ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

বার্লিন ওয়াল নেই, বিভাজন আছে

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বার্লিন ওয়াল নেই, বিভাজন আছে

বার্লিন প্রাচীর নির্মিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে প্রচণ্ড শীতের সময়। ১৯৮৯ সালের ৯ নবেম্বর, এটি ভেঙ্গে দেয়া হয়। অর্থাৎ ২৮ বছর ২ মাস ২৬ দিন জার্মান জাতির বিভাজন রেখা হিসেবে টিকে ছিল এটি। মোটামুটিভাবে একটি প্রজন্ম এই প্রাচীর নিয়েই থেকেছে। অর্থাৎ কারও একটি জীবন জিম্মি হিসেবে এবং আরেকটি জীবন মুক্ত জীবন হিসেবে থেকেছে। প্রাচীরটি নির্মিত হয়েছিল বার্লিন দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ জুড়ে। সেই প্রাচীরের কিছু কিছু লক্ষণ ছাড়াও রয়ে গেছে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ সেখানে ১৪০ জন মানুষ পালানোর চেষ্টা করতে নিহত হন। এগুলো ছাড়া খুব অল্প কিছু চিহ্ন আছে, যা থেকে বোঝা যায় বার্লিন একদা ছিল এক বিভক্ত নগরী। বার্লিনের আলোকোজ্জ্বল প্রধান রেলওয়ে স্টেশনটি প্রাক্তন সীমান্ত রেখার কাছে অবস্থিত। দুদিক দিয়েই ট্রেন আসছে, যাচ্ছে। নগরীর এখানকার এলাকাগুলো এক সময় ছিল দেয়ালের পূর্বদিকের জীর্ণ পুরাতন অনুন্নত মহল্লা। গত ১২ বছর দেশটি এঞ্জেলা মার্কেল নামে এমন এক নারীর দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে, যিনি বড় হয়েছেন পূর্ব জার্মানিতে। বার্লিন প্রাচীর এখন নেই। কিন্তু সত্যিই কি নেই? কংক্রিটের ব্লকগুলো এখন আর চোখে পড়বে না। কিন্তু প্রাচীর এখনও রয়ে গেছে জনগণের মনোলোকে, তাদের মস্তিস্কে। জার্মান ইতিহাস বড়ই জটিল। বার্লিন ওয়াল ভেঙ্গেছে সেই ২৮ বছর আগে। কিন্তু দুই জনগণের ঐক্য এখনও পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। জার্মান ঐক্যের কাজ এখনও চলছে বলে জানিয়েছেন টমাস ক্রুগার। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে ক্রুগার ছিলেন পূর্ব বার্লিনের শেষ মেয়র। এখন ফেডারেল সিভিক এডুকেশন এজেন্সির প্রধান। ক্রুগার কাজটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। তবে এই ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন যে, দেশের বিবরণে যেসব বিষয়ের প্রাধান্য সেগুলো বড্ড বেশি পশ্চিম জার্মান। পূর্ব জার্মানির অনেকে মনে করে যে, তাদের ইতিহাস সোভিয়েত ট্যাঙ্কের নিচে চাপা পড়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। এটা হলো এক ধরনের সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ। ক্রুগারের মতে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ফল্ট লাইনগুলো এখনও রয়ে গেছে। কিছু দূর হচ্ছে আবার কিছু গভীরতর রূপ ধারণ করছে। জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল এখনও অপেক্ষাকৃত ধনী। পূর্বাঞ্চল এখনও অধিকতর জাতীয়তাবাদী। পশ্চিমে অভিবাসীর সংখ্যা বেশি। তবে অভিবাসীদের মূলত পূর্ব জার্মানিরই সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। পশ্চিম জার্মানরা এখন পূর্বাঞ্চলে ক্ষমতার অনেক কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করে। পূর্বাঞ্চলের ১০ জন জজ ও কৌঁসুলির ৮ জনই পশ্চিমে বেড়ে উঠেছিল। জার্মানির পতাকাবাহী জাহাজের তালিকাভুক্ত কোম্পানির কোনটারই সদর দফতর পূর্ব জার্মানিতে নেই। কিন্তু দেশব্যাপী রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও কথাবার্তা এখন উগ্রতার দিকে চলে যাচ্ছে। সেটা ক্রমবর্ধমান হারে নিয়ন্ত্রণ করছে পূর্বাঞ্চলীয়রা। চরম দক্ষিণপন্থী দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানির প্রথম আবির্ভাব ঘটে গত বছর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য স্যাক্সনীতে। দলটি ২৭ শতাংশ ভোট পায় যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ। আর