ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক জহুরুল আলম

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন্ পথে...

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন্ পথে...

বর্তমান রোহিঙ্গা ইস্যুটি তৈরি হওয়ারও বহু পূর্বে ২০১২ সালে আউং সান সুচি বলেছিলেন যে তিনি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা যায় কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন। বিষয়টির অবতারণা এ জন্যই যে এ থেকেই রোহিঙ্গাদের প্রতি সুচি সরকারের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে। এ ছাড়া এটিও পরিষ্কার হয় যে, রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন ও তাদের নিজভূমি থেকে বিতারণ একটি পূর্ব পরিকল্পিত বিষয়। এটাকে কেবলমাত্র মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা ভুল। রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় এবং এ বিষয়ে মিয়ানমারের নেত্রী সুচির ভূমিকা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। যে কোন দেশের জন্যই অতীব লজ্জার বিষয় হচ্ছে সে দেশের সরকারের পক্ষে দেশের জনগণের যে কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকে ও নিজ ভূমিতে নিরাপদে বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টি করতে বিফল হওয়া। আর তার চেয়েও লজ্জার ও ধিক্কারের বিষয় হচ্ছেÑ তাদের বিতাড়িত হওয়া। আর এটি যদি রাষ্ট্রের নীতিগত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বিষয় হয় তাহলে সেটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের পরিচায়ক, কারণ সেক্ষেত্রে সেই রাষ্ট্রটি কেবলমাত্র তার নাগরিকদের ন্যূনতম নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়নি বরং নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তিকে লেলিয়ে দিয়ে চরমতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে লিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি বাঙালীর ভারতে আশ্রয় গ্রহণ ছিল ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের ধ্বংস হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে একটি। ঠিক তেমনিভাবে হিটলার নিজ দেশ জার্মানির ইহুদী নাগরিকদের নির্মূল করার লক্ষ্যে ষাট লাখ ইহুদীকে হত্যা করেছে এবং আরও সমপরিমাণ দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। শেষাবধি পরাজিত হয়েছে হিটলার, ইয়াহিয়া, টিক্কা খানেরা। কিন্তু শোষকেরা কখনও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। তাই সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারীর খড়গ নেমে আসে বার বার। আর মানুষ সংগ্রাম করে তার অধিকারকে ঠিকই ছিনিয়ে নিয়ে আসে শেষাবধি। রোহিঙ্গাদের গণ্য করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর একটি হিসেবে। মিয়ানমারে তাদের বসবাস হাজার বছরের। তাদের নিজস্ব ভাষা আছে, আছে নিজস্ব সংস্কৃতিও আছে। একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব সে রাষ্ট্রের সকল জনগোষ্ঠীর সেই স্বকীয়তাকে সম্মান করা। দুঃখের বিষয়, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে তা করতে শুধু ব্যর্থই হয়নি, বরং এই ভিন্নতার জন্য তাদের নিজ দেশে বসবাসের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করছে। এমন কি ১৯৮২ সাল থেকে তাদের মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর বাইরে রাখা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। এবং তখন থেকেই তাদের সে দেশের নাগরিকের মর্যাদাও দেয়া হচ্ছে না। ফলত তারা এখন আইনত রাষ্ট্রহীন একটি জাতি, যেমন ছিল ফিলিস্তিনীরা যুগ যুগ ধরে। মিয়ানমারের সরকারগুলোর একটিও শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ কোন নাগরিক সুযোগ-সুবিধাই এদের জন্য রাখেনি। ঐতিহাসিকভাবেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর পূর্বে, অর্থাৎ একাদশ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে এরা এখানে বসবাস করতে শুরু করে। ঠিক যেমনভাবে আমাদের দেশেও অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উৎপত্তি হয়েছে। আমরা সবাই যেমনভাবে বাংলাদেশের সম্মানিত নাগরিক, ঠিক তেমনিভাবেই রোহিঙ্গারাও তাদের দেশ মিয়ানমারের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে গণ্য হওয়ার অধিকার রাখে। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশরা বার্মাকে নিজেদের উপনিবেশভুক্ত করে এবং সেখানে ১২৪ বছর তাদের শাসন চালিয়ে ১৯৪৮ সালে বিদায় নেয়। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মতই এটিও ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার একটি প্রদেশের মর্যাদা পায় এবং সে সময় বেশকিছু কর্মজীবী মানুষ ভারতবর্ষ থেকে বার্মায় স্থানান্তরিত হয়। এ ধরনের স্থানান্তরকে একটি দেশের আভ্যন্তরীণ স্থানান্তর হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ তৎকালীন বার্মা ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতার পর বর্মী সরকারগুলো এই স্থানান্তরকে কোন কারণ ছাড়াই বেআইনী ঘোষণা করে এবং স্থানান্তরিত এই জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব বাতিল করে বা তা দিতে অস্বীকার করে। হাজার বছরের ইতিহাস নিয়েও এভাবেই রোহিঙ্গারা নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে যায়। সে অঞ্চলে বসবাসকারী বৌদ্ধরা এদের বাঙালী বলে অভিহিত করতে থাকে। সকলেই লক্ষ্য করে থাকবেন, মিয়ানমারের নেত্রী সুচিও এই জনগোষ্ঠীকে কখনই কোন বক্তব্যে রোহিঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করেননি। এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। কারণ এর উপর ভিত্তি করেই এই জনগোষ্ঠীটিকে সে দেশের নাগরিকের মর্যাদা দেয়ার বিষয়টি জড়িত। মিয়ানমারকে অবশ্যই এদের রাখাইন প্রদেশের বাসিন্দা হিসাবে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মর্যাদা দিতে হবে। এটাই হওয়া উচিত রোহিঙ্গাবিষয়ক যে কোন ইতিবাচক পদক্ষেপের মৌলিক বিষয়। রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমারের বহু আগের সৃষ্ট বিষয় হলেও বাংলাদেশের জনগণকে এর মাসুল দিতে হচ্ছে বহুকাল ধরে। জিয়ার আমলে এই ইস্যুটিকে বাংলাদেশের সামরিক জান্তা ব্যবহার করেছে তাদের পাকিস্তানী তাঁবেদারি বাস্তবায়নের জন্য এবং সেই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংসতা জিইয়ে রেখে সেনাবাহিনীর একটি অংশকে সেখানে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত করে নিউট্রালাইজ করে রাখার কাজে। মিয়ানমার থেকে বর্তমান রোহিঙ্গা বহির্গমনের ¯্রােতধারা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জাতিসংঘ এটাকে পৃথিবীর মধ্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে মারাত্মক রিফিউজি সঙ্কট বলে অভিহিত করেছে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই তৎকালীন বার্মা সরকার একটি নাগরিকত্ব আইন করে যা টহরড়হ ঈরঃরুবহংযরঢ় অপঃ নামে পরিচিত। এই আইনের আওতায় রোহিঙ্গা ছাড়া বার্মায় বসবাসকারী অন্য সকল ছোট জাতিগোষ্ঠীর জন্য বার্মার নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার সংরক্ষিত করা হয়। অবশ্য আইনে এটিও উল্লেখ করা হয় যে, কেউ যদি দুই বা ততধিক বংশ বা প্রজন্ম সেখানে বসবাস করে তবে তার বা তাদের পরিচয়পত্র দেয়া যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের প্রথমিকভাবে এ ধরনের পরিচয়পত্র দেয়া হয়। এমন কি বার্মার পার্লামেন্টেও রোহিঙ্গারা প্রতিনিধিত্ব করে সে সময়। কাজেই এখন এই জনগোষ্ঠীকে হঠাৎ করে বিদেশী বা বহিরাগত বলার কোন অবকাশ থাকতে পারে না। এর পেছনে যে সুপ্ত উদ্দেশ্য আছে তা বড়ই অমানবিক ও অশালীন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক ইতিহাস। আর এ ইতিহাসের আরও মর্মন্তুদ অধ্যায়টি রচিত হচ্ছে এমন একজনের শাসনামলে যিনি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। একটি জাতির একটি অংশকে যখন অত্যাচার, অবিচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে দেশ ছাড়া করা হচ্ছে তখন যদি শান্তির তথাকথিত অগ্রদূতের ভূমিকা হয় সে কাজের নীরব সমর্থন, তাহলে সে শান্তির সম্মানের মর্যাদা কোথায় লুটায়! ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন সমস্যার জন্ম দেয়। বার্মার সকল নাগরিককে জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও রোহিঙ্গাদের বিদেশী হিসাবে পরিচয়পত্র দেয়া হয়। এর ফলে এই জনগোষ্ঠী সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে, বিশেষত কর্মসংস্থান, আয় ও শিক্ষার ক্ষেত্রে এরা পিছিয়ে পড়তে থাকে এবং পৃথিবীর দরিদ্রতম একটি দেশের সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সম্পূর্ণভাবেই রোহিঙ্গাদের একটি রাষ্ট্রহীন জাতিতে পরিণত করল। রোহিঙ্গাদের পূর্বের মতোই মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর বাইরে রাখা হলো। এমন কিছু কালা কানুন করা হলো যার মাধ্যমে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীটি অধিকারহীন, রাষ্ট্রহীন, দরিদ্রতম একটি মানবসম্প্রদায়ে পরিণত হলো। ১৯৮২ সালের আইন একটি পদ্ধতির উন্মেষ ঘটায়- প্রাকৃতিক নাগরিকত্ব। এটি ছিল এমন একটি ধারা যার বলে ন্যাচারাল সিটিজেন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারত কেবলমাত্র তারাই যারা ১৯৪৮ সালের আগে থেকেই বার্মায় পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসার প্রমাণ দিতে সক্ষম। সেই সঙ্গে তাদের দেশের যে কোন একটি জাতীয় ভাষায় অনর্গল কথা বলার যোগ্যতা থাকতে হবে। এর প্রথমটি বেশ কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গার জন্য প্রযোজ্য হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসাবে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের জন্য নিজেদের ডায়ালেক্ট ছাড়া অন্য কোন ভাষা আয়ত্তে আনার কোন সুযোগ বর্মী সরকার কোনদিনও তাদের দেয়নি। ফলে প্রায় সকল রোহিঙ্গাই ন্যাচারাল সিটিজেনশিপ পাওয়ার যোগ্যতা হারায়। এই আইনের ফলে তাদের বেঁচে থাকার এবং উন্নত জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার সকল সুযোগ তারা হারায়। এমন কি যাতায়াত, বিবাহ, স্বাস্থ্যসেবা ও ধর্ম পালনের মতো নির্বিরোধী কর্মকা-ও পালন করতে তাদের বিপুল বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। হিটলারের জার্মানিতে ইহুদীদের যেভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়েছিল এটাও ছিল তেমনি আরেকটি অমানবিক অধ্যায়। সত্তরের দশকে রোঙ্গিাদের দেশত্যাগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাংলাদেশে তাদের অনুপ্রবেশ দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭৮ সালে মিলিটারি শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। কিন্তু জিয়া এটার কোন সমাধানের দিকে না গিয়ে বিষয়টি গোপন রাখে। অপরদিকে এমন অনুপ্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে একদিকে অত্যাচারিত রোহিঙ্গারা এবং অপরদিকে অত্যাচারী বর্মী শাসকরা বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশের জন্য ভাল স্থান হিসেবে বেছে নেয়। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি করার জন্য বর্মী সরকার স্থানীয় মগদের লেলিয়ে দেয়ার কৌশল গ্রহণ করে। সেই সঙ্গে রাখাইন প্রদেশে বৌদ্ধ-মগ জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য এবং রোহিঙ্গাদের জমিজমা দখল করার জন্য নানা রকম আইনী ও বেআইনী কৌশল গ্রহণ করতে থাকে। হিটলারের জার্মানিতে দ্বিতীয় যুদ্ধের প্রাক্কালে ও যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যেভাবে ইহুদী নিধন ও প্রান্তিকীকরণ প্রক্রিয়া চালানো হয়েছিল সেই একই কৌশল রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেও চালানো হতে থাকে। রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতারণের উদ্দেশে রোহিঙ্গা পল্লী ও জনপদগুলোতে খুন, ধর্ষণ চলতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগও চলতে থাকে অবিরাম। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ
×