ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

মাইনুল ইসলাম মানিক

চলে গেলেন প্রতিকবিতার সম্রাট নিকানো পাররা

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

চলে গেলেন প্রতিকবিতার সম্রাট নিকানো পাররা

‘আমি পদার্থবিদ্যা পড়াই জীবিকা অর্জনের জন্যে, কিন্তু কবিতা লিখি বেঁচে থাকার জন্যে’- ১৯৬৮ সালে নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন চিলিয়ান কবি নিকানো পাররা। গণিত ও পদার্থবিদ্যার মাঠে দুরন্ত গতিতে চষে বেড়ানো পাররা কবিতার মাঠেও ফলিয়েছেন সোনা। গত ২৩ জানুয়ারী ১০৩ বছর বয়সে দেহজ জীবনের ইতি টেনেছেন তিনি। কিন্তু কবিতার জগতে তিনি বেঁচে থাকবেন বহুকালÑ একথা তাঁর ঘোর বিরোধীও অকপটে স্বীকার করবেন। পাররা নিজেকে প্রতিকবি এবং তাঁর কবিতাকে প্রতিকবিতা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর কবিতা ছিল প্রত্যক্ষ ও দৈনন্দিনের কথ্য ভাষায়। কবিতাকে তিনি কৌতুকপূর্ণ, বিদ্রুপাত্মক ও হাস্যরসধর্মী হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে এক ব্যতিক্রমী সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা করেন। কবিতা নিয়ে নিকানো পাররার এই সাহিত্য আন্দোলন পরবর্তীতে প্রতিকবিতা আন্দোলন হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। আপাদমস্তক পদার্থ ও গণিতবিদ হিসেবে পরিচিত পাররা ১৯৫৪ সালে ‘পোয়েমস অ্যান্ড অ্যান্টি পোয়েমস’ প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। বইটিতে তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় হাস্যরসের মাধ্যমে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অসঙ্গতিসমূহ তুলে ধরেন। বর্ণনার মাধ্যম হিসেবে অনেকগুলো কবিতায় তিনি গতানুগতিক ভাষা এমনকি কোথাও কোথাও গালিও ব্যবহার করেছেন। তিনি বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের ঘোর বিরোধী ছিলেন। প্রতিকবিতার মাধ্যম হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন ‘হাসি ও কান্না’র কৌশল। প্রতিকবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেন,‘যখন কবিতায় ব্যাঙ্গবিদ্রুপ থাকবে, বক্রোক্তি থাকবে, পরিহাস থাকবে; কবি যখন নিজেকে নিয়ে, মানবতাকে নিয়ে হাস্যরস করবেন; যখন তার কবিতা গীতিময়তার পরিবর্তে একটি গল্প হয়ে উঠবে সেটিই প্রতিকবিতা। কবিতায় হাস্যরসের ব্যবহার নিয়ে তিনি বলেন,‘মনে রাখবেন, যখন আপনি হাস্যরসের মাধ্যমে পাঠকের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হবেন, তখন আপনি আপনার বন্দুকের খুব কাছাকাছি চলে গেছেন।’ পাবলো নেরুদার পর পাররাকেই চিলির সবচেয়ে শক্তিমান কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিকানো পাররা সম্পর্কে মাতিয়াস রিভা বলেন,‘পাররা লাতিন কবিতার মেদ কমিয়ে একটি প্রাঞ্জল কবিতাশৈলী তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি কবিগণকে অলম্পিয়াস থেকে মাটিতে নামিয়ে আনতে চেয়েছেন।’ পাররার কবিতার সমালোচকের সমালোচকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। অনেকের মতে, পাররা‘র কবিতা শিল্প ও নৈতিকতা বর্জিত আবর্জনা। কেউ কেউ তাঁর কবিতাকে করুণার যোগ্য, বমিযোগ্যও বলেছেন। তাঁর নিজের ভ্রাতুস্পুত্র বলেছিলেন,‘এই লোকটি হতে আমার পাবার কিছুই নেই।’ পাররা মার্কিন সা¤্রাজ্যে পড়াশোনা করলেও চিন্তন ও মননে প্রবলভাবে মার্কিন সা¤্রাজ্যের বিরোধিতা পোষণ করতেন। সেজন্যেই হয়তো তিনি চারবার নোবেল পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হলেও এ পুরস্কার তাঁর হাতে ওঠেনি। নিকানো পাররা ১৯১৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। তাঁর পুরো পরিবার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা ছিল। তার বোন ভায়োলেতা পাররা এবং ভাই রবার্তো পাররা চিলির নামকরা সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। পাররা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কসমোলজিতে পড়াশোনা শেষ করে সান্তিয়াগোতে ফিরে আসেন এবং এখানে যথেষ্ট সুনামের সাথেই দশকের পর দশক পদার্থবিদ্যায় পাঠদান করেন এবং কবিতায় আত্মনিয়োগ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বদেশেই বসবাস করেন পাররা। পাররা’র সাহিত্য জীবন নিয়ে মূল্যায়ণ করতে গিয়ে রবার্তো বোলানো বলেন,‘আমি যতদূর জানি, শুধুমাত্র মারিও সান্তিয়াগো (পাররা) তাঁর কবিতা পাঠর জন্যে একটি রসময় প্রাঞ্জল ভাষা তৈরী করতে পেরেছেন। আমরা অবশিষ্ট সবাই শুধুমাত্র অন্ধকার কক্ষপথে এক উল্কার ছুটে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছি। পাররা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে অসংখ্য ভাষায়। আলোচক-সমালোচকরা যা-ই বলুন না কেন, একথা হলফ করেই বলা যায়, পাররা কবিতাপ্রেমীদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন অনেক দিন তাঁর অসামান্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
×