরুতে যারা ডিজাইন করেছে, পাইল ফাউন্ডেশনের প্রতিটি লোকেশনে যারা সয়েল টেস্ট করেছে কিংবা ফাইনাল কনস্ট্রাকশনের আগে যারা কনফরমেটরি রিপোর্ট দিয়েছে, সেগুলো নিশ্চয়ই টেন্ডার ডকুমেন্টে সংযুক্ত ছিল। কন্ট্রাক্টিং বা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি অন্যের প্রণীত এসব রিপোর্টে সন্তুষ্ট হয়ে অথবা নিজেরা কনফরমেটরি রিপোর্ট তৈরি করে ২০১৮ সালে ব্রিজ নির্মাণ কাজ শেষ করে দেবে বলে কনট্রাক্ট সই করেছে। সেক্ষেত্রে কাজ শেষ করতে তারা সময় বৃদ্ধির বা সে কারণে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির কথা বললে অথবা এ ধরনের কোন ইস্যু সামনে আনলে সেটা ঠিক হবে না। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, নির্মাণ ঠিকাদার কোম্পানি কাজ শেষ করার মেয়াদ নাকি আরও ২৩ মাস বৃদ্ধি করার জন্য প্রস্তাব প্রদানের চিন্তা-ভাবনা করছে। সেক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর নির্মাণের কাজ ২০২০ সালের পরেও গড়িয়ে যেতে পারে। এ সময় এসে তারা যদি হঠাৎ করে দেখতে পায় যে, তাদের টেন্ডার ডকুমেন্ট এবং মাঠের (পদ্মার তলদেশের) বাস্তবতা এক নয়, তাহলে তারা কিন্তু প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়া অথবা ভেরিয়েশন অর্ডার (ঠঙ) দাবি করে সময় বৃদ্ধি চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে একদিকে যথাসময়ে ব্রিজের কাজ শেষ না হওয়া, অন্যদিকে প্রকল্পে আরও এক ধাপ অর্থ বৃদ্ধির সুযোগ ঘটাÑ এসব আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে নির্মাণ কোম্পানির দাবি চুক্তিগতভাবে কিন্তু সঠিক। উপর্যুক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তাদের কিন্তু দোষ দেয়া যাবে না। এমতাবস্থায় সরকারের একটু খতিয়ে দেখা দরকার যে, আশঙ্কার বিষয়টি আসলে কোথায়? এই পর্যায়ে এসে কেন এমন আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে? এর জন্য দায়ী তাহলে কে বা কারা? এই আশঙ্কার সঙ্গে অর্থ বৃদ্ধিরও কিন্তু একটি বড় বিষয় রয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা হচ্ছে যে, পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও এক ধাপ বৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, পদ্মা সেতু বর্তমান সরকারের জন্য রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এই প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়নের ওপর ‘সরকারের ওপর মানুষের আস্থা’, বিশেষ করে মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রীর আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠার বিষয়টি প্রচ-ভাবে নির্ভর করছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে সেতুমন্ত্রীর অক্লান্তভাবে লেগে থাকাÑ এই দুটি বিষয়ের কারণে পদ্মা সেতু নিয়ে কিন্তু মানুষের মনে একটি আস্থার জায়গা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে। এটাতে যেন কোনভাবেই চিড় না ধরে। সম্প্রতি সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর মূল কাজ ছাপ্পান্ন শতাংশ শেষ হয়েছে। তিন বছরে যদি ৫৬% কাজ শেষ হয়, তাহলে বাকি ১১ মাসে কিভাবে ৪৪% কাজ শেষ হবে সাধারণ মানুষের কাছে সেটি কিন্তু একটি প্রশ্ন। তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ব্রিজের জন্য পদ্মা নদী অংশে (অফশোরে) পাইল বসবে বা পাইল ফাউন্ডেশনের কাজ হবে ২৪০টি লোকেশনে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৮৮টির এবং আংশিকভাবে শেষ হয়েছে ১০টির। সেক্ষেত্রে এই কাজের অগ্রগতি কিন্তু কমবেশি ৪০ শতাংশ। ৬০ শতাংশ কাজ এখনও বাকি। নদীর উভয় তীরে পাইল ফাউন্ডেশন হবে ২৮টি। কাজ শেষ হয়েছে ১৬টির। এ কাজেরও ৪২ শতাংশ বাকি। ঠরধফঁপঃং-এর (উভয় তীরে) পাইল বসবে মোট ৩৬৫টি। এক্ষেত্রে কাজ সম্পন্ন হয়েছে ২৫৭টির, অর্থাৎ এখনও প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ বাকি। এছাড়াও মূল সেতুতে পিলার (পাইল ক্যাপ, পিয়ের স্টেম, হেড ইত্যাদি) সংখ্যা হবে ৪২টি, যার মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৪টির। একইভাবে নদীর উভয় তীরে ঠরধফঁপঃং-এ পাইল, ক্যাপ ইত্যাদির প্রয়োজন হবে ৭৭টি, কিন্তু কাজ হয়েছে মাত্র ৪টির। এছাড়াও নদীর ওপর লোকেশনগুলোতে গ্রিডার (স্টিল ট্রাস এবং কনক্রিট) বসবে ৪১টি। কিন্তু ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত হিসাব মতে দেখা যায় আজ পর্যন্ত বসানো হয়েছে মাত্র ১টি। নদীর ওপর মূল সেতুতে কিংবা নদীর উভয় তীরে ঠরধফঁপঃং-এর ক্ষেত্রে কম্পোজিট বা কংক্রিট ডেকের কোন কাজ এখন পর্যন্ত হাতে নেয়া যায়নি। অর্থাৎ পদ্মা সেতুর মূল কম্পোনেন্টসমূহের কাজের অগ্রগতির যে চিত্র তা কিন্তু এখনও তেমন স্পষ্ট নয়। যা হোক, আমার ধারণা এসবের একটা প্রকৌশলগত এবং প্রযুক্তিগত ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই সরকার তথা সেতু বিভাগের হাতে রয়েছে। পদ্মা সেতু সময়মতো (ডিসেম্বর ২০১৮) শেষ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি সরকার এবং সেতু বিভাগেরও এ বিষয়ে একটি প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন কিংবা আশাবাদের দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছি সেটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব আর দৃঢ়তার ওপর আস্থা নিয়ে ২০১৮ সালে পদ্মা সেতু শেষ হবে বলে মানুষ যেভাবে আশাবাদী হয়ে বসে আছে, সেখানে যেন মারাত্মক কোন ব্যত্যয় না হয়। আমরা যেন এ ব্যাপারে কোন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে না যাই। লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×