ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৩ মার্চ ২০১৮

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের আওতায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রায় ৮০০ কোটি টাকার পুনর্বাসন প্রকল্প নিয়েছে সরকার। তিনটি প্যাকেজে এ পুনর্বাসন সম্পন্ন হবে। প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর আবাসন সমস্যা সমাধানে উত্তরায় এক হাজার ২৪৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হচ্ছে। ১৫ তলা বিশিষ্ট ১২টি ভবনে ক্ষতিগ্রস্তদের আবাসন ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর যানজট নিরসনে সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্পসমূহের মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অন্যতম। ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্পটি ২০১১ সালে শুরুর পর তা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৭ সালের মধ্যে। কিন্তু সাত বছরে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১০ ভাগ। শুধু বিমানবন্দর এলাকায় প্রকল্পের কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়েছে। অর্থ সংগ্রহ, জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্তসহ নানা জটিলতায় প্রকল্পটির অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। জমি অধিগ্রহণ ॥ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য বিমানবন্দর-বনানী, বনানী-তেজগাঁও ও মগবাজার-কুতুবখালী এলাকায় অধিগ্রহণ করা হয়েছে ২২০ একর জমি। এ অধিগ্রহণের ফলে যেসব পরিবার স্থানচ্যুত হয়েছে, তাদের পুনর্বাসনে উত্তরায় নির্মিত হচ্ছে ১ হাজার ২৪৮টি ফ্ল্যাট। উত্তরা তৃতীয় ফেস সংলগ্ন বাউনিয়া, দ্বিগুণ ও বড় কাঁকড় এলাকায় অধিগ্রহণকৃত জমিতে ১৫ তলা বিশিষ্ট ১২টি ভবন নির্মাণ করা হবে। পুরো প্রকল্পটি তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। সম্প্রতি ফ্ল্যাটগুলো নির্মাণে দুই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। এতে ব্যয় হচ্ছে ৭৯১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। নির্মাণ শেষ হলে পুনর্বাসন এ্যাপার্টমেন্ট নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দ বা কেনার সুযোগ পাবেন প্রকল্প এলাকায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। সেতু বিভাগের তথ্যানুযায়ী, নির্মিত ভবনগুলোর প্রতিটি তলায় আটটি করে ইউনিট বা ফ্ল্যাট থাকবে। ৬২৪টি ফ্ল্যাট হবে ১ হাজার বর্গফুট আয়তনের, বাকি ৬২৪টি হবে ৮৫০ বর্গফুটের। পাশাপাশি বিদ্যালয়, মসজিদ, কমিউনিটি মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, খেলার মাঠ, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, অভ্যন্তরীণ সড়ক, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক নানা সুবিধা থাকবে। ছয়টি ভবনে থাকবে ১ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট। এগুলো ব্লক-এ নামে পরিচিত হবে। ব্লক-এ নির্মাণের কাজ পেয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্যামওয়ান-মীর আখতার (জেভি)। ভবনগুলো নির্মাণে ব্যয় হবে ৩৪৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। বাকি ছয়টি ভবনে হবে ৮৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। এগুলো পরিচিত হবে ব্লক-বি নামে। এটি নির্মাণের কাজ পেয়েছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড-ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (জেভি)। ব্লক-বি নির্মাণে ব্যয় হবে ২৭৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর বাইরে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে বিদ্যালয়, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার, কমিউনিটি মার্কেট, কমিউনিটি ক্লিনিক, খেলার মাঠ, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ইলেকট্রিক্যাল সাব-স্টেশন, অভ্যন্তরীণ সড়ক, ড্রেন, ল্যান্ড স্কেপিং, ডিপ টিউবওয়েলসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করবে ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড-ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। এতে ব্যয় হবে ১৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রসঙ্গত, রাজধানীর উত্তরের সঙ্গে মধ্য, দক্ষিণ-পূর্ব অংশের যোগাযোগ সহজ করতে নির্মিত হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার মূল লাইন ও ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ র‌্যাম্পের এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মিত হচ্ছে সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। বাকি টাকা বিনিয়োগ করবে থাইল্যান্ডের ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। এদিকে প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো এগিয়ে নিতে আরেকটি প্রকল্প (সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) হাতে নিয়েছে সেতু বিভাগ। এই প্রকল্পের অধীনেই উত্তরায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ১ হাজার ২৪৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হচ্ছে। তিন ভাগের এক্সপ্রেসওয়ে ॥ দেশে এ যাবতকালের নির্মাণাধীন সবচেয়ে বড় এক্সপ্রেসওয়ে হলো এটি। প্রকল্প এলাকা তিন অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার, দ্বিতীয় অংশে বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার এবং তৃতীয় অংশে মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে ২৫ বছর পর্যন্ত টোল আদায় করবে ইতাল-থাই। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি ইতাল-থাইয়ের সঙ্গে প্রথম চুক্তি করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। সে বছর ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের আপত্তির মুখে নক্সা কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। তাদের পক্ষ থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ করার প্রস্তাব করে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন দিক যাচাই-বাছাই করে নতুন আরেকটি নক্সা অনুমোদন করে সরকার। সংশোধিত নক্সায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিমানবন্দর সড়ক থেকে শুরু হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত বিদ্যমান রেললাইনের ওপর দিয়ে এবং কমলাপুর থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) অতীশ দীপঙ্কর সড়কের ওপর দিয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত এবং পরের অংশটি গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার অংশের ওপর দিয়ে যাত্রাবাড়ী অতিক্রম করে কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে। নক্সার পাশাপাশি মহাখালী ও মালিবাগের র‌্যাম্পের অবস্থানেও পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটির কাঠামোগত ধরনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যয় কমানোর জন্য এক্সপ্রেসওয়েটি বক্স গ্রিডারের বদলে আই গ্রিডারে নির্মাণ করা হবে। এছাড়া এক্সপ্রেসওয়েটি তিন অংশে ভাগ করে নির্মাণ কাজ পরিচালনা করা হবে। এক্ষেত্রে একটি অংশ শেষ হওয়ার পরই তা চালু করা যাবে। পরিবর্তিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতেই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা ॥ প্রকল্প অগ্রগতির ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো ভূমি অধিগ্রহণ। কারণ, প্রকল্প নির্মাণের কিছু জমি সরকারী হলেও বেশিরভাগ ব্যক্তিমালিকানাধীন। তাই জমিসংক্রান্ত ইস্যুতে নানা জটিলতা সৃষ্টির কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতায় কাজ আটকে থাকে দুই বছর। নক্সা পরিবর্তন ও মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালের মাঝামাঝি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করতে হয়। চুক্তি সংশোধনের পর ওই বছরই শুরু হয় ভূমি জরিপ। ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর এবং ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট দুই দফা এ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রকল্প পরিচালক ফেরদৌস বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা দিয়ে মূল এ্যালাইনমেন্ট যাওয়ার কারণে জমি অধিগ্রহণে সমস্যা হয়েছে। দুই-তিন বছর পিছিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের। তাছাড়া বিনিয়োগকারীর ফান্ডিং কনফার্ম হয়নি। এ কারণেও সময় বেশি লেগেছে। তবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আশ্বাস দিয়েছে, দ্রুত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের অর্থের জোগান হয়ে যাবে। আর তা হলেই পুরোদমে কাজ শুরু করা যাবে বলে তিনি আশা করছেন। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ২০১১ সালে, ওই বছরই ভিত্তি স্থাপন কিন্তু সাত বছরের বেশি সময় পরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ এগিয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। আগামী তিন বছরে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করে ২০২০ সালে নির্ধারিত সময়েই তা যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া যাবে বলে আশা করছেন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক কাজী মুহাম্মদ ফেরদৌস।
×