ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

এক টেস্টের দুই ইনিংসেই বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি। ব্র্যাডম্যান, চ্যাপেল, বোর্ডার,;###;গাভাস্কারদের কাতারে নিজের নাম লিখিয়েছেন এই কৃতী ব্যাটসম্যান

মুমিনুলের বীরত্বগাথা ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মুমিনুলের বীরত্বগাথা ইতিহাস

মিথুন আশরাফ ॥ যে ম্যাচ প্রতিপক্ষের দিকে ঝুঁকে আছে সেই ম্যাচটিকে কিভাবে নিজেদের দিকে আনা যায় তা যেন রবিবার দেখিয়ে দিলেন বাংলাদেশ মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান মুমিনুল হক। হারের সম্ভাবনা ছিল। ড্র করতে হলে চাই ব্যাটসম্যানের বীরত্বগাথা কোন ইনিংসের। মুমিনুল সেই কাজটিই করে দেখালেন। এমনই এক ইনিংস খেললেন যে ইনিংসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট ড্র’ই করে ফেলল বাংলাদেশ। মুমিনুল প্রথম ইনিংসে ১৭৬ রান করেছিলেন। প্রথমদিনই সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন। টেস্টের পঞ্চম ও শেষদিনেও করলেন আরেকটি সেঞ্চুরি। দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৫ রানের ইনিংস খেললেন। যে ইনিংসটি বাংলাদেশকে হার থেকে বাঁচিয়ে ড্র করিয়েছে। মুমিনুলও বীরত্বগাথা ইতিহাস করে দেখিয়েছেন। এক টেস্টের দুই ইনিংসেই বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করে দেখিয়েছেন। ব্র্যাডম্যান, চ্যাপেল, বোর্ডার, গাভাস্কারদের কাতারে নিজের নাম লিখিয়েছেন মুমিনুল। বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে টেস্টে তামিম (৮ সেঞ্চুরি), আশরাফুলের (৬ সেঞ্চুরি) পর তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ছয়টি সেঞ্চুরিও করেছেন মুমিনুল। ম্যাচের নায়কও মুমিনুলই। চট্টগ্রাম টেস্টটির চতুর্থদিন শেষে বাংলাদেশ স্কোরবোর্ডে ৩ উইকেট নেই। ইনিংস ব্যবধান এড়াতে আরও ১১৯ রান লাগে। তখন আতঙ্কই কাজ করেছিল। ম্যাচটি শ্রীলঙ্কার দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে ছিল। শ্রীলঙ্কার জয়ের পাল্লাই ভারি ছিল। মুমিনুল তখন ১৮ রানে অপরাজিত। পঞ্চমদিনে তিনি আরেক ব্যাটসম্যানকে নিয়ে বাংলাদেশকে বাঁচাতে নামবেন। নেমেছেনও। লিটন কুমার দাসকে সঙ্গে নিয়ে নেমেছেন। আর দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি কি করতে পারেন। যে চন্দিকা হাতুরাসিংহে বাংলাদেশের কোচ থাকার সময় মুমিনুলকে টেস্ট থেকেই বাদ দিতে চেয়েছেন। তার নাকি শর্ট বল খেলায় সমস্যা। অফস্পিনে সমস্যা। সেই হাতুরাসিংহে এখন শ্রীলঙ্কার কোচ। হাতুরাসিংহেকে মুমিনুল দেখিয়ে দিয়েছেন কোন কিছুই তার সমস্যার মধ্যে পড়ে না। শুধু একটু সাহস দরকার। আত্মবিশ্বাসী করে তোলা দরকার। আর যে বিষয়গুলো নিয়ে সমস্যার কথা বলা হয়েছে সেই সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করা দরকার। যার সবকিছুই হাতুরাসিংহে না থাকাতে এখন মিলেছে। আর মিলতেই জ্বলে উঠেছেন মুমিনুল। এমনই জ্বলে উঠেছেন নিজে তো টানা দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করার ইতিহাস গড়েছেনই। লিটনকে নিয়ে চতুর্থ উইকেটে ১৮০ রানের জুটি গড়েছেন। যে জুটিই আসলে বাংলাদেশকে