ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ রায় ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আজ রায় ঘোষণা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান (পলাতক)সহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় রায় ঘোষণা করা হবে আজ বৃহস্পতিবার। অন্য আসামিরা হলেনÑমাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী (পলাতক) এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান (পলাতক)। ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষে বকশীবাজার কারা অধিদফতরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান রায়ের জন্য এ দিন নির্ধারণ করেন। আদালতে দুদকের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল খালেদা জিয়াসহ ছয় আসামির সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদ- দাবি করেছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজাক খান মামলাটিকে সারবত্তাহীন উল্লেখ করে খালেদা জিয়ার খালাস চান। আলোচিত এ মামলায় দুদক ও আসামিপক্ষ মোট ১৬ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন। এদিকে রায়ের দিন বেগম খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া। এদিকে রায়কে ঘিরে সারাদেশে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। অন্যদিকে দেশের সিনিয়র আইনজীবীগণ জনকণ্ঠকে বলেছেন কি দ- হবে তা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। তবে দ- হলে খালেদা জিয়াকে অবশ্যই জেলে যেতে হবে। আর না হলে খালাস পাবেন। যদি দুই বছরের অধিক সাজা হয় তাহলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না। দুদকের আইনজীবী দ-বিধির ১০৯, ৪০৯ ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে। দুদকের প্রধান কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল গতকাল জনকণ্ঠকে বলেন আমরা সব ধরনের অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমি খালেদা জিয়াসহ ৬ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি আশা করছি। অন্যদিকে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও খালেদা জিযার আইনজীবী সানাউল্লা মিয়া জনকণ্ঠকে বলেছেন, প্রসিকিউশনপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণে আমরা মনে করছি বেগম জিয়া খালাস পাবেন। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেন, এক বছরের অধিক দ- হলে নি¤œ আদালত কোন জামিন দিতে পারবেন না। আর যদি দুই বছরের অধিককাল সাজা হয় তাহলে নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। যদি দ- হয় তাহলে তাকে জেলে যেতে হবে। এরপর ঐ রায় স্থগিতের জন্য হাইকোর্টে আপীল করতে হবে। তারপর জামিনের দরখাস্ত দিতে হবে। জেলে থেকে তাকে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করতে হবে। সেখানে রায় যদি স্থগিত না হয় তাহলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না। আর রায় যদি স্থগিত হয়ে যায় তাহলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন। নির্বাচিত হওয়ার পর যদি তার এই রায় যদি আপীলে বহাল থাকে তাহলে তার সংসদ পদ বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি দ-িত না হন তাহলে খালাস পাবেন। তিনি আরও বলেন, সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কেউ নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদ-ে দ-িত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছরকাল অতিবাহিত না হয়ে থাকে, তবে তিনি সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না। ধারাগুলোতে কী আছে ॥ দ-বিধি ১০৯ ধারা : এই ধারা অনুযায়ী দুষ্কর্মে সহায়তা করা হয়েছে, সহায়তার দরুন সে কাজ সম্পাদিত হয়ে থাকলে এবং সেক্ষেত্রে দ-দানের কোনো স্পষ্ট বিধান না থাকলে অনুরূপ সহায়তার সাজা। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন থেকে যে কোনো মেয়াদের কারাদ- দিতে পারেন আদালত। অথবা উভয় দ-ে দ-িত করতে পারেন। দ-বিধি ৪০৯ ধারা : দ-বিধির ৪০৯ ধারা (যাবজ্জীবন অথবা দশ বছরের কারাদ-)। সরকারী কর্মচারী কর্তৃক অথবা ব্যাংকার, ব্যবসায়ী বা প্রতিনিধি কর্তৃক অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ (ঈৎরসরহধষ ইৎবধপয ড়ভ ঞৎঁংঃ নু ঢ়ঁনষরপ ংবৎাধহঃ, ড়ৎ নু নধহশবৎ, সবৎপযধহঃ ড়ৎ ধমবহঃ) : কোন ব্যক্তি যদি সরকারী কর্মচারী হিসেবে তার পদমর্যাদা বলে অথবা ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, ফ্যাক্টর, দালাল বা প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবসা সূত্রে কোনভাবে কোন সম্পত্তির জিম্মাদার হয়ে বা ওই সম্পত্তির পরিচালনের ভারপ্রাপ্ত হয়ে সে সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলকভাবে বিশ্বাসভঙ্গ করে। এ ধারার শাস্তি : যাবজ্জীবন কারাদ- অথবা দশ বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ-ে দ-িত হতে পারেন, অর্থদ-েও দ-িত হবেন। দুদক আইনের ৫ (২) ধারা অনুযায়ী কোন সরকারী কর্মচারী অপরাধমূলক