ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মনের আনন্দে বই খোঁজা, কেনা কাটায় মন

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মনের আনন্দে বই খোঁজা, কেনা কাটায় মন

মোরসালিন মিজান ॥ মেলা যে জমে উঠেছে, সে কথা আর না বললেও চলে। এত বড় পরিসর! পুরোটাজুড়ে বইপ্রেমী মানুষের উচ্ছ্বল উপস্থিতি। শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় ছেলে বুড়ো সবাই এসেছিলেন। দশম দিনের মেলা ঘুরে মনে হলো, বই কেনায় মন দিয়েছেন পাঠক। হ্যাঁ, এবারও জনপ্রিয় ধারার বই নিয়ে বাড়তি আগ্রহ উচ্ছ্বাস চোখে পড়ছে। দৃশ্যমান হচ্ছে। তবে ধ্রুপদী সাহিত্য বা সিরিয়াস বিষয়ে লেখা বই প্রকাশ করে কেউ খুব বিপদে পড়ে গেছেন, তা বলা যাবে না বরং একটু অনুসন্ধানী হয়ে দেখা গেল, নানা বিষয়ে প্রকাশিত সিরিয়স বইয়ের পাঠক বেড়েছে। তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে খুঁজে নিচ্ছেন পছন্দের বই। সাধারণ পাঠকের মতো বিভিন্ন স্টল ও প্যাভিলিয়ন ঘুরে পাওয়া কিছু বইয়ের কথা হতে পারে আজ। প্রথমেই মাওলার কথা বলি। ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে মেলায় এসেছে ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ভাষাতাত্ত্বি¡ক আলোচনা।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর কাব্য ৭ মার্চের ভাষণ। ইউনেস্কোর বিশেষ স্বীকৃতির পর ঐতিহাসিক ভাষণটি নতুন করে সামনে এসেছে। তারও আগে থেকে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। সেই ধারবাহিকতায় এবার মেলায় এসেছে নতুন গ্রন্থ। কাবেদুল ইসলাম সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশ করেছে মাওলা প্রকাশ। বইতে ভাষণের ভাষাতাত্ত্বিক দিকগুলো বিশ্লেষণের ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে। ‘১৯৭১ জবংরংঃধহপব, জবংরষরবহপব ধহফ জবফবসঢ়ঃরড়হ’ বইটিও এসেছে মাওলা থেকে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর মৌলিক লেখা এখন অনেক কম। গবেষণা স্মৃতিচারণমূলক বই তেমন চোখে পড়ে না। এবার সেই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করেছেন মেজর জেনারেল সারওয়ার হোসেন। মৌলিক এবং সমৃদ্ধ রচনা রণাঙ্গনের লড়াই সম্পর্কে বাস্তব ধারণা দেবে, আশা করা যায়। আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আগামী প্রকাশনীর। প্যাভিলিয়নে গিয়ে সেইসব যেমন পাওয়া গেল, তেমনি এসেছে নতুন অনেক বই। একটির শিরোনাম ‘রবীন্দ্র-কাব্যের উদ্ধৃতি।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার বিপুল বিশাল ভা-ার থেকে বহুল পঠিত ও পাঠক নন্দিত পঙক্তিমালা নির্বাচন করে এই উদ্ধৃতি গ্রন্থের রূপ দেয়া হয়েছে। সম্পাদনা করেছেন মোনায়েম সরকার, সৈয়দ জাহিদ হাসান ও লায়লা খানম শিল্পী। বইটি সম্পাদনা করেছেন মোনায়েম সরকার। বইয়ের মূল্য রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা। ঐতিহ্য’র প্যাভিলিয়নে পাওয়া হলো গদ্যের জীবনানন্দকে। প্রিয় কবির কবিতায় বহুকাল বুঁদ হয়ে আছে বাঙালী। তবে তার গদ্য সাহিত্য সম্পর্কে এখও অনেকের ভাল ধারণা নেই। হাতের কাছে পাওয়াও যায় না। সে বিবেচনায় ঐতিহ্যের উদ্যোগটিকে ভাল বলতে হবে। এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় এনেছে জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত উপন্যাস ‘কল্যাণী।’ একেবারে নতুন নয়। তবে অনেকদিন পর মেলায় এসেছে বলা যায়। বইটির মূল্য ১৪০ টাকা। মানসম্পন্ন বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি আছে সুবর্ণ’র। এখানে পাওয়া গেল সাইয়িত আতীকুল্লাহর কবিতা সমগ্র। খ্যাতিমান কবি মহান ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয়কর্মী হিসেবে এবার একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। প্রয়াত কবিকে সর্বোচ্চ সম্মান জানিয়েছে রাষ্ট্র। নতুন প্রজন্মের পাঠকও তার রচনা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। সুযোগটি করে দিয়েছে সবর্ণ। টানা চার দশক ধরে কবির যত কবিতা প্রকাশিত হয়েছে তার সবই পাওয়া যাবে এক মলাটে। বেহুলা বাংলা থেকে এসেছে তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল কবি গিরীশ গৈরিকের কাব্যগ্রন্থ ‘ডোম।’ বইটির জন্য সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন। মূল্য ২০০টাকা। ২২৫ নতুন বই ॥ মেলার দশম দিনে নতুন বই এসেছে ২২৫টি। আনন্দঘন শিশু প্রহর ॥ শনিবারের সকালটিও ছিল শিশুদের জন্য। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য আগেভাগে খুলে দেয়া হয় মেলার প্রবেশদ্বার। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত চলে শিশু প্রহর। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতা। ক ও খ-শাখায় ২৫০জন শিশু-কিশোর অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চন্দনা মজুমদার, ইয়াকুব আলী খান এবং সাগরিকা জামালী। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী। একইদিন একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় দুই শতাধিক শিশু-কিশোর অংশগ্রহণ করে। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘রবি গুহ : মুনীর চৌধুরী : সরদার ফজলুল করিম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মফিদুল হক এবং অধ্যাপক এম এম আকাশ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল, অজয় দাশগুপ্ত, পিয়াস মজিদ ও অলকানন্দা গুহ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন। ‘রবি গুহ ও মুনীর চৌধুরী : সেই সময়’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে মফিদুল হক বলেন, বাংলার ইতিহাসে ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ কালপর্বে যে তীব্র আলোড়ন, আকুল স্বপ্ন ও সেই সঙ্গে স্বপ্নভঙ্গের যে সময়টি আমরা দেখি সেই সময়ের তিন ব্যক্তিত্ব রবি গুহ, সরদার ফজলুল করিম এবং মুনীর চৌধুরী। তাদের জীবন, কর্ম ও চিন্তায় আমরা দেখি অসাধারণ সাযুজ্য। মুনীর চৌধুরী তার সৃষ্টিশীলতা নিয়ে নিরন্তর অবদান রেখে গেছেন বাঙালী মানস পরিপুষ্ট করে তোলার জাতীয় কর্ম সম্পাদনে। অন্যদিকে দেশভাগের পর বাংলাদেশ ত্যাগ করে রবি গুহ পশ্চিমবাংলার ভিন্নতর পরিবেশে ভিন্নভাবে সক্রিয় হয়েছেন উদ্বাস্তুদের জীবনে শিক্ষা ও বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করতে। ‘প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে এম এম আকাশ বলেন, সরদার ফজলুল করিম বিশ্বাস করতেন বিপ্লব একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর এ বিপ্লবের ধারাবাহিকতাতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এমনকী আজকের বাংলাদেশে নারীদের চলাফেরার যে স্বাধীনতা এটাও কম বড় বিপ্লব নয়। মহান মানবতাবাদী এই জ্ঞানতাপস নিজের জন্য কিছুই করেননি, বরং নিজের সমস্ত জ্ঞান ও মেধা ছড়িয়ে দিয়েছেন মানবকল্যাণে। দর্শনের মতো দুর্বোধ্য বিষয়কে সহজ-সরল ভাষায় সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভাঙ্গনের পরও তিনি সাম্যবাদের পক্ষে ইতিবাচক ও আশাবাদী ধারণা পোষণ করতেন এবং তরুণ সমাজতান্ত্রিকদের উৎসাহ দিতেন। আলোচকরা বলেন, রবি গুহ, মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম বামপন্থী চিন্তাধারাকে ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তারা প্রগতিশীল চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তার প্রেরণা হয়ে আছেন বাংলার এই তিন বিরল নক্ষত্র। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন বলেন, আজ আমাদের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে মানবিকতার বোধ জাগ্রত করা একান্ত প্রয়োজন। রবি গুহ, মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম ছিলেন উচ্চতর মানবিকতা-বোধসম্পন্ন মানুষ। তাদের জীবনাদর্শ আমাদের সামনে চলার প্রেরণা হয়ে থাকবে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী সাইদুর রহমান বয়াতি, শফি ম-ল, রনজিত দাস বাউল, পাগলা বাবলু, মোঃ আনোয়ার হোসেন।
×