ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবাদিকতায় নারীর দৃঢ় অবস্থান তৈরির তাগিদ

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

সাংবাদিকতায় নারীর দৃঢ় অবস্থান তৈরির তাগিদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাংবাদিকতায় নারীর দৃঢ় অবস্থান তৈরির তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না সাংবাদিকতায় নারীর একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ডিবেট ও কাউন্সিলিং চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে কিভাবে বৈচিত্র্য আনা যায় তা মনিটরিং ও গবেষণা করে দেখার ওপর জোর দেন তারা। বুধবার এমআরডিআই’এর উদ্যোগে আয়োজিত ‘জেন্ডার ইন জার্নালিজম: ইন পারসুইট অব কোয়ালিটি কনটেন্ট এন্ড সেনসিটিভিটি’ শীর্ষক সেমিনারে তুলে ধরা হয় কিভাবে লিঙ্গ সংবেদনশীলতা বজায় রেখে সংবাদ উপস্থাপন করা যায়। সেই সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরী বলে মন্তব্য করেন উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ। ইটিভির সিইও মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ও নিউজ ২৪এর বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নির সঞ্চালনায় সেমিনার দুটি উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন ও ফজো মিডিয়ার জেন্ডার উপদেষ্টা অ্যাজনেতা সোডেরবার্গ জ্যাকবসন। প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজ, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা, দৈনিক প্রথম আলোর সংবাদ উপদেষ্টা কুরাতুল আইন তাহমিনা। অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন বলেন, ‘ভাষার ক্ষেত্রে জেন্ডার সংবেদনশীলতা আমরা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। এখন আর পত্র-পত্রিকায় নারী সম্পর্কিত বিভিন্ন নেতিবাচক শব্দ প্রয়োগ করা হয় না। বিনোদন সংশ্লিষ্ট সংবাদে এবং নির্যাতনের শিকার নারীবিষয়ক সংবাদে নারীর উপস্থাপন বেশি। তবে ইতিবাচক ক্ষেত্রে নারীর উপস্থাপনের সংখ্যা তুলনামূলক কম গণমাধ্যমে। আমরা পত্রিকার পাতায় হরহামেশাই দেখি নারীরা কাঁদছেন এমন ছবি। তার মানে কি পুরুষেরা কাঁদে না! অবশ্যই কাঁদে, এমনকি ফুটেজ ও ছবিও পাওয়া যায় কিন্তু আমরা সেগুলো পত্রিকার পাতায় দেখি না। এসব কিছুই সমাজকে প্রভাবিত করে থাকে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা সবসময় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে আর আমরা গণমাধ্যমে শুধু সেসব নির্যাতনের ভয়াবহতা উপস্থাপন করছি। অন্যদিকে, যদি আমরা নারীবিষয়ক ইতিবাচক সংবাদ লিখি তার মাধ্যমে একজন সফল দৃষ্টান্ত অর্জনকারীর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবে দেশের অন্যান্য নারীরাও। জেন্ডার সংবেদনশীলতা বজায় রেখে সংবাদ উপস্থাপন একজন স্মার্ট সাংবাদিকের গুণাবলির মধ্যে পড়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংবাদের সমাজে একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। আমরা বলছি, আমাদের পরিবর্তন এসেছে তা কতটুকু সত্যিকার অর্থে তা দেখতে হবে। নারীকে কিভাবে দেখা যায় এবং নারী কিভাবে সংবাদে অংশগ্রহণ করে তা গুরুত্বপূর্ণ। ভেতর থেকে পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে সাংবাদিক ইউনিয়নের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ভীষণ ২০২০ এর একটি এজেন্ডা হলো কর্মক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।’ ইটিভির সিইও মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘বর্তমানে সারাদেশে মোট ১ হাজার ১৯১টি পত্রিকা রয়েছে। যেখানে ঢাকা থেকেই বের হয় ৪৭০টি পত্রিকা। পাশাপাশি ৪৫টি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। সংবাদে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার বিষয়ে সাংবাদিকদের ভাবতে হবে। সংবাদে জেন্ডার সংবেদনশীলতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতিতে কাজ করতে হবে। বর্তমানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় গবেষণা কম হয়। সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণের ক্ষেত্রেও লিঙ্গ বৈষম্য পরিলক্ষিত। তিনি একটি গবেষণার বরাত দিয়ে বলেন, ‘৮২ দশমিক ৪ শতাংশ বিশেষজ্ঞরা হলেন পুরুষ। তার মানে বোঝায় আমাদের দেশে হয়তো-বা কোন নারী এক্সপার্ট নেই! অবশ্যই আছে। সাংবাদিকদেরকে এসব জায়গায় নজর রাখার আহ্বান জানান তিনি। অ্যাজনেতা সোডেরবার্গ জ্যাকবসন বলেন, ‘একটি মিডিয়া হাউজের বৈচিত্র্য পারে ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করতে। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চপর্যায়ে নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকারীর কোম্পানিগুলো নিম্ম পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলোর চেয়ে বেশি লাভজনক। দেশে ৮ লাখ হিজড়া আছে উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, তারাও এই সমাজস্বীকৃত জনগোষ্ঠী। তাদের বিষয়ে উন্নয়নমূলক সংবাদ উপস্থাপন করা এবং তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর দায়িত্ব গণমাধ্যমের উপর বর্তায়। সাংবাদিকতায় তাদের অবস্থানটা ও আমাদের পরিষ্কার করতে হবে। জেন্ডার মানে শুধু নারী নয় এ জায়গা থেকে উত্তরণের ওপর জোর দেন তিনি। তিনি নারী পুরুষের ভারসাম্য বজায় রাখার কথাও উল্লেখ করেন। প্রথম আলোর নিউজ এডভাইসর কুরাতুল আইন তাহমিনা জানান, ‘২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা যায় ১৫ প্লাস বয়সের পাঠকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫১ শতাংশ আর ছেলে ৪৯ শতাংশ। দেশে এই হার প্রথম আলো পত্রিকার পাঠকের হিসাবে মাত্র ১৬ শতাংশ মেয়ে। আমাদের বৈচিত্র্যের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। পাঠকের সংখ্যা কমছে সেদিকে নজর রাখতে হবে।’ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বলেন, ‘আমরা শব্দ ব্যবহারে সংবাদ উপস্থাপনে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংবেদনশীল হওয়ায় বিশ্বাস করি। ভিন্নতা আনতে হবে। তা মানুষ গ্রহণ করবে। গবেষণা করে নতুন দিক বের করতে হবে। যেকোন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলেই নারীর ছবি পত্রিকায় ছাপানো, ফুটেজে নারী শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেয়ার মানে জেন্ডার সংবেদনশীলতা নয়;বরং নারী-পুরুষ উভয়কে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন- ডেইলি স্টারের ডেপুটি ডিরেক্ট শাহরিয়র খান, মাছরাঙ্গার হেড অব নিউজ রেজওয়ানুল হক রেজা, দেশটিভির নিউজ এডিটর শুকান্ত গুপ্ত, ৭১ টিভির চিফ নিউজ এডিটর বায়জিদ মিল্কি প্রমুখ।
×