ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে গত বছর প্রাণ গেছে ১০৩ জনের

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

 চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে গত বছর প্রাণ গেছে ১০৩ জনের

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ মোটরচালিত যানের চাকার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লেগে নাজমুন নাহার রাহা (১৮) নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয় গত বছরের ৪ এপ্রিল। ঘটনার দিন সকালে নোয়াখালী সরকারী কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষায় অংশ নিতে অটোরিক্সাযোগে বাড়ি থেকে রওনা দেয় এইচএসসি পরীক্ষার্থী রাহা। পথে রাহার ওড়নাটি বাতাসের ঝাপটায় দ্রুতগতির অটোরিক্সার চাকায় পেঁচিয়ে যায়। এতে রাহার গলায় ফাঁস লেগে গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন রাহাকে উদ্ধার করে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শুধু রাহা নয়, তার মতো অনেক নারী রাস্তায় চলার সময় রিক্সায়, মোটরসাইকেল, ইজিবাইক কিংবা ভ্যানে ওড়না বা শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। একের পর এক এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। অসতর্ক হয়ে রাস্তায় চলাচলের কারণে নারীরা মূলত এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৭ সালে চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে ১০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ওই সংগঠনের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে ১১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৫ জন, মার্চে ১১ জন, এপ্রিলে ৯ জন, মে মাসে ১৫ জন, জুলাই মাসে ৯ জন, অক্টোবরে ১১ জন, নবেম্বরে ৯ জন ও ডিসেম্বরে ১৩ জন মারা যান। এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী আইনজীবী সালমা আলী বলেন, ‘আমাদের দেশে যেখানে ওড়না নামক কাপড়ের টুকরাটাকে নারীর জন্য অত্যাবশ্যক বানিয়ে ফেলা হয়েছে সেখানে একবারও এটা ভেবে দেখা হচ্ছে না এটা আদৌ নারীর প্রয়োজন বা নারীর জন্য কমফোর্টেবল কি-না। এবং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি তা প্রাত্যহিক জীবন, কর্মক্ষেত্র, রাস্তা-ঘাট, বিশেষত যানবাহনে চলাচলের সময় নানানরকম বিঘœ সৃষ্টির পাশাপাশি ঘটছে ভয়ঙ্কর বিপদ। যে একফালি কাপড়ের টুকরোকে নারীর সম্ভ্রমের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, সে ওড়না যানবাহনে চলাচলের সময় একটু অসাবধান হলেই যানবাহনের (ইজিবাইক, রিক্সা, অটোরিক্সা, ভ্যানগাড়ি, সিএনজি, মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান ইত্যাদি) চাকায় জড়িয়ে নারীর মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনছে। অথচ ওড়না যে নারীর সম্ভ্রম নয়, নারীর মরণফাঁদ; সে চিন্তা কারোর মাথাতেই ঢুকছে না। তবে অবশ্যই শাড়ি বা ওড়না পরে চলাফেরা করার ক্ষেত্রে নারীর সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’ বুশরা তামান্না নূর নামের এক ছাত্রী সম্প্রতি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘সময়টা মাস তিনেক আগে। একদিন ঢাকা ভার্সিটির রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে আসছি। দুই মেয়ে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরে সাজগোজ করে যাচ্ছে। হঠাৎ রিক্সার চাকায় একজনের শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে গেলো আর মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে রিক্সা থেকে পড়ে গেলো। রাস্তায় পড়ে প্রচ- ব্যথায় কুঁকড়ে গেলো মেয়েটি। একটু হলে গলায় ফাঁস লেগে মরে যেতো হয়তোবা মেয়েটা। কিন্তু কেউ আসলো না সাহায্য করতে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিতে পাশ থেকে কয়েকটা ছেলে খুব শ্রুতিমধুর কিছু শব্দের খেলা করে গেলো। মাসখানেক আগে একটা নিউজ পড়লাম এমন যে ‘অটোরিক্সার চাকায় ওড়না আটকে মৃত্যু এস এস সি পরীক্ষার্থীর। শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন।’ কি সাবলীল ভাষায় কি ভয়ঙ্কর গা শিউরে উঠা একটা খবর। কিন্তু পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো সাবধানে রাখবে না ওড়না? আজ অটোরিক্সায় এক জায়গায় যাওয়ার পথে একই দুর্ঘটনা আমার সঙ্গে। গলার একপাশে ওড়না থাকার কারণে তা একপাশের উপর দিয়েই গেলো। আমি নিশ্চিত গলায় প্যাঁচ লাগলে আমারও মাথা থেকে দেহখানা আলাদা হয়ে যেতো। এখন ছিলে যাওয়া ঘাড় নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণার বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছি। আমি জানি এই লেখাটা পড়ার পর সবাই বলবে ‘একটু সাবধানে থাকতে পারোনি? রিক্সায় কিংবা ইজিবাইকে উঠলে ওড়না সাবধানে রাখতে হয়।’ দুঃখিত আমার জন্য দুঃখ পাওয়া সেই সমব্যথীদের। দরকার নেই আমার এমন সমবেদনার যা কোন সমস্যার স্থায়ী সমাধান দেয় না। এমন পোশাক কেন পরতে হবে যা একটা মানুষের জীবন বিপন্ন করে। এই ওড়না কিংবা শাড়ির মতো কাপড়গুলো এক টুকরো ঝামেলা ছাড়া কিছুই না। মেয়েদের এবং মেয়ে জাতিকে দুর্বল করার একটা প্রয়াস মাত্র।’ নিজের এমনই এক ভয়ঙ্গর অভিজ্ঞতা এভাবেই সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করেন এই নারী। সেন্টার ফর দি রিহ্যাবিলিটেশন অব দি প্যারালাইজড (সিআরপি) বা পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র এই সব রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে। সিআরপিতে বিশ বছর ধরে কাজ করেন ফিজিওথেরাপিস্ট শামিমা আক্তার। তিনি জানান, বর্তমানে রিক্সায়, বাইকে, ইজিবাইকে ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস লেগে দুর্ঘটনা বাড়ছে। আর আমাদের এখানেও অনেক নারীরা আসেন চিকিৎসা নিতে। এই দুর্ঘটনায় রোগীর মেরুদণ্ডের নিচের দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গলায় ফাঁস দিলে যেমনটা হয়। ফলে পেশীর শক্তি ও হাত-পায়ের বোধশক্তি কমে যায়। আঘাতের গুরুতরের ওপর নির্ভর করে রোগীর অবশ হওয়ার অবস্থা। সম্পূর্ণ স্পাইনাল কর্ড ভেঙ্গে গেলে কমপ্লিট কেস বলা হয়। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়। এই রোগীর কোন বোধশক্তি থাকে না। এমনকি প্রাকৃতিক ডাকও তারা বুঝতে পারেন না। স্পাইনাল কর্ড কতটা ক্ষতিগ্রস্ত তার ওপর রোগীর ভাল হওয়া নির্ভর করে। তবে তার পুরোপুরি ভাল হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না। ক্ষেত্র বিশেষে কোন সাপোর্ট নিয়ে চলা বা হুইল চেয়ারে চলার মতো উন্নতি হতে পারে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, বিদায়ী ২০১৭ সালে সারাদেশে ৪ হাজার ৯৭৯ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়। এদের মধ্যে চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে ১০৩ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে। সংগঠিত দুর্ঘটনার ২.৮ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে সংগঠিত হয়েছে। নারীদের অসতর্কতার কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এজন্য আরও সতর্ক হয়ে ওড়না নিয়ে রাস্তায় ও যানবাহনে চলাচল করতে হবে।’ সেইসঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে তিনি আর বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সমন্বিত পরিকল্পণা গ্রহণ করা দরকার। সমন্বিত পরিকল্পনা না নিলে সড়ক দুর্ঘটনা অন্যতম একটা স্বাস্থ্য বিপর্যয় হিসেবে দেখো দেবে।’
×