ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব শর্মা

দেখা হবে উনিশে

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২ মার্চ ২০১৮

দেখা হবে উনিশে

বইমেলার ঠিক যত ছবি আপলোড হয়েছে ফেসবুকে ঠিক ততটা বই যদি বিক্রি হতো তাহলে অন্যরকম হতো মেলা শেষের দিন। বিশেষ করে লেখক প্রকাশকের মুখে থাকত তৃপ্তির হাসি। কিন্তু না সে রকমটি হলো না। মেলার ফাস্টফুডের দোকানে হাজার টাকা দিয়েছেন এমন অনেককে দেখেছি যাদের হাতে দেখা যায়নি কোন বইয়ের ব্যাগ। মিলনমেলার আনন্দে উদ্ভাসিত হতে বইমেলায় এলেও যে উপলক্ষে এই মেলা তা অগণিত মানুষের মনেই কোন রেখাপাত করেনি। যার ফলে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা গতবারের তুলনায় এবার বেড়েছে ঠিকই তবে বৃদ্ধি পায়নি সে অনুপাতে বিক্রি। ভাল বইয়ের অভাবের কারণেই এমনটি হচ্ছে দাবি করে একজন কবি জানালেন আমরা মোটা দাগে একটা কথা বলি কবিতার বই বিক্রি হয় না। এটা আসলে ভুল কথা। ভাল কবিতার বই ঠিকই বিক্রি হয়। তিনি হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলের উদাহরণ দিয়ে বললেন আমার তো মনে হয় বইমেলায় তার এ বইটি ঠিক যত কপি বিক্রি হয় অন্য সব কবিতার বই ততটি বিক্রি হয় না! অথচ এটা নতুন কোন কবিতার বই নয়। তার পরও পাঠকের ভাল লাগার শীর্ষে থাকে বইটি। এই যে ভাল লাগা এটাই কিন্তু তৈরি করতে পারছেন না অনেক লেখক। আমরা যদি কবি মুজিব ইরমের কথাই বলি তাহলে দেখতে পাবো তাঁর কবিতার বিক্রি-বাট্টা কিন্তু ভালই হয়েছে। সেটা কেন? ভাল লাগা, অভিনবত্ব, রচনাশৈলী শব্দের আবেশ ইত্যাদি কারণে তার কবিতা পাঠকের মনে ভাবাবেগ তৈরি করছে। পাঠক আকৃষ্ট হচ্ছে বই কিনতে। স্রেফ উদাহরণের জন্যই দু’জনের কথা উল্লেখ করলাম। আরও অনেকে আছেন যাদের কবিতার বই ভাল বিক্রি হয়েছে। কিন্তু প্রকাশিত কবিতার বইয়ের বিক্রির আনুপাতিক হার তৈরি করতে গেলে সেটা তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। যার ফলে মোটা দাগে একটি কথা প্রচলিত হয়েছে কবিতার বই বিক্রি হয় না! আসলে সাহিত্যে কবিতার বইয়ের দাপট থাকলেও মেলার মাঠে কিন্তু বরাবরই শীর্ষে থাকে উপন্যাস। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাব্রতী লেখক যতীন সরকারের পযবেক্ষণকে প্রণিধানযোগ্য মনে করি। বই বিক্রি নিয়ে তার অভিমত ‘মেলায় বিক্রির তালিকায় সব সময়ই শীর্ষে থাকে উপন্যাস। শুধু বইমেলাতেই নয় বছরজুড়েই বিক্রি হয় উপন্যাস। দ্বিতীয় স্থানে থাকে প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক বই। এরপর অন্যান্য।’ বইমেলা ঘুরে পাঠক প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে যতীন সরকারের কথার হুবহু মিল পাওয়া গেছে। নতুন এবং পুরনো উপন্যাসই বিক্রির শীষে ছিল। সেলিনা হোসেন, মঈনুল আহসান সাবের, হরিশংকর জলদাস, ইমদাদুল হক মিলন, মুহিত কামাল, আনিসুল হক, জাকির তালুকদার প্রমুখের পাশাপাশি নবীন লেখকদের উপন্যাসও দাপটের সঙ্গেই বিক্রি হয়েছে। প্রয়াণের পরও ভাটা পড়েনি হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তায়। বোদ্ধাদের পছন্দের তালিকায় যেমন শীর্ষে ছিলেন যতীন সরকার তেমনই জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন ড. জাফর ইকবাল। সমানতালে বিক্রি হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের বই। দ্বিজেন শর্মা এবং শওকত আলীর জীবনীগ্রন্থও ছিল পছন্দের তালিকায়। প্রতিথযশারা যেমন নিজের অবস্থানের হেরফের হতে দেননি তেমনই নতুনদের মধ্যে অনেকে পাকাপোক্ত করেছেন নিজের আসন। নবীন লেখকদের কারও কারও বইয়ের একাধিক সংস্করণ হয়েছে