ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রূপার ভাই বলেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছিলাম তা পেয়েছি ;###;বাসটির মালিকানা রূপার পরিবারকে দেয়ার নির্দেশ

৪ জনের ফাঁসি ॥ ১৪ কার্য দিবসে চলন্ত বাসে রূপা গণধর্ষণ মামলার রায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

৪ জনের ফাঁসি ॥ ১৪ কার্য দিবসে চলন্ত বাসে রূপা গণধর্ষণ মামলার রায়

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল, ১২ ফেব্রুয়ারি ॥ মধুপুরে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে গণধর্ষণ ও হত্যা মামলায় রায়ে চারজনের ফাঁসি ও একজনের সাত বছরের সশ্রম কারাদ-াদেশ দেয়া হয়েছে। সোমবার সকালে টাঙ্গাইল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক আবুল মনসুর মিয়া এই চাঞ্চল্যকর মামলার রায় দেন। ফাঁসির দ-প্রাপ্তরা হলো- ছোঁয়া পরিবহনের হেলপার শামীম (২৬), আকরাম (৩৫), জাহাঙ্গীর (১৯) এবং চালক হাবিবুর (৪৫)। অপর আসামি বাসের সুপারভাইজার সফর আলীকে (৫৫) সাতবছরের সশ্রম কারাদ- এবং এক লাখ টাকা অর্থদ- দেয়া হয়। এদের সবার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। এছাড়া এ মামলার অপরাধে নিয়োজিত নিরাপদ ছোঁয়া পরিবহনের বাসটি ব্যবহৃত হওয়ায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫১৭ ধারানুসারে গাড়িটি সম্পূর্ণ নির্দায় অবস্থায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভিকটিমের পরিবারকে দেয়ার নির্দেশ দেন। টাঙ্গাইল আদালতের পরিদর্শক আনোয়ারুল ইসলাম জানান, সোমবার বেলা ১১টা ৭ মিনিটে বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। সাত মিনিটব্যাপী রায় পড়ে বিচারক এ রায় দেন। গত বছরের ২৬ আগস্ট মধুপুর থানায় মামলা দায়ের হয়। গত বছরের ১৩ নবেম্বর মামলাটি আদালত গ্রহণ করে। এরপর গত ২৩ নবেম্বর মামলাটি আদালত আমলে নেয়। গত ২৯ নবেম্বর অভিযোগ গঠন হয়। এরপর গত ৩ জানুয়ারি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। নয় কর্মদিবসে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এরপর আসামিদের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। সর্বশেষ তিন কার্যদিবসে মামলার যুক্তিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। মামলার মোট ১৪ কার্যদিবসে ৭৩ পৃষ্ঠার রায় দেন আদালত। আদালতের পরিদর্শক আরও জানান, অজ্ঞাত মহিলার মরদেহ হিসেবে পুলিশ বাদী হয়ে মধুপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর দেখে নিহত জাকিয়া সুলতানা রূপার বড় ভাই হাফিজুর রহমান মধুপুর থানায় তার বোনের ছবি দেখে শনাক্ত করেন। পুলিশ ছোঁয়া পরিবহনের গাড়িটি জব্দ করে এবং আসামিদের গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠায়। আসামিরা সেচ্ছায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাইয়ুম খান সিদ্দিকী তদন্ত শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ৩২ জনকে এই মামলায় সাক্ষী করা হয়। গত ৩ জানুয়ারি বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যদিয়ে সাক্ষী শুরু হয়। পরবর্তীতে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, চিকিৎসক, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী গ্রহণকারী চার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সুরতহাল রিপোর্ট ও জব্দ তালিকাসহ মোট ২৭ সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের জেরা করেন। টাঙ্গাইল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি একেএম নাছিমুল আক্তার ও মামলার আইনজীবী এস আকবর খান বলেন, সাক্ষ্য প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হওয়ায় সকলেই খুশি। এ রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ মামলার সব আসামিই পরিবহন শ্রমিক। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী শামীম চৌধুরী দয়াল বলেন, মামলায় অনেক ত্রুটি রয়েছে। তারা আদালতে তা উপস্থাপন করেছেন। আসামিরা নির্দোষ। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট না। আমরা উচ্চ আদালতে আবেদন করব। সেখানে অবশ্যই ন্যায় বিচার পাব। নিহত রূপার বড় ভাই হাফিজুর রহমান বলেন, আমার বোনের তো কোন দোষ ছিল না। তাকে এভাবে নির্যাতন করে হত্যা কেন করা হলো। আমার বোনের ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছিলাম। আদালতে তা প্রমাণ হয়েছে। আমরা এ রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি। এ রায় কার্যকর হলে অপরাধীরা নারী ঘটিত অপরাধ করতে ভয় পাবে। এদিকে আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো মানববন্ধন করেছে। মামলার রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান মানবাধিকারকর্মীরা। অপরদিকে এ রায় শোনার পর আদালত প্রাঙ্গণে নিহত রূপার ছোট