ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ বছরেও উদ্ঘাটিত হলো না মিরাজ খুনের রহস্য

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৪ মার্চ ২০১৮

পাঁচ বছরেও উদ্ঘাটিত হলো না মিরাজ খুনের রহস্য

শংকর কুমার দে ॥ যুদ্ধাপরাধীর মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বিশিষ্ট সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল সাক্ষী হওয়ার কারণেই কি তার ছোট ভাই মিরাজ আহমেদ খুন হয়েছিলেন? দীর্ঘ পাঁচ বছরের তদন্তেও রহস্য উদঘাটিত তো হলোই না, বরং খুনের রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীর মামলা চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল। বড় ভাই যুদ্ধাপরাধীর সাক্ষী হওয়ার কারণে প্রতিশোধ নিতে তার ছোট ভাই মিরাজ আহমেদকে পরিকল্পিতভাবে ঠা-া মাথায় খুন করা হয়েছে বলে মনে করে তদন্ত এগুচ্ছিল। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ বছরের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর তা কার্যকর হয়ে গেলেও তার মামলার সাক্ষী হওয়ার প্রতিশোধের শিকার মিরাজ খুনের তদন্ত আর সামনে না এগিয়ে আরও পেছনের দিকে চলে গেছে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ২০১৩ সালের এই মার্চ মাসে মিরাজ খুন হওয়ার পর রহস্য উদঘাটনের তদন্ত পায় সিআইডি। দীর্ঘ পাঁচ বছরে খুনের রহস্য উদঘাটনের তদন্ত যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। সিআইডি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খুনের পর পরই তখন তদন্তকারীদের সন্দেহ হয় যে জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে বড় ভাই বিশিষ্ট সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল সাক্ষী হওয়ার কারণেই কি তার ছোট ভাই মিরাজ আহমেদ খুন হয়েছিলেন? খুনের ঘটনার দীর্ঘ পাঁচবছর ধরেই সাক্ষী হওয়ার কারণেই মিরাজ আহমেদ খুন হয়েছে কিনা সেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে সিআইডি। ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলের ছোট ভাই মিরাজ আহমেদ হত্যাকা-ের ঘটনায় জামায়াতÑশিবিরের সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়টির পথ ধরে তদন্ত এগুলেও মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর যেন খুনের ঘটনাটি রহস্য উদঘাটিত হওয়ার আগেই থমকে গেছে। তদন্ত সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী জামায়েতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বিশিষ্ট সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হওয়ার পর তার ছোট ভাই মিরাজ আহমেদ খুন হন ২০১৩ সালের ৯ মার্চ। খিলক্ষেত কুড়িল বিশ্বরোডের রেললাইনের পাশ থেকে মিরাজ আহমেদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর খুনের রহস্য উদঘাটনের জন্য সিআইডির কাছে তদন্তভার ন্যস্ত করা হয়। সিআইডিতে মামলাটির তদন্তভার হস্তান্তরের পর মিরাজ হত্যাকা-ের ঘটনার রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে তদন্ত অব্যাহত আছে। খুনের পর সিআইডি ইতোমধ্যেই জামায়াতÑশিবিরের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। মিরাজ খুনের পর তার সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, মিরাজ আহমেদের দুই ঠোঁটের ভেতর, মাথার পেছনে রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। নাক ছিল ভাঙ্গা। গলায় শ্বাসরোধের চিহ্ন রয়েছে। ময়না তদন্তের রিপোর্টে তাকে আঘাতের পর শ্বাসরোধ করে হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খুনের ঘটনার ৪ দিন পর ১৩ মার্চ খিলক্ষেত থানায় বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন মিরাজ আহমেদের বড় ভাই প্রখ্যাত সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত ৯ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আহমেদ মিরাজ ধানম-িতে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশে বের হন। এরপর তিনি আর পল্লবীর বাসায় ফেরেননি। ঐ দিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাত ১২টা ৫০ মিনিটের মধ্যে যেকোন সময় কে বা কারা অন্য কোথাও হত্যা করে তার লাশ কুড়িল নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নিচে রেললাইনের পাশে ফেলে যায়। পূর্বপরিকল্পিতভাবে মিরাজকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। হত্যাকা-ের ঘটনার পর প্রায় ৪ মাস ধরে তদন্ত করে খিলক্ষেত থানার পুলিশ। খিলক্ষেত থানার পুলিশের তদন্তে বিগত ৪ মাসেও মিরাজ হত্যাকা-ের ঘটনার কোন কূলকিনারা করতে পারেনি। এরপর ২০১৩ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এই মামলার তদন্তভার সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে মামলাটি খিলক্ষেত থানায় তদন্ত করা হয়। মামলাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, মিরাজ হত্যাকা-ের ঘটনার পর পুলিশ ধানম-ি লেক এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় বাসেত উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে। তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বাসেতকে জিজ্ঞাসাবাদ যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা খতিয়ে দেখেছে সিআইডি। বাসেত নিহত মিরাজের পূর্ব পরিচিত একজন ব্যক্তি। ঘটনার একদিন আগেও ধানম-ির লেকের পাশে মিরাজের সঙ্গে বাসেতের কথা হয়েছিল। এ কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মিরাজ হত্যার ঘটনায় কারা জড়িত- এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে। মিরাজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের কললিস্ট যাচাই করে দেখা হয়েছে। মিরাজ হত্যার ঘটনার সময় কুড়িল নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের আশপাশে ফুটপাথের বেশ কয়েকজন দোকানদারকেও জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। কারা, কখন ও কিভাবে ঐ লাশ সেখানে ফেলে দেয়-এ ব্যাপারে কোন প্রত্যক্ষদর্শী খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীর মামলায় বড় ভাই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হওয়ার কারণে তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য জামায়াতÑশিবিরের চক্র সুপরিকল্পিতভাবে ছোট ভাই মিরাজ আ্হমেদকে হত্যা করা হয়েছে বলেই সিআইডির তদন্তে তখন সন্দেহ ঘনীভূত হয় বলে এমনটাই বলা হয়েছিল তখন। সিআইডির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেছেন, জামায়াতÑশিবির যেহেতু ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ধরনের সংগঠন সে কারণে জামায়েত্ েইসলামীর আমীর যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হওয়ায় মতো কাজ তখন খুবই দুঃসাহসিক। বিশিষ্ট সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল যুদ্ধাপরাধীর মামলায় মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের মামলায় সাক্ষী হওয়ার কারণে তার ছোট ভাই মিরাজ আহমেদকে খুন করে প্রতিশোধ নেয়াটাই স্বাভাবিক। মিরাজ আহমেদের সঙ্গে ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার তাকে এমনভাবে হত্যা করা হয়েছে যেন কোন ক্লু না থাকে। এসব কারণে মিরাজ খুনের সন্দেহের তীর এখন জামায়াত-শিবিরের চক্রের দিকেই তদন্ত এগুচ্ছিল। তবে যুদ্ধাপরাধী জামায়েতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর সর্বোচ্চ আদালতে ফাঁসির রায়ের পর তা কার্যকর হয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় আর খুনের ঘটনাটির রহস্য উদঘাটিত হয়নি এখনও। তবে খুনের রহস্য উদঘাটিত হয়নি বলে আর রহস্য উদঘাটিত হবে না এমনটি ভাবা ঠিক না। কারণ সিআইডির প্রতিটি অপরাধের ঘটনার তদন্তে নির্ভুল ক্লু উদঘাটনে অনেক সময় নেয়, মিরাজ খুনের ঘটনার বেলায়ও সেটাই ঘটছে বলে সিআইডির দাবি।
×