ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বসছে দ্বিতীয় স্প্যান ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নিচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

বসছে দ্বিতীয় স্প্যান ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নিচ্ছে

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ পদ্মা সেতুর দ্বিতীয় স্প্যান ৭বি (সুপার স্ট্রাকচার) ৩৮ ও ৩৯ নং পিলারের কাছে নেয়া হয়েছে। স্থাপন প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়ে আনা হলেও সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় শনিবার স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে আজ রবিবার সকালের দিকেই এটি খুঁটির ওপর বসিয়ে দেয়া যাবে বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। দায়িত্বশীল এক প্রকৌশলী জানান, আলোর স্বল্পতা এবং সার্ভে করতে প্রকৌশলীদের সমস্যা দেখা দেয়ায় রবিবার স্প্যানটি বসানোর কাজ আবার শুরু হবে। এছাড়া স্প্যান স্থাপনের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করতে রাত ৯-১০টা বেজে যাবে ধারণায় রাত এড়াতে শনিবার বিকেল ৫টার দিকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। বর্তমানে ৩৮ ও ৩৯ নং পিলার থেকে সামান্য দূরে রাখা হয়েছে ধূসর রঙের ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ হাজার ১৪০ টন ওজনের স্প্যানটি। এর আগে স্প্যান বসানোর আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে এবারে স্প্যান বসানো নিয়ে কোন আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। কোন সংবাদকর্মীকেও সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। প্রকৌশলীরা বলেছেন, প্রথম স্প্যান বসানোর সময় আনুষ্ঠানিকতা ছিল। এখন ঘন ঘনই স্প্যান বসবে। আনুষ্ঠানিকতা আর হবে না। শনিবার সকাল থেকেই শুরু হয় স্প্যান বসানোর আনুষঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতা। এর আগে স্প্যানটি ৩৮ ও ৩৯ নং পিলারের মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে আসা হয়। পদ্মা সেতুর প্রকৌশলীরা জানান, পিলারের ওপর স্প্যান বসাতে ৩৫ নং পিলার এলাকা থেকে ৩ হাজার ৬শ’ টন ধারণ ক্ষমতার ‘তিয়ান ই’ জাহাজের ক্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হয় ৩৮ ও ৩৯ নং পিলার এলাকায়। তারা জানান, মাওয়ার বিশেষায়িত ইয়ার্ড থেকে পদ্মা সেতুর দ্বিতীয় ¯প্যানটি বের করে ভাসমান ক্রেনে তোলা হয় শনিবারেই। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পলি জমে তলদেশের গভীরতা কমে যায়, তাই আগেই ড্রেজিং করে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল ৩৬শ’ টন ওজন বহনে সক্ষম বিশ্বের সর্বাধুনিক এ ক্রেনের চলার পথ। স্প্যানটি ৩৮ নম্বর খুঁটির প্রথম স্প্যানের সঙ্গে স্থায়ীভাবে ওয়েল্ডিং করে দেয়া হবে। কিন্তু এই ওয়েল্ডিংয়ের আগে এর লোড বহনের জন্য লিফটিং ফ্রেম তৈরি করা হয়েছে। যা ১৮শ’ টন ওজন বহন করবে। কিন্তু এটি এই ওজন বহনে সক্ষম কিনা তা পরীক্ষার জন্য টেস্ট পাইল স্থাপন করা হয়। শুক্রবার অপসারণ সম্পন্ন হয়ে নৌপথটি চলাচলযোগ্য হয়। তাই শনিবার সকালেই স্প্যানবাহী জাহাজটি যথাযথ স্থান অর্থাৎ ৩৮ ও ৩৯ নম্বর খুঁটির মাঝামাঝি নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের তিন দিনব্যাপী সরেজমিন সভা শনিবার শেষ হয়েছে। এই সভায় পাঁচ বিদেশী বিশেষজ্ঞসহ ১১ জন বিশেষজ্ঞ অংশ নিচ্ছেন। সেতুটির সার্বিক পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়ে বিশেষজ্ঞরা সভা শেষ করেছেন। পদ্মা সেতুর প্রথম ¯প্যানটি বসানো হয়েছিল গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর। জাজিরা প্রান্তের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে বসানো হয় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এ ¯প্যান। এরপর প্রস্তুত করে তোলা হয় ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলারও। ইয়ার্ডে আগেই তৈরি ছিল দ্বিতীয় স্প্যান। তবে গ্রাউটিংসহ নানা কারিগরি জটিলতার কারণে ডিসেম্বর মাসে স্প্যানটি বসানোর কথা থাকলেও সেটা হয়নি। পিলারের সঙ্গে স্প্যান জোড়া