ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

॥ পর্ব দুই ॥ সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার যা এক কথায় ‘ছাইওয়ার’ বলে পরিচিত। এক সামরিক বিশ্লেষক লিওনার্ড ডুব-এর ভাষায় যা সাধারণত ব্যবহার হয়ে থাকে ‘To destroy the morale of enemies through tactics that aim to despress troops psychological states. আর একজন সমাজবিজ্ঞানী বেলা সজুনইয়োগ ছাইওয়ার শব্দটি সম্পর্কে যা বলেছেন সেটা হলোÔTo denote a action which is practiced mairly by Psychological methods with the aim of evokiong planned Psychological reaction in other People’. তবে একথা সঠিক যে, প্রাক-ঐতিহাসিক যুগ থেকেই দুদেশের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লাগলে সংশ্লিষ্ট দেশ ছাইওয়ারকে একটা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধফ্রন্ট হিসেবে ব্যবহার করে। বিশেষ করে যুদ্ধটা যদি একটু বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ছাইওয়ার ফ্রন্টকে যে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিল সেটা সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। আমেরিকা তাদের ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ছাইওয়ার বিষয়ে ব্যাপক কর্মসূচী নিয়েছিল। এ ব্যাপারে তাদের ‘ফনিক্স কর্মসূচী গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছিল কয়েকবার। আমেরিকা তাদের ছাইওয়ারের অংশ হিসেবে ফ্লোরিডা স্টেট থেকে কিউবার বিরুদ্ধে ‘টিভি মারটি’ চালু করেছিলÑযা অবশ্য কিউবা ‘জ্যাম’ করে দিতে সমর্থ হয়েছিল। এমনকি ইরাক যুদ্ধেও আমেরিকা তাদের ‘শক এন্ড অ’ প্রচার মাধ্যমে ইরাকী সেনাবাহিনীর মনোবল নষ্ট করে দিতে সমর্থ হয়েছিল। এমনকি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরও বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ছাইওয়ারের পদ্ধতি হিসেবে অল্প অল্প করে অনেকদিন ধরে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন শত্রুদের এমন একটা ধারণা প্রদানের জন্য যে- অবিলম্বে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করা হবে। সাধারণত দু’পক্ষের মধ্যে সামনা সামনি এবং সরাসরি যুদ্ধ হলে যুদ্ধের ফলাফলটা হার বা জিত যেটাই হোক না কেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে থাকে। আর সেই যুদ্ধটা যদি হয় গেরিলা পদ্ধতিতে তাহলে ফলটা সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হতে সময় লেগে যায় কিছুটা বেশি। তবে ফলাফলের দিকটা বিবেচনা করলে ছাইওয়ারের বিষয়টা একটু আলাদা। সম্মুখযুদ্ধ অথবা গেরিলা যুদ্ধের মতো ছাইওয়ারেও নানা কিছু চিন্তা-ভাবনা করে যুদ্ধ পরিচালনা ও পদ্ধতি নির্ধারণ করার প্রয়োজন হতে থাকে সুনিপুণ ও সুদক্ষভাবে। যদিও কাক্সিক্ষত ফলটা পেতে হয়ত সময় লাগতে পারে অনেক বেশি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের মতো অন্যতম শক্তিশালী একটা সামরিক বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের বিরুদ্ধে আমরাও ছাইওয়ার পরিচালনার জন্য নানা ধরনের স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকারের সার্বিক যুদ্ধ পরিকল্পনায় সহায়ক ভূমিকা পালনে সচেষ্ট ছিলাম। আমাদের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য ছিল প্রথমত মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত সামরিক ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের যারা মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বা যুবসহ অন্য আপনজনদের ছেড়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের শত্রুদের পরাহত করতে নিজেদের জীবনবাজি রেখে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে যুদ্ধ করে চলেছেন তাদের মনোবল দৃঢ় করা। দেশের মানুষের কাছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সমর ফ্রন্টের বিজয় গাথার অসাধারণ গল্পের বার্তা পৌঁছে দেয়া এবং শত্রুদের ঘাঁটিতে ও বিভিন্ন আস্তানায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেভাবে ক্রমাগতভাবে আঘাতের পর আঘাত হেনে চলেছেন- সেসব বীরত্বগাথার কাহিনী দিনের পর দিন ক্রমাগতভাবে পরিবেশন করে শত্রুদের মনোবল ভেঙে দেয়া। ছাইওয়ারের এসব কর্মসূচী ও পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব আকবর আলি খান, যিনি পরবর্তীকালে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও কেয়ারটেকার সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ঐ সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আকবর আলি খানকে ছাত্রজীবন থেকেই একজন সহপাঠী হিসেবে খুবই মেধাবী এবং বুদ্ধিমান ছাত্র বলে জানতাম। তিনিই ছিলেন আমাদের ছাইওয়ার সংক্রান্ত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতিগুলো প্রণয়নে অন্যতম উপদেষ্টার ভূমিকা পালনকারী। তৎকালীন প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ সাহেব প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং আরও কয়েকজন সংশ্লিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছাইওয়ার নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন তৎকালীন জয়বাংলা পত্রিকা ও অন্যান্য তথ্য