ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ মোঃ জয়নাল আবদিন

অভিমত ॥ মানবতার জয় হোক

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অভিমত ॥ মানবতার জয় হোক

আজ ৫ ফেব্রুয়ারি, সন্ধানীর ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই দিন চিকিৎসা বিজ্ঞানের কিছু স্বপ্নচারী তরুণ মানবতার ডাক দিয়ে সমাজ সংসারে ভালবাসার দ্বীপ জ্বেলেছিলেন। এই তো সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের কাজ, গর্বিত চিকিৎসকের কাজ। আজ স্মরণ করি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সেই ৬ জন বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান স্বপন, মোশাররফ হোসেন মুক্ত, মোঃ ইদ্রিস আলী মন্জু, মোঃ আব্দুল কাইউম, মোস্তফা সেলিমুল হাসনাইন ও খুরশীদ আহমেদ অপুকে, যারা মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিয়ে ‘সন্ধানী’ প্রতিষ্ঠা করেন। ঘটনাটা এ রকম- ১৯৭৭ সালের প্রথম দিকে মোঃ ইদ্রিস আলী জানতে পারেন যে তারই এক সহপাঠী আর্থিক প্রতিকূলতার কারণে সকালের নাশ্তা না করে অভুক্ত অবস্থায় দুপুর ২টা পর্যন্ত ক্লাস করেন। তাকে ব্যাপারটি ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তিনি তার অন্য পাঁচ বন্ধুদের সকালে নাশ্তার টেবিলে জানান। এ নিয়ে কিছু একটা করতে তারা ৬ বন্ধু একত্রিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের এনেক্স ভবনের কড়ই গাছের নিচে। তারা আলোচনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, একজন ৭ টাকা, বাকি ৫ জন ৫ টাকা করে জমিয়ে তাদের এই বন্ধুকে দেবেন। যেহেতু তাদের বন্ধু নাশ্তার টাকা নিতে চাইবে না তাই সবার টাকা জমা করে মোঃ ইদ্রিস আলীকে দেয়া হবে এবং তিনি সহপাঠীকে বুঝিয়ে টাকা হস্তান্তর করবেন। এই মাসিক ৩২ টাকা সহপাঠীকে সহযোগিতার মাধ্যমে ১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে সন্ধানী। প্রতিষ্ঠাতা ছয়জন তাদের কাজের সাংগঠনিক রূপ দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ‘সন্ধানী’ নামে এই সংগঠনের নামকরণ করেন। পরবর্তীতে তারা দেখে যে, রক্তের অভাবে হাসপাতালে অনেক রোগী মারা যাচ্ছে। তারা চিন্তা করল, সবাই একটু স্বপ্রণোদিত হয়ে রক্তদান করলেই তো অনেক জীবন বেঁচে যায়। সে লক্ষ্যে তারা ১৯৭৮ সালের ২ নবেম্বর প্রথম স্বেচ্ছায় রক্তদান অনুষ্ঠান করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। এরপর ১৯৮৪ সাালের ২৫ নবেম্বর রংপুরের কিশোরী বালিকা টুনটুনির চোখে কর্ণিয়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। একটা সময় ছিল যখন ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের জন্য, বাবা-মা ছেলেমেয়ের রক্ত দিতে ভয় পেত। এখন আর সে রকম নেই। এখন প্রয়োজনে যে কেউ রক্ত দিতে এগিয়ে আসছে। এটা সন্ধানীর অবদান। সন্ধানী দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান কার্যক্রমের পাশাপাশি ভ্যাকসিনেশন, যে কোন দুর্যোগে ত্রাণ সহায়তা, ওষুধ বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, বৃত্তি প্রদানসহ নানাবিধ সামাজিক ও মানবিক কাজ করে আসছে। আজকের পৃথিবীর দিকে তাকান। ক্ষমতা আর অর্থ-সম্পদের জন্য মানুষ কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ মঙ্গল গ্রহে আবাস গড়ার স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশও উন্নয়নের মহাসড়কে। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, মানুষ হিসেবে আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমাদের চারপাশ প্রতিনিয়ত হানাহানি, মারামারিসহ মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ছেয়ে গেছে। পশুরাও বুঝি আমাদের দেখে লজ্জা পাচ্ছে! এই অবক্ষয় থেকে মুক্তির একটিই উপায়। সমাজে ভাল মানুষ তৈরি করা, যা কিছু ভাল তাকেই উৎসাহিত করা, প্রণোদনা দেয়া। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উল্টোটা ঘটছে, যা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই এখনই সময় বিবেককে জাগিয়ে তোলার, মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলীগুলোকে তুলে ধরার, মানুষ হয়ে মানুষকে ভালবাসার। ৪১টি বছর সন্ধানী আমাদের সেই পথেরই শিক্ষা দিয়েছে। আমরা একটি মানবিক বাংলাদেশ চাই। মানবিক পৃথিবী চাই। সন্ধানীর প্রথম গঠনতন্ত্রে উদ্দেশ্য হিসেবে লিখিত ছিল- ‘যাবতীয় অন্যায়-অনাচার থেকে মুক্ত রেখে নিজেদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা এবং মানবতার কল্যাণের জন্য সাধ্যানুযায়ী সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।’ আদর্শ, সততা, কল্যাণ- ব্যাপারগুলো সমাজ থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলোকে ধরে রাখতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মানুষের উন্নতি হোক, পৃথিবী এগিয়ে যাক। কিন্তু সরলতা, ন্যায্যতা নষ্ট না হোক। ভাল মানুষ টিকে থাকলে পৃথিবী টিকে থাকবে। মানবতাকে পরাজিত করলে পৃথিবী পরাজিত হবে। মানবতার জয় হোক। জয় হোক সন্ধানীর। লেখক : মহাসচিব, সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি [email protected]
×