লাগানোর গ্রাউটিং (সিমেন্টের মিশ্রণ) সমস্যা সমাধানে ভারতীয় প্রকৌশলীরা ব্যর্থ হলেও পরে চীনের প্রকৌশলীরা সমাধান করেন তা। এরপরই শুরু হয় স্প্যান পিলারের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, “গ্রাউটিংয়ের আমাদের নয়টি ট্রায়াল আছে। দুইটা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যার কারণে সঠিক সময়ে করা যায়নি।” প্রথম ¯প্যানটি শুধুমাত্র দুটি পিলারের মধ্য বসিয়ে দেয়া গেলেও দ্বিতীয় ¯প্যানের ক্ষেত্রে ভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এটি শুধু বসিয়ে দিলেই হবে না, একই সঙ্গে জোড়া দিতে হবে প্রথম স্প্যানের সঙ্গে। ২০ জানুয়ারি স্প্যানটি যাত্রা শুরু করলেও প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে নিয়ে এটি অপেক্ষমাণ রাখা হয় একদিন। তাছাড়া ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পিলার দু’টি স্প্যানের ভর নিতে পারবে কিনা, সেটাও স্প্যান বসানোর আগে একই পরিমাণ ভর চাপিয়ে পরীক্ষা করে নিতে হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “কোয়ালিটি আমাদের প্রথম লক্ষ্য। কোয়ালিটিতে কোন ঘাটতি রাখা যাবে না।” এ পর্যন্ত দেশের ইয়ার্ডে ১০টি স্প্যানের ফ্যাব্রিকেশনের কাজ শেষ হয়েছে এবং চীনে আরও ১৬টি স্প্যান শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। প্রতিটিতে ৬টি করে সেতুর ৪২টি পিলারে মোট ২৪০টি পাইলের মধ্যে ৯৬টির কাজ পুরো এবং ১১টির কাজ আংশিক শেষ হয়েছে। দুর্নীতির ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত জটিলতার পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এই সাহসী সিদ্ধান্ত দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়িত করে। পদ্মায় এখন আলোর ঝিলিক। শুরুতে যে পরিকল্পনা নেয়া হয়, তাতে চার বছরে অর্থাৎ ২০১৮ সালের মধ্যে সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে পিছিয়ে থাকার কথা বলা হয়েছে। গত ২০ নবেম্বর সেতু বিভাগে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা আছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের নির্ধারিত সময় শেষ হতে বাকি আর মাত্র ১৪ মাস। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার মধ্যে গত অক্টোবর পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আট মাস পিছিয়ে আছে নির্মাণ কাজ। তবে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলেছে- নদীর তলদেশের মাটির স্তরে নানা সমস্যাসহ বৈচিত্র্যময় পদ্মা সেতুতে এই অগ্রগতিও অনেক অর্জন। তবে এসব চ্যালেঞ্জ না থাকলে নির্ধারিত সময়ের আগেই সেতু জনগণের জন্য খুলে দেয়া সম্ভব হতো। কারণ এত গভীরতায় পাইল করে প্রায় ১০০ বছরের স্থায়িত্বে এই সেতু তৈরি করা হচ্ছে। যা বাঙালী বীরত্বগাঁথায় রূপান্তর হয়েছে। পদ্মা পাড়ের প্রায় তিন হাজার শ্রমিকের ব্যস্ততা এখন অবিরাম। ‘পদ্মা সেতু’ নামের একটি স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে তাদের এই ব্যস্ততা। তাদের ঘাম-ঝরানো শ্রমে গড়ে উঠছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু। শরিয়তপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, শনিবার দুপুর ১ টার দিকে স্প্যান বহনকারী ক্রেনের জাহাজটি খুঁটি থেকে মাত্র ২শ’ ফুট দূরে অবস্থান করে। এরপর নদীর নাব্য সঙ্কটের কারণে খুঁটির কাছে চাপতে ক্রেন বহনকারী জাহাজটি কিছুটা সমস্যায় পড়ে। গত ৪ দিন ধরে মাওয়া থেকে স্প্যানটি নদী পথে আনা হয়েছে। স্প্যান বসনোর কাজে দায়িত্বরত সার্ভেয়ার মীর ফারুক হোসেন সিএসসি বলেন, ৩ হাজার ৬শ’ টন ধারণক্ষমতার ভাসমান ক্রেনের জাহাজ “তিয়ান ইয়াহাও” স্প্যানটিকে পাঁজা করে ধরে খুঁটি দুটোর ওপর বসিয়ে দিবে। স্প্যানটি বসানোর আগে ওয়েট টেস্ট, বেজ প্লেট, দৈর্ঘ, পাইল পজিশন, টায়াল লোড টেস্ট, মেজারমেন্টসহ যাবতীয় আনুষঙ্গিক কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হবে। মীর ফারুক হোসেন জানান, স্প্যানটি শনিবার বসানোর কথা থাকলেও স্প্যানটি খুঁটির নিকটে পৌঁছতে পৌঁছতে দিনের আলো শেষ হয়ে গেছে। স্প্যান বসানোর পরেও অনেক কাজ থাকে যা রাতে করা সম্ভব নয় বিধায় রবিবার সকালের দিকে বসানো হবে।
×