বিষয়ক বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত এমএনএ মান্নান, তথ্য সচিব, পররাষ্ট্র সচিব এবং সংস্থাপন সচিবের সঙ্গে আমাকে ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ড. বেলায়েতকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। আলাপ-আলোচনার পর প্রতিরক্ষা সচিব ছাইওয়ার সংক্রান্ত ব্যাপারে ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি বিষয়ে একটা কনসেপ্ট পেপার তৈরি করার দায়িত্ব দেন আমাকে। পেপারটি তৈরি করার আগে আমি আমার শিক্ষক তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোজাফফর আহম্মদ চৌধুরী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এআর মল্লিকের সঙ্গে আলাপ করে এ ব্যাপারে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করি। এছাড়া আলাপ করি সিনিয়র সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এমআর আকতার মুকুল এবং তোয়াব খানের সঙ্গে। প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ সাহেব অবশ্য আমার তৈরি করা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন পদ্ধতিটি কিছুটা সংযোজন ও পরিবর্তন করে অনুমোদন করেন। আমরা যারা ছাইওয়ার কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম তাদের সবারই একটা দৃঢ় প্রত্যয় ছিল যেÑ আমরা যে কার্যক্রম পরিচালনা করছি সেটা মূলত মুক্তিযুদ্ধেরই একটা ফ্রন্ট এবং আমাদের কাজে যেন আমরা ব্যর্থ না হই সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কোন কোন দিন কাজ শেষ করতে আমাদের রাত দশটা-এগারোটা বেজে যেত। কিন্তু কারও মুখে কোনদিন বিরক্তির কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হতো না। কবি আল মাহমুদ ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং নানারকম রসালো গল্প বলে তিনি আমাদের অনেক সময় মাতিয়ে রাখতেন। ছাইওয়ার কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিকে আমরা যে বিষয়টার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলাম সেটা হলো কি পরিস্থিতিতে, কি কারণে, কাদের নেতৃত্বে বাঙালীরা তাদের যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে? ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি বাঙালীদের হাতে। তাদের ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে যে আন্দোলন তারা করেছিল সেটা ছিল অহিংস ও শান্তিপূর্ণ, সাংবিধানিক আন্দোলন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী ব্যাপক গণআন্দোলনের মধ্যেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জেডএ ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য শেষপর্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন বাঙালীদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহযোগী নেতৃবৃন্দ। ছাইওয়ারের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে কথাটা সুস্পষ্টভাবে এবং যুক্তিপূর্ণভাবে বলার চেষ্টা করা হয় যেÑ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের নেতৃত্ব গ্রহণের সাংবিধানিকভাবে সুস্পষ্ট অধিকার অর্জন করার পরও, আলোচনার দ্বার খোলা রেখেছিলেন। লক্ষ্য ছিল যাতে সমস্যা কিছু থাকলেও শান্তিপূর্ণভাবে সেটা সমাধান করা সম্ভব। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েও ভুট্টো অসাংবিধানিক, অবাস্তব এবং সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য কিছু কথাবার্তা বলে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুললেন যা প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের জন্য হয়ে উঠল সাপেবর। এর ফলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী সিভিল-মিলিটারি আমলা চক্রের জন্য ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ফলে শীর্ষ ক্ষমতার আসন হারাবার যে ভয় ও শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল সেই কালো মেঘ দূরীভূত হয়ে গেল। একই সুরে কথা বলতে শুরু করল পাকিস্তানে শুরু থেকে ক্ষমতার আসন দখলকারী সব গোষ্ঠী। তারা ভুলে গেল তাদের সব অতীত আন্তঃগোষ্ঠী এবং আন্তঃদলীয় ভেদাভেদ। পিপলস পার্টির জেডএ ভুট্টোসহ প্রায় সবাই শরিক হলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব বাঙালীর বিশেষ করে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সব লোককে ভারতের চর ও দালাল বলে অভিহিত করে নির্মূল করে দিতে। আকাশ বাণী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ান রেডিও, কানাডা রেডিও, ডয়সে ভেলি এবং ভারতীয়, ব্রিটিশ ও আমেরিকান প্রিন্ট মিডিয়া বিশেষ করে সাপ্তাহিক টাইম, নিউইয়র্ক প্রভৃতি গণমাধ্যমের সহায়তায় উপরোক্ত বক্তব্যগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করার চেষ্টা করা হয় প্রায় দুমাস ধরে। ফলে কয়েকটা মুসলিম রাষ্ট্র ও চীন ছাড়া বিশ্বব্যাপী জনমত আস্তে আস্তে আমাদের পক্ষে আসা শুরু হয়। পাকিস্তান অনেকটা একঘরে হয়ে পড়ে বিশ্ব দরবারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা, মহিলা নির্যাতন, শিশু হত্যা এবং আগুন দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ও হাটবাজার পুড়িয়ে দেয়ার মর্মান্তিক ও জঘন্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল দিনের পর দিন। তা থেকে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড়ও বহিঃপ্রকাশ ও ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছিল প্রতিদিন। বড় বড় শহরে সংঘটিত হচ্ছিল প্রতিবাদ সভা ও নিন্দা জ্ঞাপন। আকাশবাণী, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার মতো রেডিওর মাধ্যমে এসব খবর দেশের গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে যেত সঙ্গে সঙ্গে। গ্রাম-গঞ্জ থেকে যুবকরা প্রতিদিনই ভারতীয় বর্ডার অতিক্রম করে চলে আসত পশ্চিমবাংলার বর্ডার এলাকায় প্রতিষ্ঠিত ক্যাম্পে এবং যোগ দিত অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এদিকে বিশ্ব জনমত এতটাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যেতে থাকে যে, পাকিস্তান তখন বাধ্য হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন আনতে। তারা একজন পূর্ব পাকিস্তানী এবং তথাকথিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ডাঃ মালেককে নিয়োগ দেয় গবর্নর হিসেবে। অন্য কয়েকজন মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামী নেতাদের নিয়ে প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে সবকিছু স্বাভাবিক। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল ও নেতারাই এখন শাসনভার পরিচালনা করছে। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল সত্যিকারভাবেই একটা ‘আইওয়াশ’ এবং এটাকে কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য করানো সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। এদিকে আমরাও ছাইওয়ারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানীদের লোক দেখানো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের আসল চেহারাটা তুলে ধরার জন্য বেশ কয়েকটা পদক্ষেপ নিয়েছিলাম; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ওয়াশিংটন, লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, টোকিও প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সদ্য বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। বাংলাদেশী কূটনীতিক এবং স্থানীয় বাঙালী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গদের সমন্বিতভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করে এবং নবনিযুক্ত মন্ত্রিসভার সদস্যদের প্রকৃত অবস্থানের বিষয়টি সম্পর্কে সমাবেশ ও আলোচনা সভা করে স্থানীয় সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এছাড়া দেশের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা পদ্ধতিতে তৎপরতা বৃদ্ধি করে সাধারণভাবে একটা অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয়া। এ ব্যাপারে নবনিযুক্ত মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করছে এমনসব বাঙালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের টার্গেট করে অপারেশন পরিচালনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়। সম্ভবত ঐ সময়েই গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গবর্নর কুখ্যাত মোনেম খানকে হত্যা করে। উল্লেখ্য, বিদেশ থেকে এবং দেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া তথ্যে মোটামুটিভাবে জানা গিয়েছিল যে আমাদের এই সমস্ত উদ্যোগ বেশ কার্যকরী হয়েছিল। অপরদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতায় হানাদার পাকবাহিনীর অফিসার ও জোয়ানদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল বিশেষ করে জুন মাসের শুরু থেকে। এদিকে পাকিস্তানীদের মৃতদেহগুলো এবং মারাত্মকভাবে আহত ব্যক্তিদেরকে বিমানে পাঠানো হচ্ছিল পাকিস্তানে। তাই সেখানে পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাপক অসন্তুষ্টি। এ ছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ হবার সম্ভাবনাও হয়েছিল বলে খবর পাওয়া যাচ্ছিল বিভিন্ন সূত্রে। সম্ভবত এই কারণেই তখন অধিক বেতনের চাকরি দেয়া হবে এবং আরও অনেক প্রলোভন দেখিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ করে উর্দু ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে যুবকদের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ দিয়ে আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটিতে নিয়োগ দিতে গ্রামাঞ্চলে এবং থানা সদরে পাঠানো হয়। লক্ষ্য ঐসব অঞ্চলে সেনাবাহিনীর মতো নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি হ্রাস করা। তবে এ ব্যাপারেও আমাদের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সক্রিয়ভাবে কর্মরত সদস্যদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে এবং সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যদের স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং অন্যান্য সাধারণ জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে প্রতিহত করার যে কার্যক্রম গ্রহণের উপদেশ দেয়া হয়েছিল; সেটা সেক্টর কমান্ডাররা কার্যকারীভাবে বাস্তবায়িত করার ফলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরে জানা যায়। লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন
×