মেলায়। তবে এবারের মেলায় অন্য বছরের তুলনায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ের বিক্রি বেড়েছে কয়েক গুণ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের চাহিদার অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জানার আগ্রহ। বইমেলার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করতে গিয়ে তারই জানান দিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বলেছেন, ‘অধিক হারে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই লিখতে হবে। তা হলেই গড়ে উঠবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ তরুণ প্রজন্ম।’ বই ও বিক্রি দুটোই বেড়েছে বুধবার সমাপ্ত হয়ে যাওয়া ২০১৮ সালের বই মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনই বেড়েছে বইয়ের বিক্রি। গেল বছরের তুলনায় এ বছর ৫ কোটি টাকার বেশি বই বিক্রি হয়েছে। বাংলা একাডেমি প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, এবারের বইমেলায় মোট ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। ২০১৭ সালে বিক্রি হয়েছিল মোট ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই। গ্রন্থমেলায় এ বছর সব মিলিয়ে প্রকাশিত হয়েছে চার হাজার ৫৯১টি বই। যা গতবারের চেয়ে ৯৪৫টি বেশি। ২০১৭ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ৩ হাজার ৬৪৬টি বই। এবার প্রকাশিত নতুন বইয়ের মধ্যে কবিতাগ্রন্থের সংখ্যাই অধিক। বইমেলায় মোট ১ হাজার ৪৭২টি কবিতার বই বের হয়েছে। প্রকাশের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে গল্পের বই। মেলায় প্রকাশিত গল্পের বইয়ের সংখ্যা ৭০১টি। তৃতীয় স্থানে রয়েছে উপন্যাস। এবার মোট ৬৪৩টি উপন্যাস বের হয়েছে মেলায়। এ ছাড়াও প্রবন্ধ ২৫৭টি, গবেষণা ১২২টি, ইতিহাসগ্রন্থ ১১০টি, জীবনীগ্রন্থ ১০৭টি, ভ্রমণ বিষয়ক ৯১টি, রচনাবলী ১৫টি এবং ২৩টি নাটক প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে ৯১টি। বিজ্ঞান বিষয়ক ৭৬টি, রাজনীতি-২২টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক ৩৩টি, রম্য ও ধাঁধা ২১টি, ধর্মীয় ২৬টি এবং অনুবাদগ্রন্থ ৪৮টি, শিশুতোষ ১২৫টি, ছড়ার বই ১১২টি, সায়েন্স ফিকশন ও গোয়েন্দা বিষয়ক বই ৬৫টি, অভিধান বিষয়ক ৭টি এবং অন্যান্য বিষয়ে ৪২৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। মানসম্পন্ন বইয়ের অভাব! বরাবরের মতো এবারও মেলায় মানসম্মত বইয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। যদিও বাংলা একাডেমি বলেছে, অন্য বছরের তুলনায় এবার অধিকসংখ্যক মানসম্মত বই প্রকাশিত হয়েছে। একাডেমি প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, এবার প্রকাশিত মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা ৪৮৮টি। বাংলা একাডেমির কমিটি কতৃক স্টলে আসা নতুন বইগুলো পরীক্ষা করে এই তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। তবে, এই তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেকেই। বই উৎসব উপলক্ষে যেখানে এবার চার হাজার ৫৯১টি বই প্রকাশিত হয়েছে সেখানে এত কম সংখ্যক মানসম্মত বই অনেককেই বিস্মিত করেছে! এই বিষয়টিই আমাদের শঙ্কায় ফেলছে। যা বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও ভাল কোন লক্ষণ নয়। সচেতন লেখক পাঠক প্রত্যেককেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে বিষয়টি। এসব বই নিয়ে কথাসাহিত্যক হরিশংকর জলদাস এতটাই ক্ষুব্ধ যে এগুলোকে তিনি স্রেফ ‘জঞ্জাল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। উল্টো