ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অরাজকতার ইন্ধন ॥ পুলিশের ওপর হামলা পূর্ব পরিকল্পিত

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অরাজকতার ইন্ধন ॥ পুলিশের ওপর হামলা পূর্ব পরিকল্পিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পুলিশের ওপর হামলা, প্রিজনভ্যান ভেঙ্গে বিএনপির দুই নেতাকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের পূর্ব পরিকল্পনার অংশ। খালেদা জিয়ার সাজা হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে এমন আভাস দিতেই পরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে বিএনপি-জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা। যা পরোক্ষভাবে আদালতকেও হুমকি দেয়ার শামিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে পরিকল্পিতভাবে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার ইন্ধন দিতেই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে বিএনপি-জামায়াত-শিবির। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বিএনপি নেতাকর্মীরা আগ থেকেই পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা করে। তারই অংশ হিসেবে ইতোপূর্বে একই মামলায় হাজিরা শেষে ফেরার পথে তিন-তিনবার তা-ব চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা। মঙ্গলবারের ঘটনার পর কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। খোদ রাজধানীতে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। এমন ঘটনায় রমনা ও শাহবাগ মডেল থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপির আট শ’ নেতাকর্মীকে। তিন মামলায়ই আসামি করা হয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে। এদিকে বুধবার রাতে রাজধানীর মগবাজার থেকে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আজিজুল বারী হেলালসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা শেষে ফেরার পথে হাইকোর্টের সামনে পুলিশের ওপর হামলা চালায় বিএনপি নেতাকর্মীরা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবারের ঘটনাটি পুরোপুরি পরিকল্পিত। তারা দীর্ঘদিন ধরেই পুলিশের সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে ঝামেলা করার চেষ্টা করছে; যাতে তারা পুলিশের সঙ্গে বড় ধরনের সংঘর্ষে জড়াতে পারে। তারই অংশ হিসেবে একই মামলায় খালেদা জিয়ার হাজিরা শেষে ফেরার পথে পথ বন্ধ করে মিছিল করে বিএনপি নেতাকর্মীরা। বাধা দিতে গেলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ইতোপূর্বে পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিএনপি নেতাকর্মীরা তিন-তিনবার ব্যাপক তা-ব চালিয়েছে। পরবর্তীতে তদন্তে দেখা গেছে, যা ছিল একেবারেই পরিকল্পিত। ওসব ঘটনায় একাধিক মামলাও হয়েছে। মামলার অনেক আসামি গ্রেফতার হয়েছে। তারপরও তারা পূর্ব পরিকল্পনা থেকে সরে যায়নি। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মঙ্গলবারও তারা হাইকোর্টের সামনে জড়ো হয়। সকাল থেকেই তারা পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা করে। অনেকটা পায়ে পা দিয়ে পুলিশের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ায়। পুলিশ বাধ্য হয়ে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক ছাত্রনেতা সোহাগ মজুমদার (৩৮) ও ওবায়দুল হক মিলনকে (৪০) আটক করে। তাদের রাখা হয়েছিল প্রিজনভ্যানে। খালেদা জিয়া চলে যাওয়ার পর তাদের স্বাভাবিকভাবেই ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্ত তার আগেই বিএনপি নেতাকর্মীরা পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পুলিশের ওপর হামলা করে। এসব এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তাতে দেখা গেছে, পুলিশ হাইকোর্টের গেটে ছিল। সেখানে বিএনপি নেতাকর্মীরাও ছিল। প্রিজনভ্যান থেকে দুই নেতা অন্যদের ডাক দেয়ার পর পরই বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে পুলিশকে পেটাতে থাকে। পুলিশও এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। আর তখনই শুরু হয় পরিকল্পিত তা-ব। হামলাকারীরা পুলিশকে মারধর করে। প্রিজনভ্যান ভেঙ্গে ফেলে। পুলিশের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কেড়ে নিয়ে তা ভেঙ্গে ফেলে। হামলায় কয়েক পুলিশ সদস্য আহত হন। তার মধ্যে দুজন গুরুতর আহত হন। তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হয়েছে। ছিনিয়ে নেয়া নেতারা শত শত নেতাকর্মীর সঙ্গে মিশে যায়। এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জনকণ্ঠকে বলেন, খালেদা জিয়ার হাজিরা উপলক্ষে সকাল থেকেই পুলিশ সতর্ক ছিল। আগ থেকেই জড়ো হওয়া নেতাকর্মীরা ইচ্ছাকৃতভাবে পুলিশের সঙ্গে আগের কয়েকবারের মতো ঝামেলা করার চেষ্টা করেছে। পরবর্তীতে বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলার ধরন দেখে মনে হয়েছে, হামলা ছিল পরিকল্পিত। পুলিশ কাউকে আটক না করলেও বিএনপি নেতাকর্মীরা পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পুলিশের ওপর হামলা চালাত। হামলার ঘটনায় মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে শাহবাগ ও রমনা মডেল থানায় মোট ৩টি মামলা হয়েছে। তিন মামলায়ই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতসহ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা অন্তত আট শ’। জানা গেছে, শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রহিদুল ইসলাম ও এসআই