ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ঢাকার পাশে থাকব

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ঢাকার পাশে থাকব

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বাংলাদেশ যত না তৎপর মিয়ানমার ততটা তৎপর বা আগ্রহী নয় বলে প্রতীয়মান। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত বছরের আগস্ট মাসে সশস্ত্র সেনা অভিযানের পর প্রায় ৮ লাখের মতো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এর আগে এসেছে আরও ৫ লাখ। এ পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গা ভারে জর্জরিত হয়ে আছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষে মানবিকতার হাত সম্প্রসারিত করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়। শুরু হয় কূটনৈতিক তৎপরতা। বিশ্ব চাপের মুখে একপর্যায়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই করে প্রত্যাবাসনে সম্মতিজ্ঞাপন করে। দুদেশের পক্ষে বৈঠকে প্রত্যাবাসন সংক্রান্তে চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর গত ২৩ জানুয়ারি তা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। এ অবস্থায় বিষয়টি সম্পূর্ণ ঝুলে আছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক, সরকারপ্রধান, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাপ্রধান, দূতাবাস কর্মী, সাহায্য সংস্থার নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কর্মকর্তারা সরেজমিন রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করেছেন। মঙ্গলবার সর্বশেষ আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করেছেন, বাংলাদেশ সফররত সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আঁলা বেরসে। মঙ্গলবার দুপুরে সুইস প্রেসিডেন্ট উখিয়া কুতুপালং পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে, তা নজিরবিহীন। এজন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার ভরণ-পোষণ বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সুইজারল্যান্ড সরকার রোহিঙ্গা সঙ্কটে ত্রাণ সহায়তাসহ নানা তৎপরতার মাধ্যমে আন্তরিকভাবে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। বাংলাদেশ-সুইজারল্যান্ডের বন্ধুত্ব ৪৫ বছরের উল্লেখ করে তিনি এ বন্ধুত্ব অটুট রাখতে সুইজারল্যান্ড কাজ করে যাচ্ছে বলে মত ব্যক্ত করেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড কাজ করবে বলেও জানান সুইস প্রেসিডেন্ট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে সুইস প্রেসিডেন্ট বলেন, সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে রোহিঙ্গারা যাতে স্বদেশে ফেরত যেতে পারে, সুইজারল্যান্ড এ লক্ষ্যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশকে সাহায্য অব্যাহত রাখারও আশ্বাস দেন। সুইস প্রেসিডেন্টের সফরকালে তার সঙ্গে ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, জেনেভায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শামিম আহসান, চীফ অব প্রটোকল একেএম শহিদুল করিম। কক্সবাজার বিমানবন্দরে সুইস প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানান আরআরআরসি (অতিরিক্ত সচিব) মুহাম্মদ আবুল কালাম, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেন, আইওএম, ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা। বিমানবন্দর থেকে সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ও তার সফর সঙ্গীরা কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। হাসপাতালে তিনি সুইজারল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে একশটি উন্নতমানের বেডসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম হস্তান্তর করেন। পরে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা সম্পর্কে কর্তব্যরত ডাক্তারদের কথা শোনেন এবং হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখেন। সুইস প্রেসিডেন্ট কুতুপালং ডিপোর আইওএম হাসপাতাল এবং ইউনিসেফ স্থাপিত শিশুবান্ধব সেন্টারও পরিদর্শন করেন। এরপর তিনি কুতুপালং ডি-৫ এরিয়ায় অবস্থিত রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন। সুইস প্রেসিডেন্ট মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা বেশকিছু রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি আরও বলেন, শরণার্থী সঙ্কটের একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে চলমান অগ্রগতিকে সুইজারল্যান্ড স্বাগত জানায়। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানজনকভাবে হবে বলেও আশা ব্যক্ত করেন। সুইস প্রেসিডেন্ট জানান, বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গাদের জরুরী সহায়তায় ‘সুইস মানবিক সাহায্য সংস্থা’ ২০১৭ সালে ৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছে। ২০১৮ সালেও সুইজারল্যান্ড ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিরিক্ত সহায়তা দেবে এবং মানবিক প্রচেষ্টায় যুক্ত থাকবে। এর ফলে কক্সবাজারের স্থানীয় কমিউনিটিও উপকৃত হবে। সুইস প্রেসিডেন্ট বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশে নিয়োজিত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাসহ অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড ঘনিষ্টভাবে কাজ করবে। বিমানবন্দরে ভুয়া রোহিঙ্গা স্বামী-স্ত্রী আটক ॥ বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে কক্সবাজার বিমানবন্দরে মিয়ানমারের এক নারীসহ দুইজনকে আটক করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। আটক আবুল ওসমান নামে রোহিঙ্গা যুবক উখিয়ার কুতুপালং ৪নং ব্লকের ডি-৪ এর বাসিন্দা। ওই রোহিঙ্গা নারী আবুল ওসমানকে নিজের স্বামী বলে পার পেয়ে যেতে চাইলেও অবশ্য পরে স্বীকার করেছে, আবুল ওসমান তার ভাই শ্বশুর। তার আসল স্বামী আবু তাহের এক বছর আগে থেকে মালয়েশিয়া থাকে। গত রমজান মাসে তাদের বিয়ে হয়। রবিবার বিকেলে তাদের আটক করা হয়। দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশী পাসপোর্ট বানিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর কথা রোহিঙ্গা নারী নিজেই স্বীকার করেছে। সে জানায়, সব কিছু তার স্বামী মালয়েশিয়া থেকে করেছে। বেসরকারী বিমান রিজেন্ট এয়ারওয়েজের তিনটার ফ্লাইট ছিল তার। উড়াল দেয়ার আগেই তার যাত্রা আটকে দেয় মাদকদ্রব্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। আটককালে রোহিঙ্গা নারীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে জাতীয়তা পরিচয় সংক্রান্ত বেশ কিছু ডকুমেন্ট। আটক নারীর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ওইসব ডকুমেন্ট অনুযায়ী রোহিঙ্গা নারীর নাম ইয়াছমিন আকতার। পিতা মৃত মোহাম্মদ হোসেন। মাতা নূর নাহার বেগম। ঠিকানা-পশ্চিম নতুনবাহারছড়া, ২নং ওয়ার্ড, কক্সবাজার পৌরসভা। তার হাতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত ভূমিহীন প্রত্যয়নপত্রও পাওয়া গেছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে আটক রোহিঙ্গা নারী নিজের তার প্রকৃত নাম নূর নাহার বেগম, পিতা শামসুল আলম, মাতা শাকিলা বেগম, ঠিকানা বালুখালী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প বলে জানিয়েছে। পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য সে বাংলাদেশী নাগরিকের ডকুমেন্ট ব্যবহার করেছে বলে স্বীকার করেছে। আটক দুই রোহিঙ্গাকে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের জানান, ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে স্বজনের কাছে তাদের তুলে দেয়া হয়েছে। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বাংলাদেশী ভুয়া ঠিকানায় পাসপোর্টে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে রোহিঙ্গারা। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এদের বিদেশে পাঠাতে শক্তিশালী দালালচক্র গড়ে উঠেছে। তারা বাংলাদেশী নাগরিকের জন্ম সনদ ব্যবহার করে ওই নামে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করিয়ে বিদেশ পাঠাচ্ছে। এজন্য দুর্বল পুলিশ ভেরিফিকেশনকে দায়ী করা হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয় প্রশ্রয়, পাসপোর্ট অফিস ঘিরে গড়ে ওঠা দালাল চক্রের সহায়তা, প্রকৃত রোহিঙ্গা চিহ্নিতকরণ জরিপ না করার কারণে তারা পাসপোর্ট পাচ্ছে। প্রবাসী রোহিঙ্গারাই বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া তাদের আত্মীয়দের বিদেশে পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে করণীয় সবকিছু করতে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। চুক্তির ভিত্তিতে জনপ্রতি ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা ব্যয় করে জন্মনিবন্ধন, জাতীয়তা সনদ, পুলিশ ভেরিফিকেশন, পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এলাকাবাসী সূত্রে জানানো হয়েছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য এসব রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর সদস্যরা বিশাল সমস্যা। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেয়া হলেও বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ রোধ করা অত্যন্ত জরুরী।
×