বোন পপি মূর্ছা যান। পরিবারের সদস্যরা নিহত রূপাকে স্মরণ করে বিলাপ করতে থাকেন। আদালত প্রাঙ্গণে কান্নার রোল পড়ে যায় নিহতের পরিবারের মধ্যে। মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে চলন্ত বাসে গণধর্ষণ করে পরিবহন শ্রমিকরা। বাসেই তাকে ঘাড় মটকে হত্যার পর মধুপুর উপজেলার পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে রূপার মরদেহ ফেলে রেখে যায়। এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ ওই রাতেই অজ্ঞাত পরিচয় মহিলা হিসেবে তার মরদেহ উদ্ধার করে। পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে রূপার মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় গোরস্থানে দাফন করে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মধুপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে নিহতের ভাই হাফিজুর রহমান মধুপুর থানায় গিয়ে ছবির ভিত্তিতে তাকে শনাক্ত করেন। গত ২৮ আগস্ট এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ময়মনসিংহ-বগুড়া সড়কের ছোঁয়া পরিবহনের হেলপার শামীম (২৬), আকরাম (৩৫) ও জাহাঙ্গীর (১৯) এবং চালক হাবিবুর (৪৫) ও সুপারভাইজার সফর আলীকে (৫৫) গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলার আসামিরা প্রত্যেকেই এখন টাঙ্গাইল কারাগারে রয়েছে। ঘটনার ৬ মাসেই এ মামলার রায় প্রদান করা হলো। রূপার পরিবারের প্রতিক্রিয়া ॥ স্টাফ রিপোর্টার, সিরাজগঞ্জ থেকে জানান, তাড়াশের রূপাকে গণধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আদালতে পাঁচ আসামির শাস্তি হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে তার পরিবার ও সুশীল সমাজ। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রূপার মা হাছনাহেনা বানু বলেন, অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে জেনে খুশি হয়েছি। চির নিদ্রায় শায়িত রূপার আত্মার শান্তি কামনা ও অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির আশায় সোমবার রোজা রেখেছি। রায়ে কি হয় তা শোনার জন্য তিনি ফজরের নামাজ আদায় করে মোবাইল ফোনটি পাশে রেখে জায়নামাজেই বসে ছিলেন। বেলা সোয়া ১১টায় রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বড় ছেলে হাফিজুর রহমান মাকে জানান, পাঁচ আসামির চার জনের ফাঁসি, এক জনের সাত বছর কারাদ- ও এক লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে। রায় শোনার পর তিনি চার রাকাত শুকরিয়া নামাজ আদায় করেন। যে রায় হয়েছে তাতে তিনি খুশি। এখন একটাই চাওয়া ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হোক। এতটুকু দেখে যেতে পারলে মরেও শান্তি পাবেন বলে জানান তিনি। এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আর আক্ষেপ করেন, মেয়ে বলত ও পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের দায়িত্ব নেবে। মা আর ভাই-বোনদের জন্য সবকিছু করার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করত। মেয়েকে নিয়ে কত যে আশা ছিল, কত যে স্বপ্ন ছিল তা আর পূরণ হলো না। পাঁচ ধর্ষক ও হত্যাকারী তা পূরণ হতে দিল না। তিনি প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ রূপা ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবিতে সরব দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। রায় শোনার অপেক্ষায় এ দিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন রূপার ভাই হাফিজুর রহমান, উজ্জল হোসেন, বোন জেসমিন খাতুন, পপি খাতুন, ছোট ভাতিজি হুমায়রাসহ তাড়াশ উপজেলা নাগরিক আন্দোলনের নেতা আব্দুর রাজ্জাক রাজু। রূপার ছোট বোন পপি বলেছেন, দুইবোন ছিলাম জোড়া কবুতরের মতো। ডানা মেলে উড়তে পারতাম না ঠিকই। তবে মনের আকাশে একসঙ্গে পাখা মেলে ঘুরতাম। পরিবারের সীমাহীন দৈন্যতা থাকার পরও দু’বোনে মিলে আনন্দ আর হই হুল্লুড়ে মেতে থাকতাম। ভাবতে অবাক লাগে, এখন সেগুলো শুধুই স্মৃতি। পপি আরও বলেন, আপুর মৃত্যুর পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মাদ নাসিম বগুড়ার এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে আমাকে অফিস সহকারী পদে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি সেখানেই আছি। যে টাকা বেতন পাই, তা দিয়ে বাসাভাড়া দেয়ার পর আর তেমন কিছুই থাকে না। অনেক কষ্টে অসুস্থ মা, ভাই-ভাবি, ভাতিজি নিয়ে চলছে সাত জনের সংসার। এ সময় তিনি এত বড় একটা নৃশংস হত্যাযজ্ঞের রায় মাত্র সাত মাসের মধ্যে ঘোষণা করায় দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর গভীর আস্থা ও সন্তোষ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে চির কৃতজ্ঞতা জানান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মাদ নাসিমকে, দুঃসময় তার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করায়।
×