ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর বনশ্রী ও বাসাবোর ঘটনা

ডিপিডিসির বিদ্যুত চুরি ॥ তদন্তে ১২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ডিপিডিসির বিদ্যুত চুরি ॥ তদন্তে ১২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত

রশিদ মামুন ॥ ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) বনশ্রী শাখায় বিদ্যুত চুরির সঙ্গে ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। ঘুষ দিয়ে বিদ্যুত বিল কম দেয়া ৩০০ গ্রাহকের কাছ থেকে আবারও বিল আদায় করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৪৫ গ্রাহকের কাছ থেকে ১১ লাখ ৭৪ হাজার ১৩১ ইউনিট চুরি যাওয়া বিদ্যুতের বিল আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে ডিপিডিসি। তিন বছর ধরেই এই চুরির ঘটনা ঘটছিল বলে মনে করছে তদন্ত কমিটি। তদন্তে শুধু নিচের দিকের কর্মীদের দায়ী করায় উর্ধতনরা এই চুরির দায় এড়াতে পারেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি রাজধানীর বনশ্রী এবং বাসাবোতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুত চুরির ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল ১০ লাখ ইউনিটের বেশি বিদ্যুত চুরি হয়েছে। তদন্ত কমিটি সন্দেহজনক ৫৫৬ জন গ্রাহকের ৭৭০ বিলিং মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৪৮৮ ইউনিট বিদ্যুত চুরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ডিপিডিসি প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) সারোয়ারে কায়নাতে মোঃ নূর এবং ডিপিডিসির আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তা মোঃ রবিউল হাসানের নেতৃত্বে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বুধবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যে তদন্ত রিপোর্ট তারা হাতে পেয়েছেন। অভিযুক্ত সকলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে যেসব গ্রাহক কারচুপির সঙ্গে জড়িত তাদের নতুন করে বিলও দিতে হবে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বিদ্যুত আইনে বিদ্যুত চুরির জন্য গ্রাহকের আর্থিক জরিমানার পাশাপাশি কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। যদিও এখনও ওই আইনের প্রয়োগ শুরু হয়নি। গ্রাহকের মিটার রিডিং ডিপিডিসির সার্ভারে কম দেখিয়ে গত তিন বছর ধরে এই চুরির ঘটনা ঘটে আসছিল। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১১ ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে বিদ্যুত চুরির সঙ্গে জড়িত এরা হলেন, ডিপিডিসির বনশ্রীর লাইনম্যান মেট মীর কালাম হোসেন, উপসহকারী প্রকৌশলী সোহেল রানা, মিটার রিডিং কালেক্টর অমল সরকার, তৌহিদুর রহমান বাবু, নিজামুল হক, অলক শেঠ, মতিউর রহমান, সাইফুল ইসলাম, আনসারুল হক, তৌফিক আলম। এছাড়া ডিপিডিসির বিলি করার সঙ্গে সম্পৃক্ত মেসার্স মুন্সি ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট সিএনএস ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানও এই চুরির জন্য দায়ী বলে মনে করছে তদন্ত কমিটি। ডিপিডিসির একজন কর্মকর্তা জানান, এভাবে বছরের পর বছর ধরে বিদ্যুত চুরির ঘটনা ঘটলে সেখানকার উর্ধতন ব্যক্তিরা কি করেন বা না করেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এখানে মাঠ পর্যায়ের কয়েকজনকে শাস্তির আওতায় এনে বাকিদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ওই কর্মকর্তা। ডিপিডিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বনশ্রীতে বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী যাওয়ার পর এই চুরির ঘটনা উদ্ঘাটন হয়। এর আগে যে নির্বাহী প্রকৌশলী দায়িত্বে ছিলেন তাকে কেন তদন্তে দায়ী করা হলো না জানতে চাইলে বলেন, সাধারণত অফিসের নির্বাহীরা নানা কাজে বেশি ব্যস্ত থাকে এখানে যারা সরাসারি বিলিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের দায়ী করা হয়েছে। ডিপিডিসির একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের বিতরণ কোম্পানিটি ৩৬টি ডিভিশনের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জের কিছু এলাকায় বিদ্যুত বিক্রি করে। প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে এ ধরনের দুর্নীতির ঘটনা ঘটতে পারে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রাহকের কাছে বিক্রি হওয়া বিদ্যুতের বিল আদায়ে চাপ থাকায় লাখ লাখ ইউনিট বিদ্যুত চুরির পরও বিল ঠিক ঠাক আদায় হওয়ার কোন উপায় থাকার কথা নয়। এখানে যেসব গ্রাহক টাকা দিয়ে দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করছে তাদের বিল কম আসছে। আর যেসব গ্রাহক এ ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে না তাদের বিল একটু একটু করে বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে মোট বিল আদায় ঠিক রেখেই চুরির পথ খোলা রাখা হচ্ছে। তদন্ত কমিটি তাদের সুপারিশে বলছে ইউজার আইডি এবং পাসওয়ার্ড কোনক্রমেই হস্তান্তর যোগ্য না হলেও অনেকেই তা হস্তান্তর করছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশে দেখা যায় নানাভাবে প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশ করে এই বিল কমানো বাড়ানো হচ্ছে। এসব পথ বন্ধ করার কথাও বলা হচ্ছে। ডিপিডিসি বলছে, চলতি মাসের শুরুর দিকে জালিয়াতির প্রাথমিক প্রমাণ মেলায় বনশ্রী শাখার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ সোহেল রানা এবং লাইনম্যান মীর কামাল হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। লাইনম্যান হলেও কামাল হোসেন উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের দায়িত্ব পালন করতেন। অভিযুক্ত কামাল হোসেন ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজে যোগ দেয়ার জন্য এর আগে পরীক্ষা দিয়েও উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তারপরও ডিপিডিসির উর্ধতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই এই লাইনম্যান ডাটা এন্ট্রির কাজ করে আসছিল। নিয়ম অনুযায়ী সার্ভারের পাসওয়ার্ড থাকে উপ-সহকারী প্রকৌশলীর কাছে। বিল সংশোধনসহ অন্যান্য কাজে সার্ভার খুলতে পাসওয়ার্ড দরকার হয়। পাসওয়ার্ড হস্তান্তর যোগ্য না হলেও সোহলে রানা কামালকে সেই পাসওয়ার্ড দিয়ে দেন। যা কোন ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে তদন্ত কমিটি উল্লেখ করেছে।
×