ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ট্যাঙ্ক ও ভারি মেশিনগানের গোলায় কেঁপে উঠল স্বর্ণদ্বীপ

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

ট্যাঙ্ক ও ভারি মেশিনগানের গোলায় কেঁপে উঠল স্বর্ণদ্বীপ

ফিরোজ মান্না, নোয়াখালীর স্বর্ণদ্বীপ থেকে ॥ শত্রু পক্ষ স্বর্ণদ্বীপ দখল করে নিয়েছে। দ্বীপটিকে শত্রুমুক্ত করতে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে নৌ ও বিমান বাহিনীর সহযোগিতায় সেনাবাহিনী দ্বীপটিতে আক্রমণ চালায়। ধ্বংস করা হয় শত্রুর ট্যাঙ্ক-শত্রুর বাঙ্কার। হতাহত হয় শত্রুর বহু সদস্য। এই যুদ্ধে অনেক শত্রু সৈন্য হতাহত হয়। ভূমি থেকে ভূমিতে ট্যাঙ্কের ভয়ঙ্কর আক্রমণ। চারদিকে জ্বলছে আগুন। ট্যাঙ্ক ও ভারি মেশিন গানের গোলাবর্ষণে গোটা দ্বীপ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। যেন সত্যি সত্যি যুদ্ধ।চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় চালানো আক্রমণে গুড়িয়ে দেয়া হয় শত্রুর সব অবস্থান। মাত্র ৪৫ মিনিটের যুদ্ধে শত্রুর সব শক্তি ধ্বংস করে দেয়া হয়। অবশেষে যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন। বিজয়ের খবরটি রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছে দেয়া হলে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানান। শত্রু শত্রু এই খেলা সেনাবাহিনীর শীতকালীন মহড়া ‘অপারেশন ব্যাঘ্রথাবা।’ মহড়া পরিদর্শন করেন, ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এসএম শামীম উজ্জামান ও ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোঃ রাশেদ আমিন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৌ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মহড়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কায়সার মালিক। ১৭ পদাতিক ডিভিশনের ৫২ পদাতিক ব্রিগেড মহড়াটি পরিচালনা করেন। বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে উঠা বিস্তীর্ণ চর। ঝাউবন ঘেরা এই চরে চলছে মহা কর্মযজ্ঞ। জেগে উঠা চরটির বর্তমান নাম স্বর্ণদীপ। আগে এর নাম ছিল জাহাজ্জ্যার চর। এখন এই গোটা চরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। রবিবার এই দ্বীপ চরে সেনাবাহিনীর আক্রমণ অভিযান মহড়া ‘অপারেশন ব্যাঘ্রথাবা’ প্রদর্শিত হয়। মহড়ায় পদাতিক সাঁজোয়া এবং গোলন্দাজ বাহিনী ছাড়াও সেনাবাহিনীর অন্য সব আর্মস/সার্ভিসেস অংশগ্রহণ করে। অনুশীলনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নতুন সংযোজিত অত্যাধুনিক অস্ত্র সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও স্পেশাল ফোর্স হিসেবে এডহক প্যারা কমান্ডো ব্রিগেডের এক প্যারা কমান্ডো ব্যাটিলিয়ান প্রারাট্রুপার, আর্মি এ্যাভিয়েশন গ্রুপ, বাংলাদেশ নৌ বাহিনী ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এই আক্রমণ অনুশীলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সহায়তা করেছে। স্বর্ণদ্বীপে সেনাবাহিনীর যে সব প্রশিক্ষণ হয় তার মধ্যে রয়েছে, চলম্যানুএভার ট্রেনিং, মেজর অপারেশন, এ্যাটাক, ডিফেন্স ট্যাকটিকেল উইথড্র ট্রেনিং সঙ্গে কমান্ডো ও ফায়ার এ্যান্ড মুভ। এসবই সেনাবাহিনীর নানা প্রশিক্ষণের নাম। এসব প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ট্যাঙ্ক, এপিসি, মর্টার, এ্যান্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল ও রকেট লাঞ্চার, হেভি মেশিনগান, সেলফ প্রোপেল্ড আর্টিলারি (এসপি আর্টিলারি)। এসব ট্রেনিং ও অস্ত্র নিয়ে অংশ নিচ্ছে ইনফেন্ট্রি, আর্মার্ড, আর্টিলারিসহ (ফিল্ড আর্টিলারি ও মিডিয়াম আর্টিলারি) বিভিন্ন কোর এবং আর্মি এ্যাভিয়েশন। উন্নত ও অত্যাধুনিক এসব অস্ত্র প্রশিক্ষণে নিজেদের সমৃদ্ধ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এজন্য বেছে নেয়া হয়েছে নোয়াখালীর প্রত্যন্ত চর স্বর্ণদ্বীপকে। স্থানীয়ভাবে এটা পরিচিত জাহাজ্জ্যার চর নামে। প্রতন্ত ও দুর্গম এলাকা হিসেবে এটি খুবই সুপরিচিত। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ৭২ হাজার একরের এ চরের নতুন নামকরণ করা হয়েছে স্বর্ণদ্বীপ। এখানেই গড়ে তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গড়ে তোলা হয়েছে এমন একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের কবল থেকে রক্ষা করে দ্বীপে গড়ে তোলা হচ্ছে নানা ধরনের অবকাঠামো। একই সঙ্গে চলছে বনায়ন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কাজ। সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে ২০১৩ সালে চরটি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাতে শুরু করে এখানকার দৃশ্যপট। বদলে যেতে থাকে দ্বীপটির চিত্র। প্রথমেই দস্যুদের