প্রশ্ন রেখেছেন তিনি, ‘এত জঞ্জাল বের করার কি দরকার? বাংলাসাহিত্যকে ভালবাসেন বলেই তাঁর এমন খেদোক্তি। হরিশংকর জলদাসের এই বক্তব্যের সঙ্গে হয়ত দ্বিমত পোষণ করবেন না কেউ! কারণ ভাষার মাসে ভাষার প্রতি এই অবহেলা সত্যি সত্যিই বেদনা জাগায়। মানসম্পন্ন বই বলতে ঠিক যে ধরনের বইয়ের কথা বলা হচ্ছে সে রকম বই বের করা আসলে কঠিন বা দুরূহ কোন কাজ নয়। স্রেফ অবহেলা আর মানসিকতার কারণেই আসলে থমকে আছে শুদ্ধতার চর্চা। প্রথমত ভুল বানান অর্থাৎ প্রুফ না দেখা এবং দ্বিতীয়ত অসম্পাদিত অর্থাৎ সম্পাদনা না করা। এই দুটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে বইগুলো বাজারে আসে সেগুলো নিয়ে আসলে তেমন কোন অভিযোগ নেই। পিতা-মাতা যেমন বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে চান না, ঠিক তেমনই লেখকও চান না নিম্নমানের বই বাজারে আসুক। অথচ সেটাই হচ্ছে! এবং সেটা লেখক তার নিজের টাকা খরচ করেই বের করছেন। এটা খুবই দুঃখের বিষয়। প্রকাশক টাকা নিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু বইয়ের ভাল মন্দের কোন ধার ধারছেন না তিনি। একজন লেখক নিজের টাকায় বই বের করতেই পারেন। এটা দোষের কিছু নয়। যিনি ছাপবেন অর্থ নিয়ে ছাপতে পারেন এতেও আপত্তি নেই। আপত্তি দুটি জায়গায় প্রথমত তিনি যেহেতু ব্যবসা করছেন সেটা একটা নির্দিষ্ট মান বজায় রেখে করুন। কারণ অন্য আর দশটা ব্যবসার মতো এই ব্যবসাটা ঠিক ব্যবসা নয়। দ্বিতীয়ত যিনি টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশ করবেন তিনি যেন নিজেকে প্রকাশক দাবি না করেন। ড. জাফর ইকবালের বক্তব্যকে এক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত মনে করি। তিনি বলেছেন, ‘যদি একজন লেখক নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কোন একজন প্রকাশককে দিয়ে তার বই বের করেন তাহলে সেই প্রকাশককে ‘প্রকাশক’ বলা যাবে না, তাকে ‘মুদ্রক’ বা এই ধরনের কিছু বলতে হবে। প্রকাশক তিনি, যিনি কোন একজন লেখক গবেষকের কাজটুকু নিজের দায়িত্বে পাঠকদের সামনে তুলে ধরবেন। সেই কাজটুকু করার জন্য তার যদি অর্থের প্রয়োজন হয় সেই অর্থটুকু প্রকাশকের নিজের যোগাড় করতে হবে। ঠিক তাই। লেখকের টাকা দিয়ে বই বের করে আসলে সত্যিকারের প্রকাশক হওয়া যায় না! প্রকাশক হতে গেলে থাকা চাই যথাযথ সততা ও নিষ্ঠা। বইমেলা এলে সবাই এ নিয়ে কথা বলেন। মেলা শেষ, কথাও শেষ। আবার মেলা, আবার তাড়াহুড়ো, আবার বই প্রকাশে যথেচ্ছাচার। সকল প্রকাশনা সংস্থা যে এই স্রোতে গা ভাসাচ্ছে সেটা কিন্তু নয়। অনেক প্রকাশনা সংস্থা আছে যাদের এডিটর থেকে শুরু করে রিভিউয়ার প্রুফ রিডার সবই আছেন। তারা সময় নিয়ে মানসম্মত বই ঠিকই বের করছেন। সেটি নিজেদের টাকায়। লেখকদের নিয়ম মেনে দিচ্ছেন রয়েলিটি। কেউ কেউ মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে মানহীনতার জন্য দায়ী করেছেন। আমরা বইমেলা এলে বই প্রকাশের জন্য ঠিক যেভাবে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি, সারা বছর কিন্তু সেভাবে সময় দিই না। এই যে উদাসীনতা সেটাও কিন্তু মান নিম্নমুখী হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। যেভাবেই হোক বইমেলায় বই প্রকাশ করা চাই। যেনতেন হলেও আপত্তি নেই! এই যে মানসিকতা এটাকে কাজে লাগিয়েই বাণিজ্য করছেন এক শ্রেণীর প্রকাশক দাবিদার মুদ্রকেরা। অথচ একজন প্রুফ রিডার দিয়ে ভুল সংশোধন করিয়ে, সম্পাদক দিয়ে সম্পাদনা করিয়ে যদি বইটি প্রকাশ করা হতো তাহলে আর যাই হোক মান নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। তখন বই কিনে মনোবেদনা পেতে হতো না পাঠককে! নিয়ম আছে মার্চ থেকে প্রকাশিত বইগুলো পরবর্তী বইমেলার নতুন বই হিসেবে গণ্য করা হয়। তাহলে তাড়াহুড়ো কেন? একটু সময় নিয়ে বই করলে তো সেই অভিযোগ থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়। আনিসুজ্জামান স্যারের বক্তব্যে কিন্তু এই সমস্যার সমাধান আছে। তিনি বলেছেন, ‘শত বই না লিখে সৃষ্টির জন্য একটি বই-ই লিখুন। প্রয়োজনে সময় নিয়ে লিখুন।’ তাহলে মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। নইলে অর্থ ও সময় ব্যয় হবে ঠিকই কালোত্তীর্ণ কিছু হবে না। স্টল বিন্যাস ছিল ভোগান্তির কারণ স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় বইমেলাকে সম্প্রসারিত করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসা হয়। ফলে একাডেমি চত্বর ও উদ্যান এই বিভাজন মেনে নিয়েছিলেন লেখক পাঠক এবং প্রকাশকরা। সকলের প্রত্যাশা ছিল পরিপাটি হবে বইমেলা। যা মিলন মেলায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে না। কিন্তু না সেই আশায় গুড়েবালি! এবারের বইমেলায় স্টল বিন্যাস ছিল একেবারেই অগোছালো। অনেকেই এই বিন্যাসকে যাচ্ছেতাই বলে আখ্যায়িত করেছেন। এতবড় মাঠে চারপাশে সারিবদ্ধভাবে স্টল না সাজিয়ে অগোছালোভাবে স্টল সাজানোকে মেলার জন্য ক্ষতিকর বলে কেউ কেউ বলেছেন, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে কোন কোন প্রকাশনা সংস্থাকে সুবিধা দেয়ার জন্য, অন্যথায় এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। যার ফলে ভাল ভাল বই বের করেও অনেক প্রকাশনা সংস্থা আশানুরূপ বই বিক্রি করতে পারেনি। স্টলের খোঁজ করতে গিয়ে অনেককে খেই হারিয়ে ফেলতে দেখা গেছে। মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে স্টল বিন্যাস নিয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব এ প্রসঙ্গে কথা বলেন। জালাল আহমেদ জানান, ‘আগামী বছর সুচিন্তিত নীতিমালা প্রয়োগের মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটানো যাবে। গভীর বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধতা হয়ত আরও বের করতে পারব।’ এ ছাড়া মেলার প্রবেশ পথের তোরণ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার ত্রুটি এবং খাবারের দোকানের স্বল্পতা নিয়ে মেলায় আগতদের অসন্তোষের বিষয়ে উনিশের বইমেলায় নজর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। বেড়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ের বিক্রি তরুণদের আগ্রহের তালিকায় এবার শীর্ষে ছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই। অন্য বারের তুলনায় এবার অত্যধিক চাহিদা ছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ের। যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধবিবরণের বইগুলো ক্রয়ে তরুণদের আগ্রহ ছিল অত্যধিক। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সেলিনা হোসেনের ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্পসমগ্র (শামীম পাবলিশার্স), মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাকের ‘১৯৭১: বিদেশী গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ (শ্রাবণ প্রকাশনী), একেএম শাহনাওয়াজের ‘মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ : হাজার বছরের উত্তরাধিকার (অবসর), মোরশেদ শফিউল হাসানের ‘স্বাধীনতা পটভূমি : ১৯৬০ দশক (অনুপম), আন্দালীব রাশদীর ‘একাত্তরের দলিল (আলোঘর), আরিফ রহমানের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ কিছু বিভ্রান্তির জবাব (শব্দশৈলী) আহমেদ রিয়াজের ‘মুক্তিযুদ্ধের সাত বীর কিশোর (পার্ল পাবলিকেশন্স); সালেক খোকনের ‘যুদ্ধাহতের ভাষ্য (কথাপ্রকাশ), মুনতাসীর মামুন ও চৌধুরী শহীদ কাদেরের ‘গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (অনন্যা)। বাংলা একাডেমি থেকে বের হয়েছে শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, তপন পালিতের ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার আন্দোলন, রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘স্মৃতি ৭১ (প্রথম খণ্ড)’, কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের ‘রংপুর সেনানিবাসে দুঃসাহসিক অভিযান ও ‘বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। মুক্তিযুদ্ধের রচনা প্রসঙ্গে ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যেসব রচনা আসছে, তার অধিকাংশই রিপিটেশন। রিপিটেশন নয়, আমরা চাই তরুণ লেখক, গবেষকরা মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী হোক। মুক্তিযুদ্ধের নতুন তথ্য যত আসবে, ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।’ প্রশংসিত হয়েছে উৎসর্গকরণ এবারের বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশকে ১২টি চত্বরে ভাগ করা হয়েছিল। এসব চত্বর ১২ জন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখকের নামে উৎসর্গ করা হয়। শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহ, শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ মতিউর, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, লোকশিল্পী রমেশ শীল, অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই, শহীদ আসাদ, শহীদ নূর হোসেন, শহীদ মেহেরুন্নেসা, শহীদ মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে এসব চত্বর উৎসর্গ করা হয়। আর বাংলা একাডেমির পুরো প্রাঙ্গণটি সদ্যপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর নামে উৎসর্গ করা হয়। এই উৎসর্গকরণ যেমন অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তেমনই প্রশংসিত হয়েছে একাডেমির এই উদ্যোগ। অনেকে বলেছেন এর মাধ্যমে প্রয়াত এই বিশিষ্টজনদের সম্মানিত করা হলো। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। দেখা হবে উনিশে বইমেলায় এবার বিগত কয়েক বছরের তুলনায় উচ্ছ্বাস একটু বেশিই ছিল। নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ অন্যান্য কারণে অসংখ্য মানুষ এসেছেন বই কিনতে, মিলিত হতে। দীর্ঘ এক মাসব্যাপী এই মেলা নতুন করে অনেককে নিয়ে এসেছে কাছাকাছি। সুদৃঢ় হয়েছে বন্ধুত্বের বন্ধন। প্রাণবন্ত আড্ডা রসদ যুগিয়েছে মিলন মেলায়। সেই আড্ডা, মিলনমেলার শেষের দিনটি স্বভাবতই ছিল অন্য রকম। সবার হৃদয়েই ছিল বেদনার অনুরণন। বিদ্যা প্রকাশের স্টলের সামনে শেষদিনে একত্রিত হয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস, মুহিত কামাল, আবৃত্তিশিল্পী রূপা চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র চেয়ার অধ্যাপক মহুয়া মুখোপাধ্যায়সহ আরো অনেকে। সবার কণ্ঠেই ছিল আক্ষেপের সুর। ‘কাল থেকে তো আর এভাবে দেখা হবে না। হবে না জম্পেশ আড্ডা।’ উপস্থিত সংস্কৃতজন ডাঃ চক্রেশ চক্রবর্তী সেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন। আবেগজড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘তাতে কি হয়েছে, দেখা হবে উনিশে!’ সেটাই। আগামীর বইমেলায় মিলিত হওয়ার ইচ্ছে নিয়েই বাড়ি ফিরে গেছেন বইপ্রেমী মানুষেরা।
×