ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

হাসান হাবিব

কবিতার সেইসব আগুন ও কণ্ঠস্বর

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

কবিতার সেইসব আগুন ও কণ্ঠস্বর

‘বল বীর বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ Robert Frost-Gi ÔThe Road Not Taken’- কবিতাটি সম্ভবত- বিশ্বে ছাত্রছাত্রীদের কাছে সবচেয়ে বেশি পঠিত হয়ে আসছে। আর বাংলা কবিতা? কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’-কবিতাটি অবশ্যই বিশ্বের বৃহৎ জনসংখ্যার ভারতবর্ষে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পঠিত কবিতা। আমরা জানি, বাংলা কবিতা তার বিশেষ কারণ ও প্রয়োজনে একেক সময় একেক বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। তবে কবিতা কখনও কখনও আবেগ ও অনুভূতির কমনীয় রূপ ভেঙ্গে যে একটি বিশিষ্ট রূপ পায়, তাকে কেউ কেউ কবিতা না বলে ‘ভাষ্য’, ‘আদর্শ’, ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ ইত্যাদি বলবেন। কিন্তু সেটি এ কারণে মানা যায় না যে, কবি অবশ্যই একজন সমাজের যেমন প্রতিনিধি, তাকে আবার সে সমাজসচেতন হেতু আবেগের আশ্রয় নিতে হয়। আমরা যদি এ কথা স্বীকার করিও যে, ভারতবর্ষ ত্যাগ ও উদার নৈতিকতার সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে উঠেছে। এবং আমরা জানি, বাংলা ভাষাভাষীগণ সকলকালেই সুখ-দুঃখ, জড়া-জড়ি, উত্থান-পতন, শাসন-শোষণ ইত্যাদির মধ্যে থেকে ‘ত্যাগেই সুখ-ভোগে নয়’টি বেশ আত্মস্থ করেছে। আর এখানকার কবিরাও এ মূল্যবোধ থেকে নিজেকে কখনও মুক্ত করতে পারেনি। কিন্তু ভক্ত চেয়েছে তার দুঃখগাথার সঙ্গে একাত্ম হোক কবি; এ কারণে কবির ‘পুত-পবিত্র’ কবিত্ব মনটিও ‘জনতার কথা’ নিয়ে এক সময় ‘অগণতান্ত্রিক’ ও সংহারিত রুদ্ররূপ লাভ করেছে। তাকে অবশ্যই কবিতা বলতে হবে। তবে বাঙালী কবি দায়িত্ব জ্ঞানে যতটুকু সফল তার চেয়ে বেশি তার এ এগিয়ে আসার পথে তাকে যে মূল্যবান জীবন পাথার বোহিমিয়ান পাড়ি দিতে হয়, তার জন্য কোন কবিকেই কখনও কোন আক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। আমরা দেখি, কবিতার জন্য কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, আবুল হাসান ও রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অকালে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। কবিতার জন্য জীবন বিলিয়ে দিলেও এ কবি ত্রয় তাঁদের কবিতায় যে আগুন ও কণ্ঠস্বর রেখে গেছেন, তার জন্য তাঁরা বাংলা কবিতার জগতে যুগে যুগে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই। তাঁরা কবিতায় রেখে গেছেন জীবনের কথা মানুষের কথা। আসলে শুরুতে পাথর ও গুহার দাবিগুলো যখন মানুষ বুঝে গেল, তখন তা’ আর প্রকৃতি থাকেনি। মানুষের অংশ হয়ে যায়। অতিক্রান্ত কবি তাই মানুষের প্রেমে প্রকৃতিকেও ভুলে যান! কিন্তু কোন রাজটিকা? উদার জমিনে আনন্দে উড়ছিল। তখনও মানুষ ছিল তার ভাবস্বর্গে একেকটি নিজস্ব জগতের অধিকারী। সে জগত একসময় খুঁজে নেয় জীবনের কথকতা। রাজকন্ঠী কবি ‘কলসি কইন্যা’র প্রেমে ডুবে যান ‘গহীন গাঙ’র জলে। কিন্তু ক্রমাগত সমাজে এসে গেল শাসন-শোষণ, নিপীড়ন ও ঔপনিবেশিকতা। জীবনে বিভ্যাজ্যতা, প্রতিযোগিতা ও সঙ্কট এসে যায়। কবি হয়ে পড়েন সমাজ ও রাষ্ট্রসচেতন। এ সময় কবির কণ্ঠে শাণিতরূপ এসে গেল- ‘মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেইদিন হব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না, বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।’ তবে বাংলা কবিতা প্রাচীন ও মধ্যযুগে ততটা মানবিক না হলেও আধুনিক যুগের এ শাণিতরূপ এসেছে অবশ্যই সমাজের প্রতি রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিকতা ও নির্লিপ্ততার ফলে। আর অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, এ কারণে বাঙলা কবিতার স্বর প্রেম ও প্রকৃতি ছেড়ে ক্রমে সুধীজন থেকে গণমানুষের হয়ে উঠতে থাকে। সমাজে মন্বন্তর শাসন- শোষণ, নিপীড়ন যত বাড়তে থাকে কবিতার ভাষা ও ভঙ্গি ততটা বিশেষ নির্দিষ্ট ফর্ম ভেঙ্গে দুর্বিনীত, দ্রোহ, বিদ্রোহ, সংহার, স্বাধীকার, প্রতিবাদ দৃকপরিগ্রহ করে। প্রাসঙ্গিকক্রমে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রেম ও প্রকৃতি বাঙালীর হৃদয় জয় করে যখন সারা বিশ্বকে জীবন ও সৌন্দর্যের এক অমোঘ বার্তা পৌঁছে দেয়, তখন নজরুলের ‘বিদ্রোহ’ সারা ভারতবর্ষের নীরবতা ভেঙ্গে বিস্ফোরোন্মুখ সাড়া ফেলে দেয়। নজরুলের ‘লৌহকপাট’ অথবা ‘শিকলপূজার পাষাণ-বেদী’ ভাঙ্গার উন্মত্ত দাবানল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ভারত-ব্রিটিশ মসনদ টলে দিয়েছিল। এ কবিতায় ছিল এক অদম্য স্বর ও আগুন। ছিল প্রলয় ও ধ্বংসের উত্তাপ। এরপর নজরুলের হাতে বের হলো সাহিত্যের কাগজ ‘ধূমকেতু’। আর ‘ধূমকেতু’র ঝড়ের সঙ্গে উড়ে আসতে লাগল গোপীনাথরা। তাতেই ব্রিটিশ রাজাধিরাজ গেল ভড়কে। নজরুলকে পুরা হলো জেলে। কিন্তু বৈষম্য, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে এ ‘কনভিক্ট’ নজরুল ছিল এক আতঙ্ক। তিনি প্রতিবাদে অনশন করলেন। অনেক ঘটনার পর এ অনশন ভাঙ্গাতে পারলেন তাঁরই মাতৃসম বিরজাসুন্দরী দেবী। এখানে আরও বলা প্রয়োজন যে, মানব ও মানবদরদী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের সমাজ ও রাষ্ট্রের শাসন শোষণের এ বিরোধী কর্মকা-ের প্রতি ছিলেন অকুণ্ঠ সমর্থক ‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। অলক্ষণের তিলক রেখা রাতের ভালে হোক্ না লেখা, জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরে’ আছে যারা অর্ধচেতন।’ তাঁর এ আশীর্বাণী ‘ধূমকেতু’র জয়গানকে করেছিল বেগবান। বলাবাহুল্য, ১৯৪৩-এর মন্বন্তর নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, অবন্তী সান্যাল, সুকান্ত ভট্টাচার্য, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, দিনেশ দাসদের হাতে যে সব কালজয়ী বিপ্লবী কবিতা রচিত হয়েছিল সেগুলো অবশ্যই নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ ও ‘সাম্যবাদ’র পরম্পরা ও অনুস্মারণ বটে? তবে এসব কালোত্তীর্ণ কবিতার আবেদনে ছিল বাঙালী জীবনের দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর মর্মপীড়া থেকে একেকটি শাণিত প্রতিবাদ ও চিত্র। এ সময় সুকান্তের হাতে ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’, ‘বোধন’, ‘ফসলের ডাক- ১৩৫১’, সমর সেনের ‘গৃহস্থবিলাপ’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘চিরকুট’, ‘এই আশ্বিনে’, অবন্তী সান্যালের ‘কাহিনী’, সৈয়দ আলী আহসানের ‘নূতন সূর্যের দিন’-এর মতো সব বিখ্যাত কবিতার জন্ম হয়েছিলো। এসব কবিতা বাঙলা সাহিত্যের গৌরবময় আঁধার বহন করে। তবে বাঙলা কবিতায় দ্রোহ, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের এক শর্তহীন স্বতঃস্ফূর্ত ও একত্রিত অন্যরূপ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংগ্রাম। এসব কবিতার মূল স্বর হলো মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত এসব কবিতায় ভাষা ও কণ্ঠস্বর আমাদের জাতীয় জীবনে যে উত্তাপ ও উত্তেজনা এনে দেয় তা’ বিশ্বের অন্য কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। মুক্তিযুদ্ধের এ কবিতায় আছে বিভীষিকা, ভয়াবহতা, রক্তাপ্লুত দুঃস্বপ্নময়, কাঁটাতার ঘেরা, বেয়নেটবিদ্ধ, বুলেটদীর্ণ, সংগ্রাম ও জাগরণের মতো বিস্ময়কর দীপ্তি ও সঞ্জীবিত সব কণ্ঠস্বর। এসব কবিতার পঙ্ক্তি আমাদের শরীর মনকে যতটা উদ্বেলিত ও উজ্জীবিত করে তা’ আর কোন কবিতা করে না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের অসংখ্য কবি বিখ্যাত সব কবিতা রচনা করেছেন। কবিদের এসব কবিতা কারো চেয়ে কারও কম বিখ্যাত নয়। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি কবি শামসুর রাহমান, আবুল হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, খালেদা এদিব চৌধুরী, হেলাল হাফিজ, আবিদ আজাদের কথা উল্লেখ করি, তাহলে মনে হবে সব বিখ্যাত কবির নাম বাদ পড়ে গেল।
×