ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষায় বিপর্যয়ের শঙ্কা টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা বসতিতে

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বর্ষায় বিপর্যয়ের শঙ্কা টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা বসতিতে

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ শুকনো মৌসুম পেরিয়ে বর্ষা সমাগত। রয়েছে কালবৈশাখী ও ঝড়ো হাওয়ার ঝুঁকি। নানা কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় সমূহ ভোগান্তির আশঙ্কা কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও মনে করছে যত দ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে নেয়ার কাজটি শুরু হওয়া প্রয়োজন। কেননা, বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক বৈরী আবাহওয়া মোকাবেলা করে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে দেখভাল করা কঠিন হয়ে পড়বে। এদিকে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান থাকার মধ্যেও রাখাইন প্রদেশে বজায় রয়েছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি। ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত বলা হলেও মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এবং স্থানীয় উগ্রবাদীরা হুমকি ধমকি ঠিকই অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে করে তমব্রু নো-ম্যানসল্যান্ডে অবস্থানকারীরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার সুযোগ খুঁজছে। স্রোত আগের চেয়ে কমলেও প্রতিদিন ঠিকই আসছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা বলছে, মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত বলে দাবি করলেও সেখানকার চিত্র ঠিকই ভয়াবহ রয়ে গেছে। যারা রয়েছে তারাও আছে আতঙ্কের মধ্যে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাখাইন রাজ্য সফরের সময় সে দেশের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল অং সো এক ধরনের হুঁশিয়ারিই উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, নো-ম্যানসল্যান্ডে অবস্থানকারীদের সরে যেতে। মিয়ানমারের সরকার অবশ্য বলছে যে, সরে যাওয়ার জন্য বলা মানে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার নির্দেশ নয়। নো-ম্যানসল্যান্ড দীর্ঘদিন অবস্থান করার মতো জায়গা নয়। সেখান থেকে তারা ভেতরেও যেতে পারে। তবে রোহিঙ্গারা এ সতর্কতাকে দেখছে এক ধরনের হুমকি হিসেবে। রাখাইন প্রদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, নো-ম্যানসল্যান্ড থেকে রোহিঙ্গাদের সরাতে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ভয়ভীতি বজায় রাখা হয়েছে। রাতের বেলা ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। এ কাজে শুধু স্থানীয় উগ্রবাদী মগরাই নয়, বিজিপিও ভীতি ছড়াচ্ছে। নির্যাতনের মুখে ওই স্থানে অবস্থান নেয়া মানুষগুলো কোন দিকে যাবে ঠিক করতে পারছে না। একদিকে, প্রত্যাবাসনের আশা, অপরদিকে নিজভূমে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের অনিশ্চয়তা। এদিকে, উখিয়া এবং টেকনাফে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং প্রশাসন মিয়ানমার সরকারের বর্তমান অবস্থানকে আগের তুলনায় ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে। তারা মনে করছেন, নো-ম্যানসল্যান্ড থেকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশনার নেপথ্য কারণ অন্য। কারণ সেখানে রোহিঙ্গারা মাসের পর মাস অবস্থান নিয়ে থাকলে তা বহির্বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার দৃষ্টিতে আসছে। তাছাড়া যে কোন সময় এমনকি এখনই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলেও জানাচ্ছে। এ লক্ষ্যে রাখাইনের মংডুতে বেশকিছু অস্থায়ী ক্যাম্পও নির্মিত হয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে তাদের সেখানে নিয়ে রাখা হবে। পরে যাচাই বাছাই করে বাড়ি ঘরে ফিরতে দেয়া হবে। বর্ষা নিয়ে উৎকণ্ঠা ॥ উখিয়া ও টেকনাফে ১২টি অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গার ঝুঁকিপূর্ণ বসতি নিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছরের আগস্টের পর থেকে নতুন করে গড়ে উঠা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অত্যন্ত নড়বড়ে এবং ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রবল বর্ষায় বাংলাদেশে পাহাড় ধসের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। এতে করে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। এতদিন পর্যন্ত সেখানে লোকজন না থাকায় ধসের ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানির প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু এখন পাহাড়গুলোতে লাখ লাখ মানুষের বসতি। তাছাড়া আবাসন নির্মিত হয়েছে পাহাড় ও গাছ কেটে। এতে করে ঝুঁকি আরও বেড়েছে। শীত মৌসুম কোনভাবে কাটলেও আগামীবর্ষায় সামগ্রিক পরিবেশকে ঝুঁকিমুক্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। পাহাড়ের চূড়া কিংবা পাদদেশে গড়ে উঠা রোহিঙ্গাদের বসতিগুলো নিরাপদ নয় মোটেও। বর্ষার আগেই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতন মহল। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদার বৃষ্টির মৌসুমে পাহাড়ে বসবাসের ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঝুঁকিও বিদ্যমান। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি উভয় দেশেরই গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রশাসন এবং পরিবেশবাদীরাও রয়েছেন রোহিঙ্গা নিয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে। স্থানীয় চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, প্রতিবর্ষায় পালংখালী ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা জলমগ্ন হয়ে বন্যা দেখা দেয়। পাহাড়ী ঢলের পানিতে বসতবাড়ি তলিয়ে যায়। প্রাণহানি ও নিখোঁজের মতো ঘটনাও ঘটে। রোহিঙ্গারা যে পাহাড় কেটে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করছে, তাদের অবস্থা বর্ষাকালে কী হবে তা নিয়ে প্রশাসনকে ভাবতে হবে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই পাহাড় ধসের ঝুঁকি নিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ে বসবাস করছে। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, মধুরছড়া, লম্বাশিয়া, ময়নারঘোনা, তাজনিমারখোলা, শফিউল্যাহকাটা ও জামতলির পাহাড়ী এলাকায় ওসব রোহিঙ্গারা ক্যাম্প করে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে, চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রশাসন বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই ঝুঁকি মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতির উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ইতোমধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজার শেড বা ঘর নির্মাণ করেছে সরকার। তবে এতে সঙ্কুলান হচ্ছে না। ফলে পাহাড় চূড়া, ঢালু ও নিচু এলাকায় যত্রতত্র মাটি কেটে ঝুপড়ি বেঁধে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।
×