চরম বামপন্থী লেফট পার্টির শিকড় তো রয়ে গেছে সেই দলটির মধ্যে, যা একজন কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিকে চালাতো। পূর্ব জার্মানির মানুষ মিজ মার্কেলকে পূর্বাঞ্চলীয় বলে মনে করে না। তাদের চোখে তিনি একজন বিশ্বাসঘাতক। তাহলে কি জার্মানি এখনও দুই নগরীর কাহিনী? পূর্বাঞ্চলের মুরিঞ্জিয়া প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী হেলমুট হান্টার তেমনই মনে করেন। তাই তিনি পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে ছাত্র বিনিময় কর্মসূচীর প্রস্তাব দিয়েছেন। সে ধরনের কর্মসূচী অন্যান্য দেশের স্কুলের সঙ্গে জার্মানির আছে। তিনি বলেন, পোল্যান্ড ও ফ্রান্সের সঙ্গে আমাদের ছাত্র বিনিময়ের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন আছে লিপজিগ ও স্টুটগার্টের মধ্যে। কবি ডুরস গুনবেইন নিশ্চিত নন যে, তরুণ প্রজন্ম একটা সমস্যা। বার্লিন প্রাচীর তৈরি হবার দুমাস পর তিনি মায়ের পেটে আসেন। তার জীবনের অর্ধেকটা কেটেছে প্রাচীরের আড়ালে। প্রথম সেসব বার্লিনবাসী ১৯৮৯ সালে প্রাচীরের পতনের পর পশ্চিমে পাড়ি জমিয়েছিলেন, তিনি তাদের একজন। তিনি বলেন, প্রাচীরের পতন ঘটার পর জন্ম নেয়া তার সন্তানরা জার্মান, ইউরোপীয় ও বিশ্ব নাগরিক। বৃহত্তর চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে তাদের নিয়ে, যারা জীবনের বেশির ভাগ সময় প্রাচীরের আড়ালে এবং একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতর কাটিয়েছিলেন। গ্রুনবেইল বলেন, আপনার এই ব্যবস্থা পছন্দ না হলেও এ ব্যবস্থাই আপনার মনমানসিকতা নির্ধারণ করে দেয়। ব্যবস্থাটি তখন আপনার অংশে পরিণত হয়। সেজন্য ১৯৮৯ সালে কমিউনিস্ট ব্যবস্থা ধসে পড়ার সময় যখন মিছিল হচ্ছিল, তখন অনেক লোক গণতন্ত্র চায়নি, তারা সমৃদ্ধি ও কর্তৃত্ব চেয়েছিল। আর সেই কর্তৃত্বের জন্যই আজ তারা আবার লালায়িত হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক টিমোথি গার্টন এ্যাশ একে এক ধরনের ‘রাজনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেউ কেউ আবারও মিছিল করেছে। প্রতি সোমবার পূর্বাঞ্চলীয় নগরী ড্রেসডেনে অভিবাসনবিরোধী পেগিডা আন্দোলনের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে আসছে। বেশির ভাগই পুরুষ এবং বয়স পঞ্চাশের উর্ধে। পাশ্চাত্যের ইসলামীকরণের বিরোধী দেশপ্রেমিক ইউরোপীয়রা এই শব্দাবলিকে জার্মান ভাষায় রূপান্তর করলে যা দাঁড়ায়, সেই শব্দমালার আদ্যাক্ষর সমষ্টি হলো পেগিডা। অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি দলটি এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তাদের অভিযোগ কি জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, মুসলিম বিদেশীরা জার্মানি ‘দখল করে নিচ্ছে’। ক্লাউস রুশাউ নামে ৫৭ বছর বয়সী এক অবসরপ্রাপ্ত মেকানিক সম্প্রতি সোমবারের এক সমাবেশে বলেন, জার্মানিতে এখন বিদেশীদের সংখ্যা জার্মানদের চেয়ে বেশি। কথাটা মোটেও সত্য নয়। বস্তুতপক্ষে সাবেক পূর্ব জার্মানীর যেসব অঞ্চলে ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ পার্টির পক্ষে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছিল, সেসব জায়গায় অভিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। তবে দখল হয়ে যাওয়ার ধারণাটি জার্মান চেতনায় গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। আরেকটি প্রচলিত কথা হলো, পশ্চিমাঞ্চল পূর্বাঞ্চলকে দখল করে নিয়েছে। কোন কোন দিক দিয়ে ব্যাপারটা তেমনই ঘটেছে। ক্রুগার বলেন, পূর্বাঞ্চলে কমিউনিজমের যুগে বয়োপ্রাপ্ত হওয়া এবং অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত একটি প্রজন্মকে হটিয়ে দিয়ে তাদের স্থলাভিষিক্ত করা পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলো থেকে দলে দলে শিক্ষক, বিচারক ও সিভিল সার্ভেন্টদের আশা ভঙ্গ হয়েছে। এ নিয়ে পূর্বাঞ্চলবাসীদের মধ্যে তিক্ততা ছিল এবং এখনও আছে। কেউ কেউ বলে, সীমান্ত পাড়ি না দিয়েও দেশান্তরিত হওয়ার পূর্ণ অভিজ্ঞতা পূর্বাঞ্চলবাসীদের হয়েছিল। কারণ লোকে তাদের চাকরি, তাদের মর্যাদা, তাদের দেশকে হারিয়ে বসেছিল। পূর্ব জার্মানির অনেক মানুষ নীরবে আক্ষরিক অর্থেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। পূর্বাঞ্চলের মহিলারা ছিল দেশের শ্রমশক্তির অংশ। তারা বিনামূল্যে শিশু পরিচর্যা পেত। পশ্চিমাঞ্চলের মহিলাদের তুলনায় তারা অধিকতর মুক্ত ও স্বাধীন ছিল। তারা তাদের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় অধিক ভ্রাম্যমাণ প্রমাণিত হয়। পূর্বাঞ্চলের কোন কোন গ্রামে এখন প্রতি একজন মহিলার জায়গায় দুই বা তিনজন পুরুষ বসেছে। নারী-পুরুষের এ ধরনের অনুপাত সুমেরু বৃত্তের কাছেই সাধারণত দেখা যায়। পেট্রা কপিং পূর্বাঞ্চলের স্যাক্সলি প্রদেশের একাত্তকরণ মন্ত্রী নিযুক্ত হবার পর ভেবেছিলেন তাকে মূলত অভিবাসীদের নিয়েই কাজ করতে হবে। প্রথম দিকে এক প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তিনি প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েছিলেন। এক জার্মান পুরুষ চিৎকার দিয়ে বলেছিল ‘আপনি আগে আমাদের একাত্তকরণ কেন করছেন না?’ মিজ কোপিং পূর্ব জার্মান পুরুষদের অভাব অভিযোগ বোঝার জন্য পূর্বাঞ্চল সফর করেছেন। এখন পশ্চিমাঞ্চল সফর করে তিনি অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। জার্মানিতে এখন লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতি মাথাচাড়া দিচ্ছে। জার্মানিকে অন্তরঙ্গভাবে চেনেন এমন এক অক্সফোর্ড ঐতিহাসিক হলেন গর্ডন এ্যাশ। তিনি এই পপুলিজম বা লোকরঞ্জনবাদ মাথাচাড়া দেয়ার পেছনে সাংস্কৃতিক অসাম্যকে দায়ী করছেন। গত বছর এ্যাশ লিখেছেন, মনোযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে অসাম্য শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অসাম্যে পরিণত হয়। গত বছর অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) যে শহরটিতে ৪৭.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, সেই ডর্ফচেমনিজ-এ বেকারত্বের হার ৬ শতাংশের নিচে। কিন্তু মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে প্রচারের সময় এ বিষয়টি উপেক্ষা করেছিল। কেবল এএফডিই এই বিষয়টি দু’বার তুলে ধরেছিল। জাতীয়তাবাদ পশ্চিম জার্মানিতে ট্যাবু বা নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে পরিগণিত ছিল। পূর্ব জার্মানিতে এটাকে ইতিবাচকরূপে উৎসাহিত করা হতো। পূর্ব বার্লিনের এক সমাজকর্মী আন্তজে ওয়েইস বলেন, ‘আমরাই ছিলাম সাচ্চা জার্মান’। ৫৪ বছর বয়স্ক মিজ ওয়েইস বার্লিন প্রাচীরের আড়ালে বেড়ে উঠেছিলেন। এই প্রাচীরকে পূর্ব জার্মানিকে বলা হতো ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী সুরক্ষা প্রাচীর।’ তিনি বলেন, আমাদের বলা হতো আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিরোধের উত্তরসূরি। পতাকা নাড়ানো পশ্চিম জার্মানিতে ছিল ছেলেখেলার ব্যাপার। আর জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক হিসেবে সেসময় পরিচিত পূর্ব জার্মানিতে কমিউনিস্ট যুব সংগঠনগুলোতে তা ছিল এক সর্বব্যাপী ব্যাপার। এএফডি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় মিজ ওয়েইসের নেই। তবে তিনি মনে করেন, যারা এই দল করেছে তাদের বক্তব্য শোনাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, মানুষকে তাদের মনের কথা বলতে দিতে হবে। নইলে জিডিআর যা করেছিল, আমাদেরও তাই করা হবে। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×