রাজত্বের অবসান ঘটে। নোয়াখালীর সুবর্ণচর, চট্টগ্রামের ্দ্বীপসহ আশপাশের এলাকা হয়ে ওঠে নিরাপদ। দীর্ঘদিনের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হন স্থানীয়রা। সম্ভাবনা জাগিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন জীবিকা সন্ধানের পথ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে গড়ে তোলা হয়েছে সাইক্লোন শেল্টার। প্রাকৃতিক নানা ভাঙা-গড়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে এসব তৈরি করছে সেনাবাহিনী। বহুমাত্রিক প্রশিক্ষণের জন্য এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা বলে জানিয়েছেন সেনা কর্তৃপক্ষ। এ কারণে স্বর্ণদ্বীপকে ঘিরে তৈরি করা হচ্ছে মাস্টারপ্লান। তৈরি হচ্ছে রাস্তা ঘাটসহ নানা অবকাঠামো। উন্নত বিভিন্ন দেশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। সে সবের আলোকে গড়ে তোলা হচ্ছে স্বর্ণদ্বীপকে। এরই মধ্যে কিছু প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী। পর্যায়ক্রমে ২০ হাজারের বেশি সেনা সদস্য প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এই কেন্দ্র থেকে। শীঘ্রই স্বর্ণদ্বীপে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়া সেনা সদস্যদের। সেনাবাহিনী সূত্র জানিয়েছে, শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত দেশগুলোতে বেশিরভাগ সময় সেনা সদস্যদের ‘ফায়ার এ্যান্ড মুভ’ অপারেশন করতে হয়। এতদিন এ ধরনের প্রশিক্ষণ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে স্বল্প পরিসরে ও স্বল্প প্রুপে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে স্বর্ণদ্বীপে এ ধরনের প্রশিক্ষণ অনায়াসেই দেয়া সম্ভব হবে। ওই প্রশিক্ষণের ফলে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে থাকা বাংলাদেশী সেনা সদস্যদের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের সহযোগিতায় ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর আওতায় সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি। নতুন সংযোজিত এসব আধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জামাদির ওপর সেনা সদস্যদের প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য এখন প্রয়োজন বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ। কিন্তু জনবহুল ও কৃষিনির্ভর এদেশে পতিত ভূমির পরিমাণ অপ্রতুল। দেশের অন্যান্য এলাকায় বড় সেনাদল কর্তৃক কার্যকর যৌথ প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য বড় আয়তনের প্রশিক্ষণ এলাকা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্বর্ণদ্বীপের বিশাল আয়তনের ভূমি রণকৌশলগত ও বহুমুখী প্রশিক্ষণ এলাকার অভাব দূর করে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে তার পেশাগত দক্ষতা ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সক্ষম হবে। ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দ্বীপে শুধু শীতকালে আনুমানিক ৫ মাস সীমিত এলাকায় প্রশিক্ষণ কর্মকা- পরিচালনা করা যায়। বছরের অন্য সময় স্বর্ণদ্বীপের বেশিরভাগ এলাকা জোয়ারের পানিতে সাধারণত ২ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত নিমজ্জিত থাকে। নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পদাতিক ডিভিশনগুলো থেকে নির্বাচিত প্রতিটি ব্রিগেড গ্রুপ আনুমানিক দেড় হাজার থেকে দুই সেনা সদস্য ট্যাঙ্ক, এপিসি, আর্টিলারি গানসহ অন্যান্য ভারি ও হালকা সরঞ্জামাদি নিয়ে এই দ্বীপে ২-৩ সপ্তাহের প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। এছাড়া জাতিসংঘ মিশনে সেনা মোতায়েনের আগে মোতায়েনপূর্ব প্রশিক্ষণের জন্য এই চর ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণকে বাস্তবমুখী করতে এখানে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ভূমিরও পরিবর্তন আনা হয়েছে (ল্যান্ড স্কেপিং)। এটা খুবই ব্যতিক্রম এবং চ্যালেঞ্জিং। ভবিষ্যতে স্বর্ণদ্বীপে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ পরিধি আরও বিস্তৃত করা হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন নতুন অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জামে সক্ষমতা বাড়ছে প্রতিরক্ষা বাহিনী। ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর আলোকে সেনাবাহিনীতে নতুন পদাতিক ডিভিশন, ব্রিগেড ও ইউনিট প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে সেনাবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের ট্যাংক এমবিটি-২০০০। চীনের তৈরি এই ট্যাঙ্ক দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যবহৃত ট্যাংকের মধ্যে অত্যাধুনিক হিসেবে বিবেচিত।
×