চম্পক বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় ৫৭ ও ৫৮ নম্বর পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। আর রমনা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরও একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। দায়েরকৃত মামলায় হামলার নির্দেশদাতা হিসেবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতসহ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ওই হামলায় মঙ্গলবার রাতেই পুলিশ ও ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৬৯ জনকে আটক করে। পরবর্তীতে আরও কয়েকজনকে আটক করে। সব মিলিয়ে অন্তত ৭৫ জন আটক হয়েছে। আটকদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে মামলাগুলোতে। এর মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে মঙ্গলবার রাত দশটার দিকে গুলশান থেকে এবং মঙ্গলবার রাত বারোটার দিকে শান্তিনগর থেকে জাতীয় নির্বাহী কমিটির খুলনা বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলামকে আটক করে ডিবি পুলিশ। প্রসঙ্গত, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার শুনানি শেষে খালেদা জিয়া আদালত থেকে ফেরার পথে গত দুই মাসে এ নিয়ে চার দফায় তা-ব চালাল বিএনপি-জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা। এর আগে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার একই মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার সময় মারাত্মক তা-ব চালিয়ে হাইকোর্ট, বক্সীবাজার, দোয়েলচত্বর, প্রেসক্লাবসহ আশপাশের এলাকায় রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত করেছিল বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। ওই দিন নেতাকর্মীরা বহু যানবাহন ভাংচুর করেছিল। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। তাতে অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছিলেন। পুলিশ ২৬ জনকে আটক করেছিল। এমন তা-বে রীতিমতো বিপাকে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সেগুনবাগিচা বারডেম-২ হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া রোগী ও তাদের স্বজনরা। তা-বের সময় মানুষ প্রাণভয়ে দোকানপাট, প্রিয় গাড়িসহ অন্যান্য সামগ্রী ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওই দিনের তা-ব বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের ২০১৪ ও ২০১৫ সালের তা-বের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। ৩৬ নেতাকর্মী রিমা-ে ॥ কোর্ট রিপোর্টার জানান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। একই মামলায় আরও ৩৬ জনকে রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া চকবাজার থানার বিএনপি নেতা শফিক উদ্দিন আহম্মেদ জুয়েলের রিমান্ড ও জামিন দুটোরই আবেদন নামঞ্জুর করে একদিনের মধ্যে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর হাকিম মাহমুদুল হাসান এ আদেশ দেন। রিমান্ডে নেয়া আসামিরা হলেনÑ বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, মহিলা দলের সাবেক সভাপতি পেয়ারা সোস্তফা, মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেহানা সুলতানা আরজু কেন্দ্রীয় মহিলা দলের নেত্রী শারমিন আক্তার মুন্নি, চকুয়া থানা বিএনপির সদস্য মোঃ মোজাম্মেল হক লিটন, মোঃ আলম, মোঃ ইমরান মিয়া, শেরে বাংলা নগর থানার ২৮নং ওয়ার্ডের ছাত্রদলের সদস্য সালাহ উদ্দিন, রামপুরা থানার কৃষক দলের সভাপতি আসাদুজ্জামান আরিশ, তুরাগ থানার বিএনপির কর্মী মোঃ কবির হোসেন, মোঃ খোকন সরকার, ছাত্রদল সদস্য মোঃ ইমরান হোসেন, শ্রমিক দল সদস্য রফিকুল ইসলাম মনু, ছাত্রদল সদস্য মোঃ ফাইজুল ইসলাম নোমান, বিএনপি কর্মী মোঃ শরিফ, ভা-ারিয়া থানা বিএনপির সদস্য, সাইফুল হক, পল্টন থানা বিএনপি নেতা গাজী হাবিব হাসান, পল্লবী থানা বিএনপি নেতা মোঃ সাইদুর রহমান, উত্তরা পূর্ব থানার বিএনপির সহ-সভাপতি মোঃ শাহ আলম, চকবাজার থানার বিএনপির নেতা মোঃ আব্দুল্লাহ নূর, ফরিদগঞ্জ থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ইসমাইল তালুকদার খোকন, কামরাঙ্গীরচর থানার শ্রমিক দলের আহ্বয়ক মোঃ জসিম মিয়া, শ্রমিক নেতা আমজাদ হোসেন, কামরাঙ্গীচর থানা শ্রমিক দলের সদস্য মোঃ আলম মিয়া, রাজনগর উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক মোঃ রুবেল আহমেদ, ঢাকা মহানগর ছাত্রদল পশ্চিমের সদস্য মোঃ মান্না, উত্তরা পূর্ব থানার বিএনপির সদস্য মোঃ মাহবুব খান, উত্তরা পূর্ব থানার শ্রমিক দলের সদস্য মোঃ সুজন মিয়া, বংশাল থানা ছাত্রদল নেতা সৈকত রহমান, চকবাজার থানা বিএনপি নেতা ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জুয়েল, ছাত্রদল কর্মী মোঃ নাঈম হোসেন, চকুয়া থানা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি মোঃ বোরহান উদ্দিন, ছাত্রদল সদস্য নুবয়াত আল মাহামুদ ইনু, চকুয়া থানা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আজিজ আহমেদ ও ওয়ারী থানা বিএনপি কর্মী মীর মাহামুদুর রহমান। এদের মধ্যে অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের তিনদিন এবং অপর আসামিদের দুইদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) রফিকুল ইসলাম আসামি গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। আর অপর আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন ও সালমা হাই টুনি দশদিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে শুনানি করেন।
×