ড্র’র পথে নিয়ে গেছে। ২৬১ রানে গিয়ে ধনঞ্জয়ার বলে মুমিনুল (১৭৪ বলে ৫ চার ও ২ ছক্কায় ১০৫ রান) আউট হয়ে মাঠ ছাড়েন। ততক্ষণে দিনের ৫১ ওভার খেলা হয়ে যায়। ম্যাচও ড্র’র দিকেই হেলে পড়ে। প্রথম সেশনে কোন উইকেট না হারিয়ে মুমিনুল-লিটনের ব্যাটে ভর করে যে বাংলাদেশ ড্র’র দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ১৫৪ বলে সেঞ্চুরি করা মুমিনুল আউটের পরও তাই ড্র হবে তা নিয়ে আর কোন সংশয়ই থাকে না। বাকি সময়টায় আরেকটি উইকেটই পড়ে। সেটি ৯৪ রানে আউট হওয়া লিটনেরই। এরপর মাহমুদুল্লাহ (২৮*) ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত (৮*) মিলে দিন শেষ করার দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু একটা সময় গিয়ে ১৭ ওভার থাকতেই দুই অধিনায়কের সম্মতিতে দিন শেষ করে দেয়া হয়। তিনদিনে ১৫৩৩ রান হয়। বাংলাদেশ দুই ইনিংস মিলিয়ে করে ৮২০ রান। এর মধ্যে মুমিনুল একাই দুই ইনিংসে মিলিয়ে করেন ২৮১ রান। এক টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে যা সর্বোচ্চ রান। এক টেস্টে মুমিনুল যা করে দেখালেন তা গৌরবময় নৈপুণ্য। যে নৈপুণ্যে শুধু নিজেকেই উচ্চ আসনে নিয়ে যাননি তিনি, বাংলাদেশকেও বাঁচিয়েছেন। সেই ম্যাচ বাঁচানো ইনিংসটি খেলে গ্রেটদের কাতারে নিজেকে যুক্তও করেছেন। এখন পর্যন্ত ৬৭ জন ব্যাটসম্যান ৮৩ বার এমন কীর্তি গড়েন। যার মধ্যে মুমিনুল একজন এবং বাংলাদেশ থেকে প্রথম। এক টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি তো আর বলে কয়ে হওয়ার নয়। গ্রেট ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কলিন কাউড্রে, জহির আব্বাস, শচিন টেন্ডুলকর, সৌরভ গাঙ্গুলীদের মতো ব্যাটসম্যানরাও যেখানে এমন কৃতিত্ব গড়তে পারেননি। সেখানে মুমিনুল তা করে দেখালেন। এমনই অবস্থা যে মুমিনুলকে বেশিরভাগ সময় মাঠেই থাকতে হয়েছে। ৩৩০ মিনিট ব্যাট করেছেন। এরপর ২০০ ওভার ফিল্ডিং করেছেন। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার দ্রুতই ব্যাট হাতে নেমে পড়ে ২৫২ মিনিট ব্যাট করেছেন। মুমিনুল তাতেও দমে যাননি। কারণ তার অসাধারণ এক ইনিংসের ওপরই যে বাংলাদেশের মান রক্ষা নির্ভর করছিল। তিনিই শুধু নন, বাকিদের ওপরও ড্র ফল বের করে আনা নির্ভর করছিল। কিন্তু মুমিনুলই যেন দায়িত্বটি ভালভাবে কাঁধে তুলে নিলেন। তাতে করে এক টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরিয়ান ব্র্যাডম্যান, চ্যাপেল, বোর্ডার, গাভাস্কার, দ্রাবিড়, অরবিন্দ ডি সিলভা, কম্পটন, গুচ, গ্রিনিজ, হেডলি, লারা, হানিফ মোহাম্মদ, মিয়াঁদাদ, পন্টিং, সাঙ্গাকারা, সাটক্লিফ, লরেন্স রো, সোবার্স, ওয়ালকট, এভারটন উইকস, কানহাই, হেইডেন, হ্যামন্ড, জ্যাক ক্যালিস, আর্থার মরিস, বিরাট কোহলি এবং হাশিম আমলা; এই নামগুলোর তালিকায় মুমিনুল হকের নামও জড়িয়ে পড়ল। এমন এক সময় মুমিনুল দলের হাল ধরেছেন, যখন হারের শঙ্কাতেও ছিল বাংলাদেশ। সেই হারের শঙ্কা দূর আকাশে উড়িয়ে দিয়ে খুব সুন্দরভাবে এগিয়ে গেছেন। সেঞ্চুরি করেই বাংলাদেশের ড্র হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত করেই মাঠ ছেড়েছেন। বীরত্বগাথা এক ইতিহাস গড়েছেন।
×