অসদাচরণ সংঘটিত করলে বা উদ্যোগ গ্রহণ করলে তিনি সাত (০৭) বছর পর্যন্ত কারাদ- অথবা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-যোগ্য হবে এবং অপরাধমূলক অসদাচরণ সংশ্লিষ্ট আর্থিক সম্পদ অথবা সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে। খালেদার বিরুদ্ধে যে সমস্ত মামলা ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার পর যুক্তিতর্কের জন্য রয়েছে জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলা। এ মামলার অসমাপ্ত যুক্তিতর্কের জন্য ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত। এর পাশাপাশি আরও ১৪ মামলা স্থানান্তর করা হয়েছে। মামলাগুলো হলো দারুস সালামের নাশকতার আট মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা, যাত্রাবাড়ী থানার বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা ও মানহানির দুই মামলা। ৮ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এ মামলাগুলো ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার ৫টি, রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা (হুকুমের আসামি), ইতিহাস বিকৃতি করা, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি, ভুয়া জন্মদিন পালনসহ বিভিন্ন অভিযোগে দেশের আদালতে প্রায় ৩৭টি মামলা রয়েছে। প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণের পর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আমরা সকল প্রকার অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, ‘বিদেশী অনুদানের অর্থ এতিমদের কল্যাণে খরচ না করে আসামিরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে হস্তান্তর, রূপান্তর করেছেন। বছরের পর বছর তারা ওই অর্থ পাচার করেছেন। সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে যে অর্থ প্রাইম ব্যাংকে আসে, এ অর্থ দুই ভাগে ভাগ হয়। পরে আসামি মোস্তাফিজুর রহমান ও তারেক রহমানের যৌথ এ্যাকাউন্ট থেকে এ অর্থ উত্তোলন করা হয়।’ ‘বগুড়া ও বাগেরহাটে এতিমখানা নির্মাণের জন্য আদালতে যে অর্থের তথ্য দেয়া হয়েছে, তার কোনও ভিত্তি নেই। সাক্ষীদের সাক্ষ্য অনুযায়ী যে টাকা দেশে এসেছে, সে টাকা রাষ্ট্রের। এ টাকা আত্মসাতের দায় আসামিদের নিতে হবে। ‘এ টাকা কোথায় ব্যয় হলো বা কোথায় গেলো এই ব্যাখ্যা তারা দিয়ে যাবেন।’ ‘ভুয়া সম্পত্তি কিনে এবং একটি সিভিল মামলা দায়ের করে টাকা আত্মসাতের নাটক সাজিয়েছিলেন আসামিরা। ৩২ জন সাক্ষীর জবানবন্দী উপস্থাপন করে আমি আদালতে যে বিবরণ দিয়েছি, এর মাধ্যমে আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি বলে মনে করি। সে কারণেই আমি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করছি। রাজনৈতিক মামলা ॥ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল জনকণ্ঠকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রায় ৩৭টি মামলা রয়েছে। এগুলো সবই রাজনৈতিক মামলা। হ্যারেজমেন্ট করার জন্যই এ মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে। আমরা আইনীভাবেই এগুলো মোকাবেলা করব। ২৫ জানুয়ারির যুক্তিতর্ক ॥ ২৫ জানুয়ারি ছিল এ মামলার শেষ দিনের যুক্তিতর্ক। ঐ দিন বেলা ১১টা ৩৮ মিনিটের দিকে আদালতে পৌঁছান বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। এ মামলার দুই আসামি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল ও শরফুদ্দিন আহমেদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তাদের আইনজীবী আহসান উল্লাহ। তাকে সহায়তা করেন সৈয়দ মিজানুর রহমান। তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বক্তব্য রাখেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল। তার বক্তব্য শেষে খালেদা জিয়ার পক্ষে আবার রিপ্লাই বক্তব্য রাখেন সিনিয়র আইনজীবী রেজাক খান। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করেন। মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ তিনজন পলাতক থাকায় আইন আনুযায়ী তাদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ নেই। ২৪ জানুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন আইনজীবী আহসান উল্লাহ। এরপর মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামালের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন তিনি। শরফুদ্দিননের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় ১৬ জানুয়ারি। এরপর যুক্তি শেষ না হওয়ায় ১৭, ১৮, ২২, ২৩ ও ২৪ যুক্তি উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী। ২০ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। এরপর ২১, ২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর এবং ৩, ৪, ১০, ১১ ও ১৬ জানুয়ারি খালেদার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন তার আইনজীবীরা। মামলার বিবরণ ॥ মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপ-পরিচালক হারুন আর রশীদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।
×